বিয়ার গ্রিলস ডিসকভারি চ্যানেলের জনপ্রিয় টিভি সিরিজ ম্যান ভার্সেস ওয়াইল্ড এর জনপ্রিয় উপস্থাপক। ডিসকভারি চ্যানেল দেখে না এবং তাকে চিনে না এমন মানুষ নেই বললেই চলে। দুর্গম স্থানে টিকে থাকার সংগ্রাম এবং বিদঘুটে সব খাবার খাওয়ার জন্য তিনি বেশ জনপ্রিয়। বিয়ার গ্রিলস নামে বেশ জনপ্রিয় হলেও তার পুরো নাম এডওয়ার্ড মাইকেল গ্রিলস। তিনি একজন এভারেষ্ট বিজয়ী ব্রিটিশ অভিযাত্রী, লেখক এবং উপস্থাপক।
বিয়ার ৭ জুন ১৯৭৪ সালে জন্মগ্রহন করেন। জন্মসূত্রে তিনি যুক্তরাজ্যের নাগরিক। তিনি একাধারে এটন কলেজ ও ইউনিভার্সিটি অফ লন্ডন- এ লেখাপড়া করেন। পেশায় তিনি একজন চিফ স্কাউট, অভিযাত্রী, লেখক, প্রেরনাদানকারী বক্তা ও টেলিভিশন উপস্থাপক।
তার পিতা স্যার মাইকেল গ্রিলস একজন প্রয়াত রাজনীতিবিদ। বিয়ার ২০০০ সালে সারাহ কেনিংস নাইট এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। দাম্পত্য সঙ্গী সারা গ্রিলস ও তিন পুত্র সন্তান জেসি, মার্মাডিউক ও হাকলেবেরিকে নিয়ে তিনি ইংল্যান্ড এ বসবাস করেন।
তার ম্যান ভার্সেস ওয়াইল্ড ধারাবাহিক প্রোগ্রাম এর কারনে খুব অল্প সময়ে তিনি দর্শক হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছেন। তার বার্ষিক সম্পত্তির পরিমান ১০ মিলিয়ন ডলার। উচ্চতায় ৬ ফুট লম্বা এই অভিযাত্রী ২০০৯ সালের জুনে গ্রিলস ৩৫ বছর বয়সে সর্বকনিষ্ঠ স্কাউট প্রধান হিসেবে নিযুক্ত হন।
বিয়ার গ্রিলসের ৪ বছর বয়স অবধি শৈশব কাটে উত্তর আয়াারল্যান্ডের ডোনঘাডি এলাকায়। এরপর তিনি পরিবারের সাথে ক্যামব্রিজ অঞ্চলে যান। তার পিতা স্যার মাইকেল গ্রিলস ছিলেন কনজারভেটিভ পার্টির একজন রাজনীতিবিদ। বিয়ারের মা হলেন লেডি গ্রিলস যার মা প্যাট্রিসিয়া ফোর্ড ছিলেন একজন রাজনীতিবিদ এবং সংসদ সদস্য। বিয়ার গ্রিলস এর বড় বোন লারা ফাউসেট পেশায় একজন টেনিস কোচ। লারা বিয়ার গ্রিলস এর “বিয়ার” নামটি দেন যখন বিয়ারের বয়স কেবল এক সপ্তাহ।
বিয়ার গ্রিলস ইটন হাউস, লুডগ্রভ স্কুল, ইটন কলেজে শিক্ষা লাভ করেছেন। ইটন কলেজের ছাত্র অবস্থায় তিনি সেখানকার প্রথম পর্বতারোহণ ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে তিনি ইউনিভার্সিটি অফ লন্ডন থেকে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেন।
বিয়ারের বাবা নৌচালনায় দক্ষ ছিলেন বিধায় ছোটবেলা থেকে বিয়ার তার বাবার কাছে পর্বতারোহন এবং নৌচালনা শিখেছেন। একটু বড় হয়ে কিশোর বয়সে বিয়ার স্কাইডাইভিং এবং কারাতে প্রশিক্ষন নেন।
পাশাপাশি বিয়ার যোগ ও নিনজৎসু চর্চা করেন। মাত্র আট বছর বয়সে তিনি কাব স্কাউটে নাম লেখান। বিয়ার গ্রিলস ইংরেজির পাশাপাশি স্প্যানিস এবং ফরাসি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেন। তিনি ধর্মে একজন খ্রিষ্টান। ধর্মবিশ্বাসকে তার জীবনের মেরুদন্ড হিসেবে মানেন গ্রিলস।
বিদ্যালয় জীবন শেষ হবার পর বিয়ার গ্রিলস ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়ার ইচ্ছা পোষন করেন। এবং তিনি ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেন । তখন বিয়ার ইউনাইটেড কিংডম স্পেশাল ফোর্স রিজার্ভে কাজ করার সুযোগ পান। তিনি স্পেশাল এয়ার সার্ভিসে ৩ বছর কাজ করেন।
১৯৬৬ সালে জাম্বিয়ায় গ্রিলস একটি প্যারাসুট দুর্ঘটনার মুখোমুখি হন। এ দুর্ঘটনায় বিয়ারের চিরতরে হাটার ক্ষমতা বন্ধের সম্ভাবনা দেখা দেয়। যার ফলে পরবর্তী এক বছর তাকে মিলিটারির সকল কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকতে হয়। আস্তে আস্তে বিয়ার সুস্থ হয়ে ওঠেন এবং তার শৈশববের লালিত স্বপ্ন মাউন্ট এভারেষ্ট জয়ের নেশায় উদ্বোলিত হন। মানব সেবায় অবদান রাখার জন্যে বিয়ার ২০০৪ সালে সম্মানসূচক লেফটেন্যান্ট কমান্ডার পদ লাভ করেন।
১৯৯৮ সালের ১৬ মে বিয়ার তার শৈশবের লালিত স্বপ্ন মাউন্ট এভারেস্ট জয় করতে সক্ষম হন। মাত্র আট বছর বয়সে যখন তার বাবা তাকে এভারেস্ট এর একটি ছবি উপহার হিসেবে দেন, তখনই বিয়ার এভারেস্ট জয়ের ইচ্ছা পোষন করেন।
মাত্র ২৩ বছর বয়সে এভারেস্ট জয়ের মাধ্যমে তিনি গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস এ সর্বকনিষ্ট ব্রিটিশ হিসেবে এভারেস্ট জয়ের রেকর্ড করেন। জাম্বিয়ার প্যারাসুট দুর্ঘটনায় বিয়ারের চিরতরে হাটার ক্ষমতা বন্ধের সম্ভাবনা দেখা দেয়। এ দূর্ঘটনার ১৮ মাস পরেই তিনি চিকিৎসা বিজ্ঞানকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে সুস্থ হয়ে ফিরে আসেন এবং এভারেস্ট জয় করেন।
আরও পড়ুনঃ টমাস আলভা এডিসন আধুনকি সভ্যতার জনক এর জীবনী
মূলত শৈশবের প্রবল স্বপ্ন তাকে সুস্থ করে তোলে এবং লক্ষে পৌছে দেয়। পরবর্তীতে অস্ট্রেলীয় নাগরিক জেমস অ্যালেন ২২ বছর বয়সে একটি দলের সাথে এভারেস্ট জয় করেন। এরপর রব গন্টলেট নামের মাত্র ১৯ বছর বয়সে এভারেস্ট জয় করেন এবং বিয়ারের রেকর্ড ভেঙে ফেলেন।
একটি ডিওডোরেন্টের বিজ্ঞাপনের অংশগ্রহনের মাধ্যমে বিয়ার গ্রিলস টেলিভিশন জগতে প্রবেশ করেন। ইংল্যান্ডের প্রতিরক্ষা মন্ত্রনালয়ের উদ্যোগে নির্মিত সেনাবাহিনীর মাদক-বিরোধী টিভি ক্যাম্পেইনেও বিয়ার অংশ নেন।
এছাড়ার বিয়ার বিশ্বখ্যাত হ্যারডস দোকানের বিজ্ঞাপন করেন। পরবর্তীতে বিয়ার বেশ কিছু টেলিভিশন প্রোগ্রামে অংশ নেয়ার সুযোগ পান। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ফ্রাইডে নাইট উইথ জোনথোন রোজ, অপরাহ উইনফ্রে শো, দ্যা টুনাইট শো উইথ যে লেনো, দ্যা লেট শো ডেভিড লেটারম্যান ইত্যাদি।
গ্রিলস ইন্টারনেটে পাঁচ পর্ব বিশিষ্ট একটি সিরিজে উপস্থিত হন এবং সেখানে তিনি নগর-জীবনে টিকে থাকার কৌশল প্রদর্শন করেন। গ্রিলস একসময় ওয়ানার্স ব্রাদার্স এর পক্ষ থেকে ক্লাশ অফ দ্যা টাইটানস চলচ্চিত্রে অভিনয়ের প্রস্তাব পান।
ফেসিং আপ নামে রচিত বিয়ার গ্রিলসের সর্বপ্রথম বই যুক্তরাজ্যের সবচেয়ে বেশী বিক্রিত বইয়ের তালিকায় স্থান পায়। পরবর্তীতে এ বইটি যুক্তরাষ্ট্রে দ্যা কিড হু ক্লাইম্বড এভরেস্ট নামে প্রকাশিত হয়। এভারেস্টে তার অভিজান এবং অভিজ্ঞতা সম্পর্কে রচিত তার দ্বিতীয় বই ফেসিং দ্যা ফ্রোজেন অশেন ২০০৪ সালে উইলিয়াম হিল স্পোর্টস বুক অফ দ্যা ইয়ার পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়।
পরবর্তীতে বিয়ার পৃথীবির কিছু প্রতিকূল পরিবেশে তার টিকে থাকার অভিজ্ঞতা অবলম্বনে তার তৃতীয় বই প্রকাশ করেন। যার নাম বর্ন সাইভাইভর বিয়ার গ্রিলস। এই বইটি সানডে টাইমস টপ টেন বেস্ট সেলার তালিকায় স্থান পায়। এছাড়াও বিয়ার আউটডোর অ্যাডভেঞ্চার নামে একটি বই প্রকাশ করেন। ২০১১ সালে বিয়ার গ্রিলস মাড,সোয়েট অ্যান্ড টিয়ারস দ্যা অটোবায়োগ্রাফি নামে তার আত্মজীবনী প্রকাশ করেন।
শিশু কিশোরদের জন্য দূর্গম স্থানে টিকে থাকার কৌশলের উপর বেশ কিছু বই রচনা করেন। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- মিশন সারভাইভাল, গোল্ড অফ দ্যা গডস, ওয়ে অফ দ্যা ওলফ, স্যান্ডস অফ দ্যা স্করপিয়ন, ট্র্যাক্স অফ দ্যা টাইগার ইত্যাদি।
২০০৫ সালে বিয়ার গ্রিলস এবং তার এগারো সহযোগীর ফ্রেঞ্চ ফরেন লিজিওনের আওতায় সাহারা মরুভুমিতে প্রশিক্ষনের উপর এস্কেপ টু দ্যা লিজিওন নামে একটি টেলিভিশন শো নির্মান করা হয়। এটি প্রচারিত হয় যুক্তরাজ্যের চ্যানেল ফোর এবং যুক্তরাষ্ট্রের মিলিটারি চ্যানেলে। পরবর্তীতে এটি যুক্তরাজ্যের হিস্টোরি চ্যানেলে পুনঃপ্রচারিত হয়।
বিয়ার গ্রিলস যুক্তরাজ্যের চ্যানেল ফোর এ বর্ন সারভাইভর নামে একটি প্রোগ্রাম করে থাকেন। এটি যুক্তরাষ্ট্র অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, কানাডা এবং ভারতে ম্যান ভার্সেস ওয়াইল্ড নামে প্রচারিত হয়। এছাড়াও এশিয়া, ইউরোপ এবং আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে এটি আল্টিমেট সারভাইভাল নামে প্রচারিত হয়। এই শো তো দেখানো হয়, বিয়ার গ্রিলসকে কোন প্রতিকূল পরিবেশে নিয়ে যাওয়া হয়। সেই পরিবেশের প্রতিকূলতার মধ্যেও কিভাবে বেঁচে ফিরতে হয় বিয়ার সেসব টিকে থাকার কৌশল প্রদর্শন করেন। ম্যান ভার্সেস ওয়াইল্ড এর যাত্রা শুরু হয় ২০০৬ সালে এবং রাতারাতি এটি যুক্তরাষ্ট্রের সর্বাধিক জনপ্রিয় টেলিভিশন প্রোগ্রামে পরিণত হয়। বিশ্বজুড়ে ১.২ বিলিয়ন মানুষ এই অনুষ্ঠানের নিয়মিত দর্শক।
২০১২ সালে মার্চ মাসে ডিসকভারি চ্যানেল, বিয়ার গ্রিলসের সাথে চু্ক্তি-সংক্রান্ত মতভেদ ঘটার কারনে ম্যান ভার্সেস ওয়াইল্ড প্রোগ্রামটি সাময়িক বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীতে বিয়ার গ্রিলস আবারও ডিসকভারি চ্যানেলের সাথে কাজ শুরু করেন। এর পর থেকে তার প্রোগ্রাম আবার চলমান হয়।
তথ্যসূত্রঃ উইকিপিডিয়া
মন্তব্য লিখুন