সূর্যোদয়ের সাথে সাথে সবার ঘরে নিভে যায় ফিলামেন্ট বাতি। বন্ধ হয়ে যায় বৈদ্যুতিক পাখা। সকালের নিস্তব্ধতা আর যান্ত্রিক নিঃশব্দতা উভয়ে যুক্ত হয়ে সৃষ্টি করে মন খারাপ করা এক নীরবতা। এই ভূতুরে নিঃশব্দতা কেন যেন মন খারাপ করে দেয় শহরের বাসিন্দাদের। শহরের প্রাণকেন্দ্র টাউনহলের উপরে উচ্চ কম্পাঙ্কের “নেটওয়ার্ক টাওয়ার” স্থাপনের পর তেজস্ক্রিয়তার প্রভাবে পাখিরা এই এলাকায় আর উড়ে বেড়ায় না। ফলে, পাখির কিচিরমিচিরও আর শুনতে পাওয়া যায়না। নিঃশব্দ এই জাদুর শহর এর বাসিন্দাদের কেউ কেউ মুখে মিথ্যা হাসির রেখা টেনে ভারাক্রান্ত মনে শুরু করে তাদের কর্মচঞ্চলতা। শহরে বিদ্যুৎ স্বল্পতার এই ভয়াবহ পরিস্থিতির মাঝেও কেউ আবার বেশ ফুরফুরা মেজাজে, সত্যিকারের হাসির রেখা মুখে টেনেই শুরু করে তাদের কর্মদিবস।
মজার ব্যপার হচ্ছে, এই শহরে কখনোই কিন্তু দুঃখের স্থান ছিলোনা। দুঃখ ব্যপারটার সাথে তারা পরিচিত ছিলোনা একদমই। চাঁদের আলোর প্রাচুর্যের পরও শহর জুড়ে সারা রাত শৌখিন নিয়ন বাতি জ্বালিয়ে রাখায় জনগণ ভালোবেসে শহরটার নাম দিয়েছিলো “নিয়ন সিটি”।
আগেকার সময়ে যেমন পৃথিবী ছোট বড় অনেকগুলো দেশ আকারে ভাগ ছিল, এখন আর তা নেই। এখন সমস্ত পৃথিবী সম্মিলিতভাবে শাসন করে তিনটি পরাশক্তি। পুরা পৃথিবী এখন তিনটি পরাশক্তি বলয়ের মানচিত্রে চিত্রায়িত করা। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা এখন সমগ্র পৃথিবীব্যপী জনপ্রিয়।বর্তমান পৃথিবীর সকল শহরের প্রধান হলো সিটি মেয়র এবং সিটি মেয়রই শহরের আইন প্রণেতা ও সর্বোচ্চ ক্ষমতাশালী ব্যক্তি।
নিয়ন সিটির বুকে প্রথম থেকেই বসবাস করতো একদল হাসি-খুশি ও অলস শ্রেণির মানুষ। তাঁদের মধ্যে কর্মব্যস্ততার উদ্বেগ ছিলোনা, ছিলোনা পরিশ্রম করার কোনো প্রয়োজনীয়তা। পৃথিবীব্যপী খনিজ সম্পদের স্বল্পতার পরও তাদের ছিল মূল্যবান জিরকন নামক খনিজ সম্পদ। পরিশোধিত জিরকন বিক্রি করে প্রচুর সম্পদের মালিক হয় শহরটির জনগণ। তারা সুখে শান্তিতে তাদের দিন অতিবাহিত করছিলো।
যেহেতু এই শহরের জনগণ বেশ স্বচ্ছল ছিল, তাই পৃথিবীর অন্য সকল শহর থেকে তারা প্রযুক্তিগত দিক থেকে বেশ এগিয়ে ছিল। নিজেদের স্বার্থে প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার করার চেষ্টা করতো এবং তারা বিশ্বাস করতো প্রযুক্তির ব্যবহার থেকে দূরে থাকলে তাদের শহর যোজন যোজন পিছিয়ে পড়বে। কিন্তু, তারা কি জানতো এই প্রযুক্তিই তাদের জন্য শেষ পর্যন্ত কাল হয়ে দাঁড়াবে ?
একদিন হঠাৎ তাদের শহরের মেয়র পরিবর্তন হলো। নতুন মেয়র এসে ঘোষণা দিলো, “সবাইকে কাজ করতে হবে। প্রতিদিন ন্যূনতম ৬ ঘন্টা করে কাজ করতে হবে।” কিন্তু, এত সুখী হওয়ার পরেও, সম্পদের প্রাচুর্যের পরেও কাজ করার আবশ্যকতা কোথায়? মেয়র বুঝিয়ে বললো সবাইকে – “কাজ না করাতে আমাদের সবার শারীরিক সমস্যা শুরু হয়েছে এবং বার্ধক্য দ্রুত ঘনিয়ে আসছে। তাই পরিশ্রম করতে হবে সবাইকে।” মেয়রের এই আদেশ শুনে অলস নাগরিকরা চিন্তায় পড়ে গেলো।
নিয়মিত বিরক্তিকর ছকবাধা কাজ করার ফলে কিছুদিন যেতেই হঠাৎ দেখা গেলো নিয়ন সিটির সব মানুষের হাসি খুশি থাকার অভ্যাসটা চলে গিয়েছে। তাদের ভিতর কাজ করার ব্যপারে অনীহা দেখা দিচ্ছে এবং তারা সম্পূর্ণ নতুন অনুভূতির সাথে পরিচিত হলো যেটাকে তারা “দুঃখ” বলে অভিহিত করে। জন্মের পর থেকে সুখে থাকা জনগণকে এই দুঃখ শেষ করে দিতে লাগলো।
হঠাৎ একদিন তাদের মহামূল্যবান খনিজ সম্পদ জিরকনের মজুদ শেষ হয়ে গেলো। রাতারাতি পৃথিবীব্যপী বিস্তৃত এত বড় ব্যবসা বন্ধ হওয়াতে এবং অভ্যাসগতভাবে শহরের প্রত্যেকটি নাগরিকের শৌখিনতার চর্চা অব্যাহত থাকায় খুব দ্রুতই তাদের শহরে ধনী ব্যক্তির সংখ্যা কমতে থাকলো। শহরের অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়লো এবং জীবনমান নিম্নগামী হতে শুরু করলো।
নিয়ন সিটির এরকম দুর্বিষহ সময়ে পৃথিবীব্যপী রপ্তানীযোগ্য খাদ্যের দাম বেড়ে যাওয়াতে আমদানী করে শহরে খাদ্য আনা বন্ধ হয়ে গেলো। খাদ্য সংরক্ষণের ফুড স্টেশনগুলো ধীরে ধীরে শূন্য হতে লাগলো এবং অন্য শহরের পাওয়ার স্টেশন থেকে সংগ্রহ করা উচ্চ দামের বিদ্যুৎ ক্রয় করাও দুঃসাধ্য হয়ে পড়লো শহরবাসীর জন্য। সম্মিলিত ফুড স্টেশনের সিকিউরটি চীফ এলা বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লো। সে মোটেই ধনী মানুষ নয় এবং চাকরিটাই তার শৌখিনতার শেষ সম্বল। চাকরিটা চলে গেলে কি হবে তার? ভবিষ্যতের সংকটের কথা ভেবে নাগরিকদের সবাই প্রতিদিন একটু একটু করে দুঃখী মানুষ হয়ে উঠতে লাগলো।
শহরের এই দুর্বিষহ সময়ে নতুন আরেকজন মেয়র নির্বাচিত হলো। সে আত্মবিশ্বাসের সাথে টাউনহলের প্রথম মিটিং এ প্রবেশ করলো। মিটিং এ সে সবাইকে বুঝিয়ে বললো সব সমস্যার মূলে এই ৬ ঘন্টা কাজ করার ব্যপারটা। সে ৬ ঘন্টা কাজ বন্ধ রাখতে বললো এবং “দৈবভাবে যাবতীয় সমস্যার সমাধান হবে” এই ব্যপারে দৃঢ় বিশ্বাস জ্ঞাপন করলো।
নতুন মেয়র নাগরিকদের অর্থ কষ্ট দূর করার আগে দুঃখ দূর করার ব্যপারে মনোনিবেশ করলো। এজন্য নতুন একটা প্রযুক্তি নিয়ে আসলো মেয়র। পৃথিবীর সেরা প্রযুক্তিবিদদের এনে বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করে নতুন প্রযুক্তিটি তৈরী করা হলো। প্রযুক্তিটির নাম দেওয়া হলো “ফেইস-মিরর”। বিগত দুই শতক আগে পৃথিবীতে “ফেইসবুক” নামের একটা প্রযুক্তি চালু ছিল এবং সেই প্রযুক্তিতে সেই সময়ের ব্যবহারকারীদের কার্যকলাপের উপর ভিত্তি করেই ফেইস-মিরর প্রযুক্তিটি তৈরী করা হয়েছে। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে সবাই সবার সুখী মূহুর্ত অন্য সবাইকে দেখার সুযোগ করে দিবে এবং কখনো চাইলেও এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে কোনো দুঃখ সংক্রান্ত ব্যপার অন্যদের সাথে ভাগ করতে পারবেনা কেউ। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে সবার সুখী জীবন দেখে সবাই ভাববে “এই শহর শুধুমাত্র সুখের শহর। দুঃখ এখানে অবচেতন মনের কল্পনা মাত্র।”।
এই প্রযুক্তির ব্যপারে মেয়র বেশ আশাবাদী হলেও এটি ব্যবহার করার ব্যপারে ফুড স্টেশনের সিকিউরিটি চীফ এলাকে খুব একটা আগ্রহী দেখা গেলোনা। তবুও সে শহরের সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রযুক্তি সরবরহাকারী প্রতিষ্ঠান “হ্যাপি নিয়ন টেকনোলজি” থেকে প্রযুক্তিটির এক বছরের পরিসেবা কিনে নিলো।
মেয়রের আহব্বানে অবিশ্বাস্যভাবে সবাই এই প্রযুক্তি ব্যবহার করতে শুরু করলো। এই প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে মেয়ররের ভবিষ্যদ্বানী মোটেই সত্য প্রমাণিত হলোনা। তার ভবিষ্যদ্বানীকে মিথ্যা করে দিয়ে সবাই বরং হিংসুটে হয়ে উঠলো। একজনের সুখ দেখে আরেকজন হতাশাগ্রম্ত হয়ে পড়লো। অনেকে আবার নিজেকে সুখী প্রমাণ করতে মিথ্যা সুখের মূহুর্তগুলো সবাইকে প্রদর্শন করতে থাকলো।এতে করে নিজেদের মধ্যে ভয়ানক অবসাদ ভর করতে থাকলো। ফলশ্রুতিতে শহরের নাগরিকদের বড় একটা অংশ “হ্যাপি নিয়ন টেকনোলজি” থেকে মিষ্টি গন্ধযুক্ত বিষাক্ত গ্যাস কিনে এনে বদ্ধ ঘরে বিষাক্ত গ্যাস ছড়িয়ে দিয়ে নিজেকে যন্ত্রণাহীন মৃত্যুর মাধ্যমে নিশ্চিহ্ন করে দিলো।
ফেইস-মিরর প্রযুক্তিটির এক বছরের পরিসেবা শেষ হলে এলা আর পরিসেবাটি নবায়ন করাতে যায়না। অন্যের সুখ দেখে মিথ্যা সুখী থাকার চর্চা আর ভালো লাগছেনা তার। এবার একটু মুক্তি চায় সে।
দৌঁড়ে মেয়রের বাসায় চলে আসে এলা। বন্ধ করতে বলে এই প্রহসনের ফেস-মিরর প্রযুক্তি। এই প্রহসনের প্রযুক্তির জন্য শহরের অনেকে ইতোমধ্যে তাদের ছেড়ে চলে গিয়েছে বিষাক্ত গ্যাস ব্যবহার করে। আর নয় প্রহসনের এই প্রযুক্তি।
মেয়র তার সব কথা শুনে সম্মত হলো এবং শহরের ভিতর এই প্রযুক্তি ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা জারি করলো। সেই সাথে এলার পরামর্শে সবাইকে পুনরায় কাজে ফিরতে বললো। ৬ ঘন্টার বদলে আরও বেশি সময় কাজ করার ব্যপারে সবাইকে বাধ্য করা হলো এবং মানসিক প্রশান্তির জন্য সপ্তাহে ১ দিন প্রমোদ উৎসবের আয়োজন করা হলো। শহরের অর্থ,খাদ্য,বিদ্যুৎের অভাব, তার সাথে নাগরিকদের বিষাদগ্রস্ততা – সব মিলিয়ে নিয়ন সিটির অবস্থা ভয়াবহ হয়ে উঠলো।
সৃষ্টির আদিকাল থেকে মানুষের নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি বরাবরের মতই বেশি আকর্ষণ থাকে। হ্যাপি নিয়ন টেকনোলজি তাই বিশেষ পরিসেবার মাধ্যমে গোপনে তাদের ফেইস-মিরর প্রযুক্তিটি চালু রাখলো এই শহরে। কয়েকজন নাগরিক এই সেবা গ্রহণ বন্ধ রাখতে পারলো না।
ততোদিনে ফেইস-মিরর গঠনে সহায়তা করা প্রযুক্তিবিদদের সাহায্যে বাইরের শহর গুলোতেও বেশ বিস্তার লাভ করলো প্রযুক্তিটি। তারা নিয়মিত অন্য শহরের জীবনযাত্রা দেখতে লাগলো, পরিচিত হতে লাগলো শহরগুলোর শুধুমাত্র সুখী দিকগুলোর সাথে। তাদের নিয়ন সিটি আর সুখী শহর নয় – ব্যপারটি তারা আক্ষরিক অর্থেই অনুভব করতে লাগলো। ফলশ্রুতিতে, তারা জীবিত থেকেও মৃতের মত হয়ে দিন কাটাতে লাগলো।
মেয়রের ডাকে সারা দিয়ে এলার মত আরও অনেক নাগরিক ফেইস-মিরর ব্যবহার থেকে দূরে সরে আসার পর এখন তুলনামূলক ভালোভাবে জীবন যাপন করছে। তারা নিয়মিত কাজ করছে এবং সাপ্তাহিক প্রমোদ উৎসবে অংশগ্রহণ করে সুখী দিন অতিবাহন করছে। তাদের জীবনে দুঃখ সুখ দুইটাই আছে এবং তারা বিশ্বাস করে সুখের সাথে দুঃখের উপস্থিতি একান্তই আবশ্যক। নতুবা সুখ অনুভব করা যায়না, সুখের পূর্ণ তৃপ্তি লাভ করা যায়না।
হঠাৎ জাদুর মতই এই শহরে এখন দুই শ্রেণির মানুষের আবির্ভাব হয়েছে। এক শ্রেণির মানুষ কাজ শেষে বাড়ি ফিরে ক্লান্ত শরীর নিয়ে গোপনে সংযোগ নেওয়া ফেইস-মিরর পরিসেবা চালু করে শুধু অন্যের সুখের চিত্র দেখে নিজেকে সুখী ভাবার বদলে আফসোস করে দিন কাটাতে থাকে। আরেক শ্রেণির মানুষ এলার মত ফেইস-মিরর বর্জন করে কাজ শেষে বাড়ি ফিরে প্রশান্তির ঘুম দেয় এবং সাপ্তাহিক প্রমোদ উৎসবের জন্য অপেক্ষার প্রহর গুণতে থাকে।
শহরের মানুষগুলোর এই সামান্য এক প্রযুক্তির দ্বারা অসামান্য পরিবর্তনকে সবাই এক প্রকারের জাদু বলে সম্বোধন করে। তাই, লোকমুখে নিয়ন সিটির নাম হয়ে গিয়েছে এখন “জাদুর শহর”। জাদুর এই শহর এ এক দল নির্বোধ মানুষ এখনো দুঃখকে আলিঙ্গন করতে প্রস্তুত নয়। তারা তাদের দুঃখকে গোপন করে সুখ অনুভব করতে চায়, অন্যের সুখে নিজের সুখ খুঁজে ফিরে তাদের মত করে নিজেকে সুখী করতে চায়। দিনশেষে নিষ্প্রাণ মুখে মিথ্যা হাসির রেখা টেনে প্রাত্যহিক কাজে যোগ দিতে হয় নির্বোধ এই মানুষগুলোকে।
মন্তব্য লিখুন