শুধু যে করোনা মহামারীতেই একমাত্র মানুষ সামাজিক দূরত্ব মেনে চলেছে তা কিন্তু নয়, বহুকাল আগে থেকে বিভিন্ন প্রজাতির জীব সামাজিক দূরত্ব মেনে চলে আসছে। করোনার জো ধরেই আমরা সামাজিক দূরত্ব মানতে বাধ্য হচ্ছি , সুপরিচিত হয়েছি সামাজিক দূরত্বের সাথে। কিন্তু প্রকৃতিতে সামাজিক দূরত্ব খুবই স্বাভাবিক একটি বিষয় । আসলে স্বজাতীয়দের মধ্যে রোগ যাতে না ছড়ায় তার জন্যই প্রাণীদের এই ব্যবস্থা ।
কিছু কিছু প্রজাতির বাদুর , বানর , গালদা চিংড়ি , মাছ থেকে শুরু করে পিঁপড়া , মৌমাছি এমনকি গাছের পাতার মধ্যেও সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার মতো অদ্ভুত ঘটনা দেখা যায় । বিবর্তন ও পরিবেশের সাথে টিকে থাকার দক্ষতাই এইসব প্রানীদের মধ্যে এমন স্বভাবের জন্ম দিয়েছে।
আর্টিকেলে যা থাকছেঃ
বাদুড় দলবদ্ধ হয়ে থাকতে পছন্দ করে । কিছু প্রজাতির বাদুর যেমন ভাম্পায়ার ব্যাট সোশাল ডিসট্যান্স মেনে চলে যখন তারা অসুস্থ হয় ।
সাধারনত বাদুড়েরা রোগ বহন করার জন্য খ্যাত । এরা নিজেরা রোগাক্রান্ত না হয়েই রোগ বহন ও ছড়াতে পারে । যদি রোগাক্রান্ত হয় তবে এদের অন্য পদ্ধতি আছে এর থেকে বেঁচে থাকার জন্য ।
তাদের কলোনিতে কোন রকম সংক্রমন দেখা যায় তখনি তারা আলাদা হয়ে থাকতে শুরু করে । সংক্রমিত বাদুড় নিজেকে অন্যদের থেকে আলাদা করে রাখে । যখন অসুস্থ হয় তখন অন্যদের সাথে যোগাযোগ, মেলামেশা বন্ধ করে দেয় ।
এমন আচারন যে বিবর্তনের ফলেই তাদের মধ্যে তৈরি হয়েছে সেটি উপলব্ধি করা যায়। এই নিয়ে আরও গবেষণা প্রয়োজন । তবে এটা সত্যি যে কিছু সংক্রামক ব্যাধি, ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, ফাঙ্গাস, পরজীবী বাদুড়দের মধ্যে সামাজিক দূরত্বের কারন ।
ছবিটি তুলেছেন M Yoyo; এই প্রজাতির বাদুড়কে গোস্ট ব্যাট বলে ডাকা হয় ;
ক্যারাবীয়ান গলদা চিংড়ির মধ্যে সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার বিষয়টি লক্ষ্য করা যায়। সমুদ্রের তলদেশে প্রবালে, কিংবা পাথরের ফাটলে সাধারনত এরা দল বেঁধে থাকে।
দল বেঁধে থাকার জন্য এরা খাদ্য (সামুদ্রিক শামুক), নিরাপত্তা, শিকার, বংশবিস্তার এবং টাইগার ফিশ থেকে বেঁচে থাকার মতো সুবিধা পেয়ে থাকে। Panulirus Argus virus 1 নামক এক ভাইরাস দ্বারা এই কাটায়ালা প্রানিগুলো আক্রান্ত হয়। কিন্তু এরা ভাইরাসকে তাদের মুত্রে এক ধরনের কেমিক্যাল থেকে আক্রান্তদের সনাক্ত করতে পারে ।
যদিও এরা দলবেঁধে থাকে তবুও আক্রন্তদের থেকে যাতে ভাইরাস না ছড়ায় সে জন্য বিভক্ত হয়ে যায় । বেশির ভাগ গলদা চিংড়ি যাদের একা থাকতে দেখা গেছে তারা হয় কোন না কোন সংক্রামক রোগে আক্রন্ত । এতে শিকারি প্রানীদের হাতে মারা পড়ার ঝুকি থাকলেও তারা তা গ্রহন করে ।
চিত্রঃ ক্যারাবীয়ান গলদা চিংড়ি । Source: Wikipedia.com
আমরা সবাই জানি পিঁপড়াদের মধ্যে এক অভাবনীয় সামাজিক দৃষ্টান্ত দেখা যায় । তারা সব সময় কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে । প্রচণ্ড শক্তিশালী (এদের আকারের তুলনায়) ও অক্লান্ত পরিশ্রমী এই প্রাণীরা কাজ নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয় । এ
দের মধ্যে থাকে রানী, প্রজা, সৈন্য, কর্মী । খাদ্য সংগ্রহকারী পিঁপড়ারা যেহেতু প্রাই কলোনির বাইরে অবস্থান করে তাই তাদের মধ্যে অসাবধানবসত বিভিন্ন রোগের সংক্রমণ দেখা যায়।
গার্ডেন অ্যান্ট Metarhizium brunneum নামক এক প্রাণঘাতী ফাঙ্গাস দ্বারা আক্রান্ত হয় । এই ফাঙ্গাসের স্পোর বা বীজ শারীরিক স্পর্শে ছড়ায় । সংক্রমণ ছড়ানোর আগে ২ দিন এই স্পোর তাদের গায়ে অবস্থান করে । ২ দিন পরে এই স্পোর তাদের শরীরে প্রবেশ করে অসুস্থতার লক্ষণ প্রকাশ করে । কিন্তু পিঁপড়েরা এর প্রতিরোধের জন্য কি ব্যবস্থা নেয়?
ফাঙ্গাসের স্পোর শনাক্তের ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই পিঁপড়াদের মধ্যে সামাজিক আচার আচারনের পরিবর্তন ঘটে এবং এটা ঘটে ফাঙ্গাসের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে লক্ষণ প্রকাশের আগেই। কলোনির সবল এবং সুস্থ পিঁপড়ারা কঠোর ভাবে অসুস্থ ও সংক্রমিত পিঁপড়াদের সাথে সামাজিক যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়।
এমনকি যেসব পিঁপড়া খাদ্য সন্ধানে বাইরে অবস্থান করে তারা কলোনি থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখে । কলোনির মধ্যে অবস্থানরত নবজাতকদের আরো ভিতরে নিয়ে যাওয়া হয় । এভাবেই তারা সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে সংক্রমণ রোধ করে এবং অবশেষে তাদের কলোনি বেঁচে যায় ।
চিত্রঃ গার্ডেন অ্যান্ট । Source: scientificamerican.com
কিছু প্রাণীর সংক্রমণ মোকাবেলার পদ্ধতি একটু ভিন্ন । যেমন ফিঞ্চ বার্ড , তারা তাদের ইমিউন সিস্টেম দ্বারা পরিচালিত হয় । তাদের সংক্রমণ প্রতিরোধ ক্ষমতার উপর নির্ভর করে আক্রান্তদের সাথে সামাজিক যোগাযোগে অংশ নেয় ।
যে সব ফিঞ্চ পাখিদের ইমিউনিটি দুর্বল তারা কঠোর ভাবে রোগাক্রান্ত পাখিদের থেকে দূরে থাকে । যেসব পাখিদের প্রয়োজনীয় অ্যান্টিবডি এবং অন্যান্য প্রোটিন থাকে সংক্রমণ মোকাবেলা করার জন্য সে সব পাখিদের আক্রান্তদের সাথে সামাজিক মেলামেশা করতে দেখা যায়।
চিত্রঃ ফিঞ্চ বার্ড ; Source: Sciencetificamerican.com
রঙ বেরঙের লেজ ওয়ালা এই গুপি ফিশদের মধ্যেও এই ধরনের সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার প্রবনতা দেখা যায়। তারা Gyrodactylus turnbulli নামক একধরনের কৃমি দ্বারা আক্রান্ত হয় ।
এদের পরীক্ষার উদ্দেশ্যে কিছু মাছ সংক্রমিত মাছেদের সাথে একই পানির ট্যাঙ্কে ছেরে দেয়া হয়। বেশিরভাগ মাছগুলোকে একসাথে থাকতে দেখা যায় যেমনটা সামাজিক প্রাণীরা করে থাকে ।
কিন্তু কিছু পুরুষ গুপি ফিশ তাদের থেকে দূরত্ব বজায় রাখে । পরে এর কারন হিসেবে জানা যায় সংক্রমন থেকে বেঁচে থাকার জন্যই কিছু গুপি ফিশ এইরুপ আচারন প্রদর্শন করে ।
চিত্রঃ গুপি ফিশ । Source: Wikipedia.com
মুখে নানান রঙের আঁকিবুঁকি আঁকা এই বানরবিশেষ প্রাণীটি ম্যান্ড্রিলস নামে পরিচিত । এরা খুবই সামাজিক প্রানী । আফ্রিকার রেইন ফরেস্টে এরা শত শত আঁকারে একসাথে থাকতে দেখা যায় ।
সামাজিক সম্পর্কের মাধ্যমেই এরা একত্রে থাকে এবং অভিজ্ঞ বয়স্ক ম্যান্ড্রিলস থেকে অপেক্ষাক্রিত কম বয়স্করা শিক্ষা লাভ করে থাকে । এরা একধরনের অন্ত্রের পরজীবী দ্বারা আক্রান্ত হয় এবং সুস্থ ম্যান্ড্রিলসরা আক্রান্তদের এরিয়ে চলে । তারা গন্ধের সাহায্যে অন্ত্রের পরজীবী আক্রান্তদের সনাক্ত করে ।
চিত্রঃ ক্রাউন শাইনেস ; Source: Wikipedia.com; ম্যান্ড্রিলস; Source: Clickasnap
ক্রাউন শাইনেস হল গাছের এমন একটি বৈশিষ্ট্য যেখানে গাছের প্রতিটি ব্রাঞ্চের পাতা একে অপরকে স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকে । প্রতিটি ব্রাঞ্চের ফাঁকা জায়গা কে শাইনেস গ্যাপ বলা হয় ।
শাইনেস গ্যাপ সাধারণত ১০ থেকে ৫০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে । দেখতে অদ্ভুত হলেও গাছের পাতার এইরকম প্রদর্শনের কারন জানা যায় নি । কিছু কিছু প্রজাতির গাছের শিকড়েও এই রকম ঘটনা ঘটতে দেখা যায় ।
তবে বিজ্ঞানীরা মনে করছেন গাছের এক ডাল থেকে অন্য ডালে পরজীবী, পোকা-মাকরের লার্ভা যেগুলো গাছের পাতা খেয়ে নষ্ট করে দেয় সেগুলো যাতে ছড়াতে না পারে তার জন্যই এই ব্যবস্থা ।
আবার অন্য বায়োলজিস্টরা মনে করছেন ফাইটো হরমোনের বায়বীয় আদানপ্রদানের ফলেই ট্রি শাইনেস সৃষ্টি হয় । তবে এগুলো সব হাইপোথিসিসের পর্যায়েই রয়ে গেছে। এখনো এই নিয়ে বিজ্ঞানিরা গবেষণা করছেন ।
ছবিঃ সংগৃহীত
তথ্যসূত্রঃ Quora.com, www.scientificamerican.com
মন্তব্য লিখুন