সারা দেশ জুড়ে চলছিল পৈশাচিক হত্যাকান্ডের বিভিষিকা আর আহাজারি । চারিদিকে ছিল লাশ আর ধোয়া ওঠা বারুদের গন্ধ , মৃতদেহের স্তুপ , জমাট বাধাঁ রক্ত আর ভারী বাতাস । সেই আনিশ্চয়তার দিনগুলোর সাক্ষী ছিল এদেশের সর্বস্তরের জনগন তারমধ্যে ছিলেন আমাদের মা বোনেরাও । আমাদের মুক্তিযুদ্ধে নারীদের অবদান লিখে শেষ করার মত না তারপরেও তাদের নিয়ে লেখালেখি হয়নি তেমন , কেবল দুই লাখ মা বোনের ত্যাগের কথাই উল্লেখ করা হয় কিন্তু ভেতরের অবদান তেমন তলিয়ে দেখা হয় না ।
১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ পাকিস্তানী বাহিনীর বর্বরাতায় ছিন্নবিছিন্ন শহরগুলি যখন ভয়ে জড়োসড়ো । তখনও এদেশের প্রতিবাদী জনগন রাস্তায় নেমেছে মৃত্যুভয় পিছনে ফেলে । পাক সেনারা চষে বেড়িয়েছে গ্রাম থেকে গ্রামান্তর আর বুলেট ছুড়েছে অবিরত ।
সে সময়ে অত্যাচারিত , লাঞ্চিত ,ধর্ষিত হয়েছ অগনিত নারী , কেবল এই কথাটুকুই বাববার প্রতিফলিত হচ্ছে বিভিন্ন গল্পে , প্রবন্ধে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে নারীদের অবদান বা অংশগ্রহন এখানেই কি শেষ ?
রনাঙ্গনে দাঁড়িয়ে থেকে তেমন ভাবে যুদ্ধ না করলেও রনাঙ্গনে জীবন হাতে নিয়ে যুদ্ধ করার সাহস জুগিয়েছে যারা তাদের কথা অস্বীকার করার উপায় নেই ।
১৯৭১ এর যুদ্ধের সময় নারীরা যে শক্তির প্রতিচ্ছবি দেখিয়েছে তা হলো সাহস ও দেশপ্রেম । মুক্তিযুদ্ধে নারীদের অবদান কোন মতেই ছোট করে দেখার কোন সুযোগ নেই।
একজন মা তার ছেলেকে পাঠিয়েছেন দেশের জন্য জীবন বিসর্জন দেয়ার ব্রতে , একজন স্ত্রী তার স্বামীকে অনিশ্চয়তার মধ্যে ছেড়েছেন, একজন বোন তার ভাইয়ের ঘর ছাড়ায় হাসিমুখে বিদায় দিয়েছেন এ সবই দেশপ্রেমের তাগিদে ।
নারীরা মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করেছেন বিভিন্ন ভাবে । একাত্তরের সেই উত্তাল মার্চ। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) দাঁড়িয়ে ঘোষনা দিলেন –
“এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম ”
সেই সময়ের মুক্তির সংগ্রামের ডাকে নারীরাও নিজেদেরকে সংগ্রামী পথিক হিসেবেই এগিয়ে চললেন মুক্তির খোঁজে । এর ফলে ঢাকা , চট্টগ্রাম , বরিশাল , সিলেট , রংপুর প্রতিটি জেলায় জেলায় নারীসমাজের প্রতিবাদী মিটিং মিছিল , বৈঠক হয়েছে ।
পরে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয় এবং নারীরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে সেই যুদ্ধে অংশগ্রহন করে । যুদ্ধের সময় যদিও নারীদের প্রশিক্ষন দেয়া বা নেতৃত্ব দেওয়ারর কোন ব্যাবস্থা করাও হয় নি তাও নারীরা বসে থাকেনি, তাদের দিক দিয়ে তারা সর্বোচ্চ লড়াই করেছে ।
কেবল শহরতলীর নারীরাই না প্রত্যন্ত অঞ্চলের নারীরাও ধর্ম বর্ন নির্বিশেষে যুদ্ধে ভূমিকা রেখেছে । এমনি আদিবাসী নারীরাও অংশগ্রহন করেছে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে ।
নারীর সরাসরি যুদ্ধে যাওয়া নিয়ে দ্বিধার শেষ ছিল না তখন , যেখানেই যুবকরাই যুদ্ধে যাওয়ার জন্য অস্ত্র পাচ্ছিল না হাতে , যোগ্য ট্রেনিং নেয়ার সুযোগ পাচ্ছিল না তখন নারীদের যুদ্ধে যাওয়য়ার ব্যাপারে তেমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়ে ওঠেনি বা সেরকম সুযোগ তৈরি হয় নি ।
যদিও তখন বেশ কিছু নারীকে প্রশিক্ষন দেয়া হয় গোবরা, আসাম , মেঘালয় , ত্রিপুরা ক্যাম্পে। সেখানে নারীদের কিছু বিশেষ বিশেষ কিছু বিষয়ে প্রশিক্ষন দেয়া হত যেমন – নার্সিং , অস্ত্র চালনা , সিভিল ন্ডিফেন্স , সেলফ ডিফেন্স ইত্যাদি ।
অনেক নারীই ছিলেন যারা মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস জুগিয়েছেন, প্রেরনা জুগিয়েছেন, তাদের খাবারের ব্যাবস্থা করেছেন, ক্যাম্পে ক্যাম্পে খাবার সরবরাহ করেছেন, সেবা – শুশ্রষা করেছেন ।
কখনও বা মায়ের মত কখনও বা বোনের মত বারবার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন, নিজে না খেয়ে ক্ষুধার্ত যোদ্ধার খাবারের ব্যাবস্থা করেছেন । এছাড়া অনেক নারীরা নিজেদের কাছে অস্ত্রশস্ত্র লুকিয়ে রাখতেন ।
মুক্তিযুদ্ধে বেশ কয়েকজন নারী সরাসরি অংশগ্রহন করেছেন তার মধ্যে “তারামন বিবি” অন্যতম । তখন ১১ নং সেক্টরে মুহিব হাবিলদার নামের একজন মুক্তিযোদ্ধা তারামন বিবিকে ধর্মমেয়ে বানিয়ে মূলত ক্যাম্পের রান্নার কাজে নিযুক্ত করেন ।
তারামন বিবি তখন মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রশস্ত্রও পরিষ্কার করতেন । মাঝে মাঝে সময় পেলে অস্ত্র চালনাও শিখতেন তিনি । কিন্তু অনেক ছোট থাকার কারনে রাইফেল চালাতে পারতেন না । একদিন হঠাত করে পাকিস্থানী সেনাবাহিনীর একটি গানবোট এগিয়ে আসে তাদের ক্যাম্পের দিকে ।
সেই খবর পেয়ে নিজের সহযোদ্ধাদের সাথে তারামন বিবি নিজেও অস্ত্র হাতে বেরিয়ে পরে শত্রু রুখতে । যুদ্ধ শেষে ঘরে ফেরেন তারামন বেগম । দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৩ সালে তৎকালীন সরকার তারামন বিবিকে “বীর প্রতীক” উপাধিতে ভূষিত করা হয় ।
আরও পড়ুনঃ একটি আত্মহত্যা ও কয়েকটি জীবনের যবনিকাপাত
মুক্তিযুদ্ধের আরেকজন সাহসী বীরাঙ্গনা কাঁকন বিবি । মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন তিনি মূলত একজন গুপ্তচর হিসেবে কাজ করতেন। তিনি ছিলেন ৫নং সেক্টরে । তিনি অনেকবার অনেকরকম ভাবে ছদ্মবেশ নেন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করেন বিভিন্নভাবে।
এই গুপ্তচরবৃত্তি করার সময় তিনি নানা ভাবে অত্যাচারিত হয়েছেন । তিনি প্রায় ২০ টির মত সম্মুখ যুদ্ধেও অংশগ্রহন করেন । টেংরাটিলায় পাকিস্থানী ঘাতক বাহিনীর সাথে সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেয়ার সময় কয়েকটি গুলিও বিদ্ধ হয় তার শরীরে ।
১৯৯৬ সালের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী কাঁকন বিবিকে “বীর প্রতীক” উপাধিতে ভূষিত করেন কিন্তু দুঃখের বিষয় আজও তা গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়নি ।
মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়া আরেক নারী হলেন বরিশালের “করুনা বেগম” । চোখের সামনে স্বামী শহিদুল হাসান চুন্নুকে হত্যা করতে দেখে তিনি নিজেও মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেন ।
তিনি মূলত পুরুষের ছদ্মবেশে থাকতেন যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে । তিনি ছেলেদের মতই প্যান্ট , শার্ট পরিধান করতেন এবং মাথায় কাপড় বেধেঁ রাখতেন ।
এরপরে প্রশিক্ষণ নিয়ে নিয়ে বিভিন্ন ভাবে যুদ্ধে অংশ নেন । গ্রেনেড ছোড়া থেকে শুরু করে হানাদার বাহিনীর সাথে সম্মুখ যুদ্ধ করা সব রকম কাজই তিনি সাহসী মনোবল নিয়ে করেছেন। তিনি অনেকগুলো অপারেশন সাফল্যের সাথে জয় করেছেন।
তার সর্বশেষ কাজ ছিল গৌরনদীর মাহিলারা ব্রিজের নিচে পাকিস্তানী ক্যাম্পে হামলা । সেদিন তার পায়ে গুলি লাগে, তারপরেই তার সহযোদ্ধারা জানতে পারে তার আসল পরিচয় ।
তাকে বাঁচানোর জন্য তার গুলিবিদ্ধ পা টি কেটে ফেলা হয়েছিল । পরে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরন করেন করূনা বেগম ।
লুৎফুন নাহার হেলেন মুক্তিযুদ্ধের আরেকজন বীর মুক্তিযোদ্ধা । তিনি ছিলেন মাগুরা ছাত্র ইউনিয়নের একজন নেত্রী এবং মাগুরা জেলার বামপন্থি একজন নেতা মাহমুদুল হকের বোন। তার স্বামীও ছিলেন একজন মুক্তিযদ্ধা । তখন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন ভাবে সহয়তা করতেন ।
পাক বাহিনীর অবস্থান, কার্যকলাপ, গতিবিধির খবর দিতেন নিজের স্বামীর কাছে । নিজের শিশুপুত্রের কথা পর্যন্ত না ভেবেও তিনি কাজ করেছেন দেশ মাত্রিকাকে মুক্ত করার লক্ষে্য ।
পরে তাকে মাগুরা জেলার মোহাম্মদপুর উপজেলা থেকে তুলে আনা হয় তার শিশুপুত্র সহ । তার উপর নানা রকম শারিরীক অত্যাচার করা হয় এবং এক পর্যায়ে তাকে নৃশংস ভাবে হত্যা করা হয় ।
এরকম আরো অনেকেই আছেন তাদের মধ্যে সিতারা বেগম, নিবেদিতা দাশ, গীতা কর, রওশন আরা, শিরিন বানু মিতিল, আশালতা, মনিকা মতিন , শাহানা পারভীন উল্লেখযোগ্য । কিছু নারী প্রতিবাদী কবিতা , গান , গল্প লিখেছেন যুদ্ধ চলাকালীন সময় ।
এছাড়াও তখন বেতার কেন্দ্রে শিল্পী হিসেবে কাজ করেছেন অনেক নারী । শহীদ জননী জাহানারা ইমাম , সাফিয়া বেগম (শহীদ আজাদের মা) এদের মত মায়েরা অনুপ্রেরনা দিয়েছেন , সাহস দিয়েছেন ।
আমাদের স্বাধীনতা ছিল গণযুদ্ধ , নারী পুরুষ সর্বজনের অংশগ্রহনের ফলে এসেছে স্বাধীনতা । নারী তার নিজের সম্ভ্রম ও সাহসের বিনিময়ে লড়েছে দেশমুক্তির জন্য । কিন্তু নারীর এই আত্মত্যাগ তত বেশি গুরুত্বের সাথে দেখা হয়নি কখনো , তাদের যথাযথ মূল্যায়ন ও করা হয়নি ।
যদিও এখন মুক্তিযুদ্ধে নারীদের অবদান নিয়ে বেশ লেখালেখি হয় । আমাদের উচিত সকল বিরাঙ্গনাদের উপর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করা কারন। তাদের সাহসীকতা , সহযোগীতা আর আত্মত্যাগের ফলেই হয়েছে আমাদের নিজস্ব পরিচয় , আমরা পেয়েছি একটি স্বাধীন দেশ ।
তথ্যবহুল লেখা। অনেক অজানা বিষয় অতি সুললিত ভাবে তুলে ধরা হয়েছে যা নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধ সমন্ধেে জানতে সাহায্য করবে। এরূপ তথ্যবহুল লেখা প্রতিনিয়ত প্রকাশ করা দরকার। লেখিকাকে এরুপ একটি লেখা উপহার দেবার জন্য অজস্র ধন্যবাদ। তার কাছ থেকে আরও গবেষনাধর্মী লেখা আশা করি।
Fine, may be helpful to others. Thanks for the writes you.
Informative and interesting!
Excellent writing, nice read indeed.
অনেক তথ্যবহুল…তোমার লেখা থেকে অনেক ইনফরমেশন কালেক্ট করলাম একটা রচনা লিখব তাই…ধন্যবাদ😊
অনেক হেল্পফুল লেখা। রনাঙ্গনে নারী যোদ্ধাদের নিয়ে লিখা য় এটা আমার অনেক সাহায্যে আসবে আশা করি।
তোমার জন্য শুভকামনা