পৃথিবীতে প্রতিনিয়ত অবাক করে দেওয়া অনেক ঘটনা ঘটে চলেছে। কখনো আমরা সেগুলোকে প্রত্যক্ষভাবে চোখে দেখতে পারি, আবার কখনো শুধুমাত্র আমাদের মস্তিষ্ক কিংবা ইন্দ্রিয় দ্বারা অনুভব করতে পারি। আমাদের মস্তিষ্ক অনেক সময় কিছু বিভ্রম এর সৃষ্টি করে, যেগুলোর সমাধান পাওয়া একটু জটিল হয়ে যায়। যেমন ধরুন আপনি কোনো নতুন জায়গায় বেড়াতে গিয়েছেন কিন্তু আপনার অনুভব হচ্ছে আপনি এই জায়গায় আগেও এসেছেন। অথবা কোন একটা ঘটনা দেখে আপনার মনে হচ্ছে এটা আপনি আগেও দেখেছেন। কিন্তু বাস্তবিক অর্থে এরকম কিছু আপনি আগে দেখেন নি কিংবা আপনার সাথে আগে ঘটেনি। আমাদের মস্তিষ্কের এই বিভ্রম আসলে একটি প্যারাসাইকোলজিকাল ঘটনা। বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে “দেজা ভ্যু” বলে। বিজ্ঞানীদের মতে ৬০ থেকে ৮০ শতাংশ মানুষের কখনো না কখনো “দেজা ভ্যু” অভিজ্ঞতা হয়েছে। চলুন তাহলে “দেজা ভ্যু” সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক।
আর্টিকেলে যা থাকছেঃ
“দেজা ভ্যু” একটি ফ্রেঞ্চ শব্দ। এর অর্থ “আগেই দেখা বা পূর্ব পরিচিত”। অর্থাৎ অপরিচিত কিছু দেখে পরিচিত মনে হওয়াটা “দেজা ভ্যু”। কোন নতুন অভিজ্ঞতা যখন আপনার কাছে পূর্ব পরিচিত মনে হবে তখন সেটাকেই “দেজা ভ্যু” হিসাবে ধরে নেওয়া হয়। ১৮৭৬ সালে একজন প্যারাসাইকোলজিস্ট “এমিল বইরাচ” সর্বপ্রথম এই শব্দটি ব্যবহার করেন। তিনি ফরাসি একটি জার্নাল “ফিলোসোফি” কে লেখা একটা চিঠিতে “আগে যেন দেখেছি” এর অনুভূতি বর্ননা করতে গিয়ে এই শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন।
“দেজা ভ্যু” কেন ঘটে এটার নির্দিষ্ট কোন ব্যাখ্যা এখনো অবদি পাওয়া যায় নি। তবুও বিজ্ঞানীগণ এটাকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে চলেছেন।
এটি সম্পর্কে অনেক তত্ত্ব আছে। প্রথমত হতে পারে, যে পরিস্থিতি বা ঘটনাটি আপনার পূর্ব পরিচিত মনে হচ্ছে সেটি আসলেই আপনার সাথে আগে ঘটেছিল কিন্তু আপনি সেটা ভুলে গিয়েছেন। অথবা কোন নতুন জায়গায় গিয়ে কিংবা কোন কাজ করার সময় হয়তো প্রথমে আপনি অতোটা খেয়াল করে দেখেন নি। যখন আপনি সতর্কতার সঙ্গে খেয়াল করলেন তখনই আপনার মনে হবে এটা পূর্ব পরিচিত কোন ঘটনা।
এটি মূলত অকস্মাৎ ঘটে যাওয়া কোন ঘটনা। বিজ্ঞানীদের ধারণা এর জন্য আমাদের মস্তিষ্কের “টেমপোরাল লোব” দায়ী। অনেক সময় আমাদের স্নায়ুকোষ বা নিউরনের কর্মহীনতার ফলে মস্তিষ্কের টেমপোরাল লোবে এক ধরনের ইলেক্ট্রিক্যাল শকের সৃষ্টি হয়। আর এই শক থেকেই আমাদের এই অভিজ্ঞতার সৃষ্টি হয়।
“দেজা ভ্যু” সম্পর্কে কোয়ান্টাম মেকানিকাল তত্ত্ব কিংবা ব্যাখ্যা রয়েছে । অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন যে, প্যারালাল ইউনিভার্সে আপনার প্রতিরূপ এর সাথে আগেই ঘটে যাওয়া কোন ঘটনা এ জগতে আপনার কাছে পূর্ব পরিচিত বলে মনে হবে। আবার এমনও হতে পারে, দুটি প্যারালাল ইউনিভার্স যখন একে অপরকে ক্রসচেক করে ঠিক তখনই আপনার এই অভিজ্ঞতা হবে। যেহেতু কোয়ান্টাম মেকানিক্স এর ধারণা অনুযায়ী প্যারালাল ইউনিভার্স তত্ত্বটি সত্যি, সেহেতু “দেজা ভ্যু” সম্পর্কে প্যারালাল ইউনিভার্সের এই তত্ত্বটাও মিথ্যা নয়।
“দেজা ভ্যু” গবেষক “ক্রিস মোলিন” এর মতে, আমরা যখন নতুন কোন জায়গায় বেড়াতে যাই কিংবা অভিনব কোন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হই ঠিক তখনই আমাদের “দেজা ভ্যু” হয়। গবেষণা অনুযায়ী যারা যত বেশি ট্রাভেল করে তাদের “দেজা ভ্যু” এর অভিজ্ঞতাও বেশি হয়।
বিজ্ঞানীদের মতে তরুণ বয়সীদের এটি বেশি হয়। এবং বয়স বাড়ার সাথে সাথে এই অভিজ্ঞতা হওয়ার সম্ভাবনা কমতে থাকে।
অধিক “দেজা ভ্যু” হওয়ার ফলে আমরা অনেক সময় ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আগেই আঁচ পেতে পারি। গবেষক ক্রিস মোলিন এর মতে- আমাদের মস্তিষ্ক আমাদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ধারণা দিতে সাহায্য করে।
একই ভুল যেন বার বার না করি এই জন্যই আমাদের মস্তিষ্কে স্মৃতি সংরক্ষিত থাকে। এই সময় মস্তিষ্কের আরো একটি অংশে প্রভাব পড়ে। ফলে এটি আপনার আবেগ কে স্পর্শ করে এবং আপনার মস্তিষ্কে জমাকৃত স্মৃতি আপনাকে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে এক রকম ধারণা দিতে পারে।
কিন্তু যদি আপনার ঘন ঘন “দেজা ভ্যু” হতে থাকে তবে সেক্ষেত্রে আপনাকে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
অনেক সময় পরিচিত কাউকে বা কোন জিনিসকে দেখে আমাদের এক ধরনের অদ্ভুত অনুভূতি হয়, মনে হয় এই মানুষটি কিংবা এই জিনিসটা আমাদের একদম অচেনা। যখন চিরচেনা কাউকে মনে হবে অচেনা তখন তাকে “জামাইস ভ্যু” বলে।
“জামাইস ভ্যু” মূলত “দেজা ভ্যু” এর বিপরীত শব্দ। এটি “দেজা ভ্যু” অভিজ্ঞতার বিপরীত ধরনের অভিজ্ঞতা। অর্থাৎ কোন পরিচিত ঘটনা যখন আপনার কাছে অপরিচিত মনে হবে সেটাই “জামাইস ভ্যু”। যদিও তুলনামূলক ভাবে খুব কম মানুষের “জামাইস ভ্যু” অভিজ্ঞতা হয়।
বিজ্ঞানীদের ধারণা আমাদের মস্তিষ্কে এক ধরনের “ব্যাক-আপ” সার্কিট আছে। তাদের মতে, আমাদের মস্তিষ্কে দ্বিতীয় এক ধরনের ব্যাবস্থা সক্রিয় থাকে, যেটি আসলে আমাদের “টেমপোরাল লোব” এ কি ঘটে চলেছে তার উপর নজর রাখে। এটা বর্ননা করা হয় “এক ধরনের তথ্য যাচাই ব্যবস্থা “হিসাবে।
“দেজা ভ্যু” কিংবা “জামাইস ভ্যু” অভিজ্ঞতার পর যখন আমাদের মস্তিষ্ক এক ধরনের বিভ্রান্তিতে ভোগে, ঠিক তখনই এই অংশটা আমাদের সেই বিভ্রান্তি থেকে বাস্তব জগতে ফিরে আসতে সাহায্য করে। ফলে আমরা আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারি।
ছবিঃ সংগৃহীত
তথ্যসূত্রঃ উইকিপিডিয়া, বিবিসি, বোল্ডস্কাই নিউস
মন্তব্য লিখুন