আমাদের সকলের খুব পরিচিত মুখ আহমদ ছফা বলেছিলেন, “একটা মানুষের মধ্যেই গোঁজামিল থাকে কিন্তু যে সাপ সে হান্ড্রেড পারসেন্ট সাপ। যে শেয়াল সে হান্ড্রেড পার্সেন্ট শেয়াল। মানুষ সাপও হইতে পারে, পাখিও হতে পারে।মানুষের বিভিন্ন চরিত্র নেয়ার ক্ষমতা আছে”
গ্রাম দেশে আগে সাপ আর শেয়াল পাওয়া যাইতো এগুলা এখন নাই। কারণ সাপ, শেয়াল এরা মানুষ হিসাবে জন্মাইতে আরম্ভ করছে। সারাজীবন বঞ্চিত, নিপীড়িত মানুষের কথা বলেছেন তিনি তার লেখায়। আহমদ ছফা একজন বাংলাদেশী লেখক, ঔপন্যাসিক, চিন্তাবিদ, কবি, বুদ্ধিজীবি ছিলেন।
তার লেখায় বাংলাদেশী জাতিসত্তার পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি গনমানুষের জন্য এক প্রতিবাদী কন্ঠস্বর। জুন ১৯৪৩ সালে চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার হাশিমপুর ইউনিয়নের গাছবাড়িয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা হেদায়েত আলী এবং মাতা আসিয়া খাতুন।
আহমদ ছফার শিক্ষা জীবন শুরু হয় তাঁর পিতার প্রতিষ্ঠিত দক্ষিন গাছবাড়িয়া প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ১৯৫৭ সালে নিত্যানন্দ গৌরচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন।
তারপর ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাবিভাগে। পরে অবশ্য বাংলাবিভাগে ক্লাশ করা অব্যাহত রাখেন নি। ১৯৬৭ সালে ব্রাহ্মনবাড়িয়া কলেজ থেকে প্রাইভেটে পরীক্ষা দিয়ে ২য় শ্রেনীতে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন।
১৯৭০ সালে এমএ পরীক্ষা দেয়ার আগেই বাংলা একাডেমীর পিএইচডি গবেষনা বৃত্তির জন্য আবেদন করেন এবং ৩ বছরের ফেলোশিপ প্রোগ্রামের জন্য মনোনীত হন।
গবেষনার বিষয় ছিল ১৮০০-১৮৫৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেনির উদ্ভব, বিকাশ এবং বাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে তার প্রভাব।
১৯৭০ সালে পিএইচডির জন্য জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের সান্নিধ্যে আসেন।১৯৭১ সালে প্রাইভেটে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমএ পরীক্ষা দেন।
মৌখিক পরীক্ষা হয় ২১ শে মার্চ। তবে তার পিএইচডি আর সম্পূর্ন হয়নি।বলা বাহুল্য জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক স্যারের ও পিএইচডি শেষ পর্যন্ত আর সম্পূর্ন হয়নি।তিনি ১৯৮৬ তে জার্মান ভাষার ওপর গ্যেটে ইনস্টিটিউটের ডিপ্লোমা ডিগ্রিও লাভ করেন।
আহমদ ছফা ছয় ভাইবোনের মধ্যে ছিলেন ২য়।তবে তিনি সারাজীবন অকৃতদার ছিলেন।কয়েক জনের সাথে তার প্রনয় সম্পর্ক গড়ে উঠলেও পরবর্তিতে তা আর শুভ পরিনয়ে রুপ নেয়নি।আর তার এই বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত নিতে যে মানুষটা অনুপ্রানিত করেন তিনি হচ্ছেন রাজ্জাক স্যার।
স্যার মনে করতেন জীবন অনেক ছোট।যেটা জীবনটাকে জানতেই শেষ হয়ে যায়।তাও জীবনের কিছু জানা হয় না।তাই বিয়ে করার মত ক্ষুদ্র কাজ করে জীবনকে জানার সুযোগ কম করতে তিনি চাইতেন না।
রাজ্জাক স্যারই তার ভিতর এ আগুন জ্বেলে দিয়েছিলেন।তারা একসাথে শপথ করা বন্ধুরা শপথ ভাঙলেও পরবর্তিতে ছফা এই বিষয়টা এস এম সুলতানের মাঝে প্রবেশ করিয়ে দেন। এস এম সুলতান ও সারাজীবন অবিবাহিত ছিলেন।
আহমদ ছফা সাহিত্যের প্রায় প্রতিটি শাখায় রেখেছেন তার জাদুকরী স্পর্শ। গল্প,গান,উপন্যাস,কবিতা,প্রবন্ধ,অনুবাদ,ইতিহাস,ভ্রমণকাহিনী মিলিয়ে ৩০টিরও বেশী গ্রন্থ রচনা করেছেন।তিনি ৪টি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেছেন।
১৯৭০সালে তিনি জার্মান সাহিত্যিক গ্যেটের ফাউস্ট অনুবাদ শুরু করেন এবং ১৯৮৬ সালে মুক্তধারা থেকে ফাউস্টের অনুবাদ বের হয়।তার জনপ্রিয় লেখা হল জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক স্যারকে নিয়ে লেখা স্মৃতিচারন গ্রন্থ যদ্যপি আমার গুরু।এটা প্রকাশিত হয় ১৯৯৮ সালে।
এছাড়া তিনি তার প্রেমের স্মৃতি হিসেবে রচনা করেন অর্ধেক নারী অর্ধক ঈশ্বরী।এটি প্রথমে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকায় প্রাণপূর্নিমার চান নামে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হত।
জাগ্রত বাংলাদেশ(১৯৭১)
বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস(১৯৭২)
রাজনীতির আলোকে(১৯৭৫)
বাংলাদেশের রাজনৈতিক জটিলতা(১৯৭৫)
বাঙালি মুসলমানের মন(১৯৮১)
শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য প্রবন্ধ(১৯৮৯)
রাজনীতির লেখা(১৯৯৩)
আনুপূর্বিক তসলিমা ও অন্যান্য স্পর্শকাতর প্রসঙ্গ(১৯৯৪)
নিকট ও দূরের প্রসঙ্গ(১৯৯৫)
সঙ্কটের নানা চেহারা(১৯৯৬)
সাম্প্রতিক বিবেচনা: বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস(১৯৯৭)
আরও পড়ুন: জীবনানন্দ দাশ -রূপসী বাংলার কবি
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৯৯৭)
শান্তিচুক্তি ও নির্বাচিত প্রবন্ধ(১৯৯৮)
বাঙালি জাতি এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্র(২০০১)
উপলক্ষের লেখা(২০০১)
আমার কথা ও অন্যান্য প্রবন্ধ(২০০২)
সেই সব লেখা(২০০৮)
সিপাহী যুদ্ধের ইতিহাস(১৯৭৯)
সূর্য তুমি সাথী (১৯৬৭)
ওঙ্কার (১৯৭৫)
একজন আলী কেনানের উত্থান-পতন (১৯৮৮)
মরনবিলাস (১৯৮৯)
অলাতচক্র (১৯৯৩)
গাভীবিত্তান্ত (১৯৯৫)
অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী(আত্মজৈবনিক প্রেমের উপন্যাস,১৯৯৬)
পুষ্প বৃক্ষ এবং বিহঙ্গ পুরান(১৯৯৬)
সৃজনশীল জীবনী সম্পাদনাঃ যদ্যপি আমার গুরু (১৯৯৮)
অনুবাদ সম্পাদনাঃ তানিয়া (মূল:পি.লিডভ ১৯৬৭)
বার্টান্ড রাসেল (১৯৮২)
ফাউস্ট(মূলঃ ইয়োহান ভোলফ গাঙ ফন গ্যোতে (১৯৮৬)
জল্লাদ সময় (১৯৭৫)
দুঃখের দিনের দোহা (১৯৭৫)
একটি প্রবীন বটের কাছে প্রার্থনা (১৯৭৭)
লেনিন ঘুমোবে এবার (১৯৯৯)
আহিতাগ্নি (২০০১)
গল্প সংগ্রহসম্পাদনাঃ নিহত নক্ষত্র (১৯৬৯)
কিশোর গল্প সম্পাদনাঃ দোলো আমার কনকচাঁপা (১৯৬৮)
শিশুতোষ ছড়াগ্রন্থ সম্পাদনাঃ গো-হাকিম (১৯৭৭)
আহমদ ছফা ছিলেন একজন সাহসী ও প্রতিবাদী লেখক। তিনি ছিলেন সুবিধাবাদীদের বিরুদ্ধে এক সোচ্চার কন্ঠ। আহমদ ছফা সম্পর্কে ফরহাদ মজহার বলেছেন-“সে গাছবাড়িয়া গ্রাম থেকে আসা অতি সাধারন একটি গ্রামের ছেলে। কিন্তু সাহিত্য ,সংস্কৃতি, চিন্তা ও রাজনীতির জগতে সে যে উথাল পাথাল ধাক্কা দিয়ে গেল তার ফলে বাংলাদেশের সাহিত্য বলি,সংস্কৃতি বলি, রাজনীতি বলি, বৈপ্লবিক কর্মকান্ড বলি তার সঙ্গে খোদ একটা বোঝাপাড়া না করে কোন ক্ষেত্রেই অগ্রসর হওয়া যাবে না “
আহমদ শরীফ বলেছিলেন, “সুবিধসবাদীর Life is a compromise তত্ত্বে ছফার আস্থা নেই”। সলিমুল্লাহ খান তাকে একজন দ্রষ্টা, রাষ্ট্রচিন্তাবিদ, বিশ্বের সেরাকাহিনী কথকদের একজন বলেছেন। খান মনে করেন ছফা কাজী নজরুল ইসলামের উত্তরাধিকারী।
জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের মতে, ছফার রচনাবলি গুপ্তধনের খনি এবং তার সাহিত্যকর্ম স্বকীয় এক জগতের সৃষ্টি করে যে জগতে যে কোন পাঠক হারিয়ে যেতে পারে।
হুমায়ুন আহমেদদ ছফাকে অসম্ভব শক্তিধর লেখক বলে অভিহিত করেছেন এবং তাকে নিজের মেন্টর বলে উল্লেখ করেছেন। রশীদ করিম লিখেছেন আহমদ ছফার এক একটি শব্দ শিলাখন্ডের মতন।
কঠিন আপাত উদাসীন নির্মম অথচ তারই অন্তরে গভীর বেদনা ভালোবাসা কী পরিমান তার কোন সীমা নেই। মুহম্মদ জাফর ইকবালের মতে আহমদ ছফার চুলের ডগা থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত একশ ভাগ খাঁটি সাহিত্যিক।
তিনি আরো বলেছেন আমাদের বড় সৌভাগ্য তার মত একজন প্রতিভাবান মানুষের জন্ম হয়েছিল।
১. নারীরা নারীই, সঙ্গের সাথী, দুঃখের বন্ধু এবং আদর্শের অনুসারী নয়।
২. বাংলাদেশের আসল বস্তু বলে যদি কিছু থাকে তা হলো এর আমলাতান্ত্রিক কাঠামে,স্থবির, অনড়, লোভী, হৃদয়হীন এবং বিদেশী শক্তির ক্রীড়নক হওয়ার জন্য সর্বক্ষন প্রস্তুত।
৩. মানুষ যে সমস্ত কথা বলে ইতিহাসের কাছে নির্দোষ প্রমান করার জন্য সজ্ঞানভাবে লিখে যায় ও সমস্ত প্রয়াসের মধ্যে একটা কপটতা রয়েছে।
৪. বোকা লোকেরা বোকামীতে ভয়ানক চালাক, তারা সর্বশক্তি প্রয়োগ করে বোকামীতে টিকিয়ে রাখতে চায়।
৫. বাঁধনহীন মানুষের অনেক বাঁধন।
৬.মাজারে মানুষ আসবেই। মানুষ আসবে কারণ সে দুর্বল অসহায় এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষী।
৭. নারী আসলে যা তাঁর বদলে যখন সে অন্যকিছুর প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়,তখন তাঁর আকর্ষন করার শক্তি হাজার গুন বেড়ে যায়।
৮. একটি কাক আরেকটি কাকের মুখের খাবার কেড়ে নেয়ার জন্য যত রকম ধূর্ততার আশ্রয় নিয়ে থাকে, একজন কবি আরেকজন কবির প্রাপ্য সম্মানটুকু কেড়ে নেয়ার জন্য তাঁর চাইতে কিছু কম করেনা।
৯. প্রতিটি রাষ্ট্র নিজস্ব প্রয়োজনে ইতিহাসকে বিকৃত করে।
১০. রাষ্ট্র যা শিক্ষা দেয় তাতপ নিদিষ্ট পরিমান মিথ্যার মিশাল থাকেই এই মিথ্যা মারাত্মক, মানুষের মনোবৃত্তিকে বিষিয়ে তোলার ক্ষমতা এর অপরিসীম।
১১. সভ্যতা কোন দেশ জাতি বা সম্প্রদায় বিশেষের সম্পত্তি নয়।অথচ প্রতিটি তথাকথিত সুসভ্য জাতির মধ্যেই এই সভ্য অভিমান প্রচন্ডভাবে লক্ষ্য করা যায়।
১২. যে জাতি উন্নত বিজ্ঞান,দর্শন এবং সংস্কৃতির স্রষ্টা হতে পারে না অথবা সে গুলোকে উপযুক্ত মূল্য দিয়ে গ্রহন করতে পারে না,তাকে দিয়ে উন্নত রাষ্ট্র সৃষ্টিও সম্ভব নয়।
১৩ . কাউকে জ্ঞান বিতরনের আগে জেনে নিও যে তার মধ্যে সেই জ্ঞানের পিপাসা আছে কিনা।অন্যথায় এ ধরণের জ্ঞান বিতরন করা হবে এক ধরনের জবরদস্তি।জন্তুর সাথে জবরদস্তি করারা যায়, মানুষের সাথে নয়।
আহমদ ছফা বাংলা একাডেমী কতৃক সাদত আলী আখন্ড পুরস্কার ও লেখক শিবির পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেন। উল্লখযোগ্য পুরস্কারের মধ্যে তিনি ২০০২ সালে সাহিত্যে (মরনোত্তর) একুশে পদক লাভ করেন। এছাড়া ১৯৮০ সালে ইতিহাস পরিষদ পুরস্কার লাভ করেন।
আমাদের এই প্রিয় লেখক ২০০১ সালের ২৮ জুলাই ৫৮ বছর বয়সে পরলোকগমন করেন। তাকে মিরপুর বুদ্ধিজীবি গোরস্থানে সমাধিস্থ করা হয়। তার এ মৃত্যু আমাদের জন্য অপূরনীয় ক্ষতি সাধন করে। তিনিই প্রথম বাংলাদেশের বই মেলায় বাইরের দেশের লেখকদের বই আসা নিয়ে প্রতিবাদ করেন।
যার ফলশ্রুতিতে আমাদের দেশের লেখকদের জন্য উন্মচিত হয় এক নতুন দিগন্ত। তিনি প্রগতিশীল লেখকদের আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে ছিলেন সিদ্ধহস্ত।সস্তা খ্যাতির মুখাপেক্ষী তিনি কখনি ছিলেন না। আর এর জন্যই তিনি যুগ যুগ ধরে তরুনদের হৃদয়ে লালিত স্বপ্ন।
মন্তব্য লিখুন