প্রায় কয়েক সহস্র বছর পূর্বে নীলনদের তীরে গড়ে ওঠে এক সভ্যতা, যার নাম মিশরীয় সভ্যতা। এই জাতির ক্ষমতা প্রধান ছিলেন “ফারাও”রা। এই সভ্যতা যথেষ্ট উন্নতি করেছিল। জ্ঞান বিজ্ঞানে ছিল এদের অনেক দক্ষতা। মৃত্যুরপর ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে প্রাচীন ফারাওদের মধ্যে থেকে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের মমি করে রাখত, যা আধুনিক সময়েও আবিষ্কৃত হচ্ছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো ফারাও তুতেনখেমেনের মমি, যা নিয়ে এখনো নানারকম রহস্যজনক খবর প্রচলিত আছে।
আপনারা যারা রহস্যপ্রিয় এবং প্রাচীন সভ্যতা সম্পর্কে আগ্রহী তারা নিশ্চয়ই মিশরীয় সভ্যতা সম্পর্কে কম বেশি জানেন। মিশর তার বিশাল আকৃতির পিরামিড এবং বহু সহস্রবর্ষ প্রাচীন সভ্যতার জন্য বিশ্বজোড়া বিখ্যাত।
বর্তমান সময়েও এই সভ্যতা নিয়ে বিজ্ঞানীদের আগ্রহের সীমা নেই আর তার মূল কারন হলো এখানে খুঁজে পাওয়া অসংখ্য মমি যা আধুনিক সভ্যতাকে করেছে বিশ্মিত আর খুলে দিয়েছে অতীত সময়কে জানার এক অদৃশ্য দ্বার।
মমি কথাটি এসেছে মূলত লাতিন শব্দ mumia থেকে, যার অর্থ হলো মোম। মোম মমি তৈ্রির একটি প্রধান উপকরন ছিল বলেই হয়তো এই নামকরন।
প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতায় মৃত্যু পরবর্তী জীবনে বিশ্বাস করা হতো এবং সেই কারনেই প্রাচীন ফারাওদের মধ্যে থেকে যারা সমাজের রাজা বা, ক্ষমতাধর ব্যক্তি যেমন, ফারাও, তার পরিবারের সদস্যবৃন্দ এবং গন্যমান্য ব্যক্তিদের মমি করে রাখা হত, যাতে তা বহু কাল ধরে সংরক্ষন করে রাখা যায়।
অনেক পশু পাখির মমিও পাওয়া যায়। ধারণা করা হয় মমিকৃ্ত ব্যক্তিকে পাহারা দেওয়ার জন্যই এই পশুপাখির মমি রাখা হতো মূল মমির সাথে। তবে কোনো সাধারণ মানুষের মমি করার অনুমতি তখন ছিল না।
সেকারনেই এখন যেসব মমি পাওয়া যায় তার সবই প্রাচীন কালের কোনো না কোনো বিশেষ ব্যক্তির, যার সাথে হয়তো জড়িয়ে আছে ইতিহাসের কোনো অজানা অধ্যায়।
মৃতদেহকে মমি করে রাখা কোনো সহজ কাজ নয়। বর্তমানে এই আধুনিক যুগেও সেই প্রায় ৩হাজার বছর আগের (কিছু বিজ্ঞানীর মতে আরো বেশি) প্রাচীন ফারাওদের মমি করণে বিজ্ঞানের ব্যবহার দেখলে সত্যিই বিস্মিত হতে হয়!
মমিকরন ছিল একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়া মূলত ধর্মীয় আচারের সাথে যুক্ত ছিল। মৃতদেহকে প্রথমেই নীলনদের পানি দ্বারা শুদ্ধ ও পবিত্র করা হতো। এরপর শবদেহের তলপেটে বামপাশে ছিদ্র করে সেখান থেকে নাড়িভুরি, পাকস্থলী, যকৃতসহ পচনশীল সব কিছু বের করে ফেলা হতো। এরপর নাক দিয়ে সাঁড়াশি জাতীয় কিছুর মাধ্যমে বিশেষ প্রক্রিয়ায় করোটি থেকে মস্তিষ্ক বের করে আনা হতো।
শুধু হৃদপিন্ড শরীরে রয়ে যেত। তাদের ধারণা ছিল মৃত্যু পরবর্তী জীবনে হৃদপিন্ড প্রয়োজন হয়। এরপর শবদেহ একপ্রকার সুগন্ধী তালের মদ দ্বারা পরিষ্কার করে পেটের ফাকা অংশ ধুপ ও অন্যান্য উপাদান দ্বারা পূর্ণ করে দিত।
পেটের কাটা অংশ সেলাই করে মোম লাগিয়ে ভরাট করে দিত। এরপরে পুরোদেহে একপ্রকার লবন দিয়ে রাখত। কিছুদিন পর আবার লবন সরিয়ে শবদেহে একপ্রকার তেল মাখানো হতো।
এরপর উন্নতমানের একধরনের কাপড়ে পুরো দেহ পেঁচিয়ে বিশেষ ভাবে তৈ্রি মমি বাক্সে ভরে রাখত। কখনো কখনো একাধিক বাক্সেও মৃতদেহ ভরে রাখতে দেখা যায়। একেকটি শবদেহকে মমি করতে প্রায় ৭০দিন পর্যন্ত লেগে যেত!
মমি নিয়ে আলোচনা করে তুতেনখামেনের কথা না বললে আলোচনাই একপ্রকার অসম্পূর্ণ রয়ে যায়। তুতেনখামেন ছিলেন প্রাচীন ফারাওদের মধ্যে একজন অষ্টাদশ শতকীয় মিশরীয় ফারাও যিনি খুব অল্প বয়সে ক্ষমতা লাভ করেন এবং সম্ভবত ১৮ বছর বয়স হবার আগেই মারা যান।
ধারণা করা হয় খ্রিষ্টপূর্ব ১৩৩৩ অব্দ থেকে ১৩২৪ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত তার শাসনকাল ছিল। অনেকের মতে তিনি খুন হন। তিনি ছিলেন ফারাও আখেনয়াতেনের পুত্র।
তার মৃত্যুর পর তাকে যথাযথ ভাবে মমি করা হলেও ইতিহাসে তার কথা খুব একটা পাওয়া যায় না। আর সে কারনেই তার সমাধি সম্পর্কে আগে কারো কোনো ধারণা ছিল না। ১৯২২সালে হাওয়ার্ড কার্টারের নেতৃত্বে একদল বিজ্ঞানী প্রথম এই সমাধিকক্ষ খঁজে পান। তার আগে এই কক্ষ সম্পূর্ণ সংরক্ষিত অবস্থায় ছিল।
আরও পড়্নঃ প্রাচীন মিশর -শাসনকাল, পিরামিড ও অন্যান্য
ফারাও তুতেনখামেনের সমাধি কক্ষটি আবিষ্কারের পর যত দ্রুত সম্ভব এটি খোলা হয়। কক্ষটি বেশ পরিচ্ছন্ন, পরিপাটি ও দামী আসবাবপত্রে ভরপুর ছিল। তার মমিটি সুরক্ষিত ছিল পর পর তিনটি বাক্সের ভেতরে। এই মমি বাক্সের উপর হায়ারোগ্লিফিক অক্ষরে অনেক কিছু লেখা ছিল, যা পরে বিজ্ঞানীগণ পাঠোদ্ধার করেন। মমি উন্মুক্ত করার পর রাজা তুতেনখামেনের দেহটি বেশ ভালো অবস্থাতেই পাওয়া যায়। তবে শোনা যায়, আসল রহস্যের শুরু ঠিক এর পর থেকেই।
ছবিঃ তুতেনখামেনের সমাধি থেকে প্রাপ্ত একটি মুখোশ।
প্রচলিত আছে, এই প্রজেক্টের মূল ব্যক্তি হাওয়ার্ড কার্টার সমাধিকক্ষটি যেদিন উন্মোচন করেন সেদিন নাকি বাসায় এসে জানতে পারেন তার প্রিয় ক্যানারি পাখিকে একটি কোবরা খেয়ে ফেলেছে। তখনই অনেকে তাকে সাবধান করেন এই বলে যে সাপ প্রাচীন মিশরীয়দের কোনো এক বিশেষ প্রতীক। এটি হয়তো কোনো বিপদের সংকেত, তাই তিনি যেন সমাধিকক্ষ আর অপবিত্র না করেন। তবে এর সত্যতা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
যে দিন আনুষ্ঠানিকভাবে তুতেনখামেনের শবাধার সংরক্ষিত কক্ষে পৌছানোর দরজা খোলা হয় ওই দিন অনেকের মতো কার্টারের সাথে ছিলেন এই প্রজেক্টের মূল অর্থ সরবরাহকারী, তার বন্ধু মি. লর্ড কার্নার্ভন। এই সমাধিকক্ষে প্রবেশের কিছুদিন পর কার্নার্ভনের যে দুর্ঘটনা ঘটে তাতে ফারাওদের অভিশাপে বিশ্বাসীদের মনে বিশ্বাস আরো শক্ত হয়।
কোনো এক মশার কামড়ে কার্নার্ভনের গালে একটি ফোড়া হয় এবং বলা হয় শেভিংএর সময় এটি রক্তাক্ত হয়। পরবর্তীতে এটি থেকে মারাত্মক ইনফেকশন হয়, যার ৬সপ্তাহ ব্যবধানেই তিনি মৃত্যু বরন করেন। ঠিক এর পরদিন ভোরেই কার্নার্ভনের পোষা কুকুরকে তার বাসায় মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়,যা অনেকে রহস্যজনক বলে মনে করেন। আরো প্রচলিত আছে কার্নার্ভনের মৃত্যুর দিন সারা শহরে কিছুক্ষনের জন্য নাকি বিদ্যুৎ চলে গিয়েছিল!
ছবিঃ হাওয়ার্ড কার্টারের মমি উন্মোচন।
পরবর্তীতে বিভিন্নভাবে এই কাজের সাথে যুক্ত আরো অনেকেই মারা যান, যাদের মধ্যে কার্টারের এক সহোযোগীসহ মমির সাথে কোনো না কোনো ভাবে সম্পর্কিত প্রায় ডজনখানেক মানুষ রয়েছেন। এই সব মৃত্যু আবা্রো অভিশাপের প্রশ্নে হাওয়া দিয়ে যায়।
তুতেনখামেনের সমাধি নিয়ে একেকটি গল্প আরো নিত্যনতুন গল্পের জন্ম দিতে থাকে। এতে অনেক সাধারণ মানুষ এই অভিশাপের ব্যাপারে বিশ্বাসী হয়ে ওঠেন। কিন্তু বিজ্ঞানীরা বরাবরই এসবের ব্যাখ্যা প্রদান করে আসছেন।
সমাধিকক্ষটি প্রায় ৩ হাজার বছর ধরে বদ্ধ অবস্থায় ছিল। এখানে অনেক বিষাক্ত অণুজীব উপস্থিত থাকতেই পারে যার সংস্পর্শে আসার কারনেই হয়তো অনেকের মৃত্যু হয়েছে। আর এই শবাধার আবিষ্কারের পর প্রথম ১০ বছরে মাত্র ২ জন পরিদর্শনকারীর মৃত্যু হয়, এবং প্রায় সকলের মৃত্যুই ছিলো বেশ স্বাভাবিক। তা ছাড়া সব থেকে বড় প্রশ্ন হলো অভিশাপ বলে কিছু সত্যিই থাকলে তার প্রভাব হাওয়ার্ড কার্টারের ওপরও পড়ার কথা।
কিন্তু তা্র মৃত্যু হয় ৬৪বছর বয়সে এবং বেশ স্বাভাবিক ভাবেই। যদিও অনেকে দাবী করেন কার্টারের মিশরীয় সভ্যতার প্রতি ভালোবাসা এবং এই সভ্যতার নিদর্শনসমূহ বাইরের দেশে নিতে বাধা দেয়ার কারনেই হয়তো তিনি অভিশাপ থেকে বেঁচে যান।
প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতা ইতিহাসের এক রহস্যময় অধ্যায়।
সাম্প্রতিককালেও ইজিপ্টের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রাচীন সমাধি আবিষ্কৃত হচ্ছে। এথেকে বোঝা যায় এই সভ্যতা সম্পর্কে এখনো অনেক কিছুই আমরা জানি না। তাঁদের বিজ্ঞানের অগ্রগতি এযুগের আধুনিক মানুষকেও বিস্মিত করে।
তাছাড়া, মানুষ কিছুটা রহস্যপ্রেমি। তাই অন্ধকার মাটির নিচে এতো দিন যত্ন করে সংরক্ষন করা শব দেহ, এর চারিদিকের বিভিন্ন চিত্রকর্ম, অজানা অক্ষরে লেখা মন্ত্র ও সহস্রকাল ধরে সাজানো আসবাবপত্র সাধারণ মানুষের মনে একপ্রকার ভীতি ও বিশ্বাস জাগিয়ে তোলে। এই আবিষ্কার পরবর্তী কিছু মানুষের মৃত্যু মমির অভিশাপকে মানুষের কাছে আরো জীবন্ত করে তোলে।
ছবিঃ সংগৃহীত
মন্তব্য লিখুন