বৈশ্বিক মহামারীর এ ক্রান্তিকালে জনজীবন চরম দুর্দশায় পর্যদুস্ত। গৃহবন্দী জীবনে কমছে কাজ,কর্মক্ষেত্র থেকে ছাটাই হচ্ছে অজস্র মানুষ। প্রতিদিনই বিশ্বজুড়ে হাজারো মানুষের অকাল মৃত্যুর খবর প্রকাশ হচ্ছে খবরের কাগজ, টেলিভিশনে। আজকের যে সময়টাতে বসে আমি এসব লিখছি তখনও (২৪শে নভেম্বর) বাংলাদেশে ৩২ জনা মারা গেছেন এবং ২২৩০ জন নতুন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছেন। এখন সকলের একটাই প্রত্যাশা করোনা ভ্যাকসিন ।
যেই ভাইরাসের জন্য এতসব হচ্ছে সেটি হলো SARS-COV-2। করোনার প্রথম দফা শেষ হতে না হতেই দ্বিতীয় দফা শীতের এ সময়ে তার রুপটি আরও তীব্রতর করে ফেলেছে। আক্রান্তের হার সহসাই বেড়ে যাচ্ছে।
এত খারাপ সংবাদের মধ্যে একটা সুসংবাদ হলো বহুল প্রত্যাশিত করোনা ভ্যাকসিন আবিষ্কৃত হয়েছে। খুশির মাত্রাটা আরও বেড়ে যায় যখন জানা যায় জার্মান মুসলিম এক দম্পতি ড.উগার শাহিন ও ওজলেম তুরেসি আবিষ্কার করেছে করোনার প্রথম কার্যকর ভ্যাকসিনটি। তো চলুন বিস্তারিত জেনে নেয়া যাক আবিষ্কারক এ দম্পতির জীবনী ও তাদের কর্মকান্ড সম্পর্কে।
আর্টিকেলে যা থাকছেঃ
ড. উগার শাহিন ১৯৬৫ সালে তুরস্কের ইস্কেন্দেরুন শহরে জন্মগ্রহণ করেন (৫৫ বছর বয়স)। অন্যদিকে ৫৩ বছর বয়সী ওজলেম তুরেসি জার্মানীর ক্লোপেনবার্গে জন্মগ্রহণ করেন। তুরস্কের বংশোদ্ভূত জার্মান এ দম্পতি ইমিউনোলজিস্ট, চিকিৎসক এবং অবশ্যই কিংবদন্তী বিজ্ঞানী।
উগার শাহিনের বয়স যখন ৪, তখন তাঁর পিতা মাতা অভিবাসী হিসেবে তুরস্ত থেকে জার্মানীতে স্থানান্তরিত হন। তাঁর পিতা ফোর্ড গাড়ি নির্মাণ কোম্পানিতে কাজ করতেন।
চিকিৎসক হবার তীব্র বাসনাই তাকে সে অবস্থা থেকে বিশ্বখ্যাত চিকিৎসক ও বিজ্ঞানীতে পরিণত করেছে। তিনি ইউনিভার্সিটি অফ কলোগনি থেকে ১৯৯০ সালে চিকিৎসাশাস্ত্রে গ্রাজুয়েশন শেষ করেন। কিন্তু দ্রুতই কাজে প্রবেশ করতে হয় তাকে।
তারপরেও ১৯৯৩ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম পি.এইচ.ডি ডিগ্রী অর্জন করেন। চিকিৎসক বাবার পথ অনুসরণ করে ওজলেম তুরেসিও সারল্যান্ড ইউনিভার্সিটির চিকিৎসাবিজ্ঞান অনুষদে এম.ডি ডিগ্রী লাভ করেন।
৮ বছর সারল্যান্ড ইউনিভার্সিটি হাসপাতালে কাজ করার পরে ২০০০ সালে উগার শাহিন ইউনিভার্সিটি অফ মেইনজে ফ্যাকাল্টি হিসেবে যোগদান করেন।
তিনি ২০০৬ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর পদে উন্নীত হন।এছাড়া ২০০১ সালে তিনি ‘গ্যানিমেড ফার্মাসিউটিকালস’ প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠানটি ক্যান্সারের ইমিউনোথ্যারাপি নিয়ে কাজ করতো এবং পরবর্তীতে ‘এসট্যালাস ফার্মা‘ ২০১৬ সালে এটি কিনে নেয়।
এখানে উল্লেখ্য যে, তাঁর স্ত্রী ওজলেম তুরেসি প্রতিষ্ঠানটির সহ প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন এবং চিফ সায়েন্টিফিক অফিসার হিসেবে কাজ করেন। এছাড়াও তিনি ইউনিভার্সিটি অফ মেইনজ এর লেকচারার।
ক্যান্সারের চিকিৎসা করার জন্য ২০০৮ সালে এ দম্পতি ‘বায়োএনটেক‘ নামক প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠা করেন।করোনার প্রথম কার্যকর ভ্যাকসিন আবিষ্কারের পূর্ব পর্যন্ত এ প্রতিষ্ঠানটি ইউরোপের বাইরে তেমন পরিচিত ছিলো না।বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতে অবদান রাখা মুসলিম বিজ্ঞানীদের ইরান ‘মুস্তফা পুরস্কার’ প্রদান করে। ২০১৯ সালে উগার শাহিন এ পুরস্কারটি পান।
গবেষণার জন্য দুজনে উগার শাহিন ও ওজলেম তুরেসি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের হাসপাতালে যান ১৯৯৩ সালে। সেখানেই তাদের পরিচয় এবং ২০০২ সালে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন এই বিজ্ঞানী জুটি। এ দম্পতির একজন কন্যা সন্তান রয়েছে। এই দম্পতি জার্মানির সেরা ১০০ ধনীর অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু তাদের সাদামাটা জীবনযাপন দেখলে এ বিষয়টা বোঝার কোন উপায় নেই। গবেষণাপ্রেমী এ জুটি তাদের বিয়ের দিনও ল্যাবে কাজ করেছেন।
এ বছরের জানুয়ারীতেই তারা নিজ উদ্যোগে ক্যান্সারের মেডিসিন এমআরএনএকে এমআরএনএ ভ্যাকসিনে রুপান্তরের চেষ্টার মাধ্যমে করোনা ভ্যাকসিন আবিষ্কারের প্রাথমিক কার্যক্রম শুরু করেন।
যুক্তরাষ্ট্রের স্বনামধন্য ফার্মাসিউটিকাল কোম্পানি ফাইজারের সিইও আলবার্ট বোরলা দুই বছর পূর্বে জার্মানির একটি সেমিনারে গিয়েছিলেন। সেখানে উগার শাহিন মানুষের দেহের আরএনএ কোষ নিয়ে তাঁর গবেষণালব্ধ তথ্য তুলে ধরেন।
তাছাড়াও আরএনএ ভাইরাস ভবিষ্যতের যেকোন মহামারী থেকে মানুষকে রক্ষার হাতিয়ার হতে পারে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। এভাবেই তাদের পরিচয় ঘটে।
করোনার মহামারীর প্রাক্কালে বোরলা ড. শাহিনের সাথে যোগাযোগ করলে করোনা ভ্যাকসিন আবিষ্কারের জন্য গবেষণা শুরুর কাজ পুরোপুরি শুরু হয়। নভেম্বরের ১১ তারিখ ফাইজার বলে যে , আবিষ্কৃত এই ভ্যাকসিনটি মানবদেহে ৯০% এরও বেশি কার্যকর। ‘বায়োএনটেক’ এর বর্তমান বাজারমূল্য ২ হাজার ৫০০ কোটি ৭২ লাখ ডলার যেখানে ১৪০০ গবেষক রয়েছে।
প্রতিষ্ঠানটি ২০১৮ সালে বিল এন্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন থেকে ৫৫ মিলিয়ন ডলার অনুদান পেয়েছিলো এইচআইভির প্রতিষেধক আবিষ্কারের কারণে। এ বছরের ডিসেম্বরে এবং ২০২১ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সব দেশে ভ্যাকসিন বিতরণের আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন ড. উগার শাহিন।
‘বায়োএনটেক’ কে ইউরোপের সবচেয়ে বড় ঔষধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলা ড. উগার শাহিন ও ওজলেম তুরেসির স্বপ্ন। আমরাও আশা করি বিজ্ঞানে নিবেদিতপ্রাণ দম্পতির এ প্রতিষ্ঠানটি বহুদূরে যাক। এবং তার সাথে আবিষ্কৃত এই ভ্যাকসিনটি পৌঁছে যাক উন্নত কিংবা উন্নয়নশীল নির্বিশেষে পৃথিবীর সকল দেশের জনসাধারণের কাছে।
ছবিঃ সংগৃহীত
মন্তব্য লিখুন