বর্তমান সময়ে সোনা রুপা সহ সকল ধনরত্নের মূল্য যখন আকাশ ছোঁয়া, তখন পুরো একটা ঘর মূল্যবান অ্যাম্বার ও খাঁটি সোনাদানায় মোড়া, এটা কল্পনা করতেই অবিশ্বাস্য বলে মনে হয়। কিন্তু বাস্তবেই এমন একটি কক্ষ ছিল রাশিয়ার রাজপ্রাসাদে। পরবর্তীকালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসি বাহিনীর আক্রমনের পর কিছু দিনের জন্য এটি তাদের হাতে চলে যায়। এরপর হিটলারদের পতন হলেও ওই বহুমূল্য অ্যাম্বার রুম এর আর কোনো হদিস পাওয়া যায় নি।
অনেকের মতে অ্যাম্বার রুম নাৎসীদের বোমা হামলায় ধ্বংস হয়ে যায়। তবে এখনো কিছু গবেষক মনে করেন ওই বহুমূল্য সম্পদ তখন ধ্বংস করা হয়নি, বরং কোথাও লুকানো আছে। তাই আজও অনেকে আছেন যারা অ্যাম্বার রুমের বিশাল সম্পদের সন্ধান করে যাচ্ছেন।
আর্টিকেলে যা থাকছেঃ
এক প্রকার চিরহরিৎ বৃক্ষের রজন বহু বছর ধরে জমাট বেধে তৈরি হয় শক্ত অ্যাম্বার। অনেক সময় বিভিন্ন পোকামাকড় এই রজনে প্রাকৃ্তিক ভাবেই আটকা পড়ে জীবাশ্ম হয়ে যায়। বহু বছর পর এই রজন কঠিন হয়ে আমাদের কাছে মূল্যবান রত্ন অ্যাম্বারে পরিণত হয়।
অ্যাম্বার বিভিন্ন রঙের হয়ে থাকে। এটি স্বচ্ছ, অস্বচ্ছ বা ঈষদস্বচ্ছ যে কোনো রকমের হতে পারে। ক্ষেত্র বিশেষে অ্যাম্বার সাদা, হলুদ, কমলা, বাদামী বা লালও হতে পারে। বর্ণ ও আকার আকৃ্তির ওপর ভিত্তি করে এই রত্নের মূল্যেরও হেরফের হয়। বাল্টিক সাগরের তীরে প্রায় ৪০ থেকে ৬০ মিলিয়ন বছর প্রাচীন অ্যাম্বার জমা হয়ে আছে বলে ধারণা করা হয়। এর অনেকগুলির মধ্যেই জীবাশ্ম ফসিল পাওয়া যায়। তাই এগুলোর মূল্য এতো বেশি।
অ্যাম্বার রুমের অতীতের সাথে জড়িয়ে আছে রাশিয়া ও প্রুশিয়ার ইতিহাস। সে সময় প্রুশিয়ার রাজা ছিলেন প্রথম ফ্রেডারিক। তিনি ও তার স্ত্রী দুজনেই ছিলেন খুব শিল্প-সাহিত্য অনুরাগী। ধারনা করা হয় তার স্ত্রী সোফি শার্লটের ইচ্ছাতেই বার্লিনের শার্লটিনবার্গ রাজপ্রাসাদে অ্যাম্বার দিয়ে কক্ষ প্রস্তুত করার সিদ্ধান্ত নেন রাজা।
রাজার নির্দেশমতো ১৭০১খ্রিষ্টাব্দে শুরু হয় অ্যাম্বার রুম তৈরির কাজ। বেশির ভাগের মতে শ্লুটো ছিলেন এই শিল্পের নকশাকার। তার পরিকল্পনা ছিল মূল্যবান কাঠের ফ্রেমের ওপর অতি মূল্যবান রত্ন অ্যাম্বার ও সোনার পাত বসিয়ে কারুকার্য করা হবে। মূল্যবান আয়না দিয়ে সৌন্দর্য্য বাড়ানো হবে ও এরপর মোম লাগিয়ে কাঠের ফ্রেমগুলো আটকে দেওয়া হবে।
দুঃখের বিষয়, ১৭০৫সালে সোফি শার্লট মারা যান। কিন্তু, কাজ থেমে থাকে না। অনেক উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে কাজ চললেও ১৭১৩ সালে রাজা প্রথম ফ্রেডারিকেরও মৃত্যু হয়। এরপর নতুন রাজা হন ফ্রেডারিক ভিলহেম। ইনি রাজ্য চালনায় বেশ মিতব্যয়ী ছিলেন। শিল্প-সাহিত্যে বেশি খরচ করা তার একদম পছন্দ ছিল না। রাজা হয়ে যথারীতি তিনি অ্যাম্বার চেম্বারের কাজ বন্ধ করে দেন।
এদিকে ১৭১৬ সালে রাশিয়ার তৎকালীন জার (রাজা) প্রথম পিটার (পিটার দ্যা গ্রেট) ৩দিনের জন্য প্রুশিয়ার রাজপ্রাসাদে বেড়াতে আসেন। তখনই ভিলহেম কথায় কথায় জানতে পারেন, পিটারের অ্যাম্বারের প্রতি প্রচন্ড আকর্ষণের কথা। ভিলহেম রাজনীতিতে ছিলেন যথেষ্ট পারদর্শী। রাশিয়ার সাথে আরো ভালো সম্পর্ক তৈ্রি করার জন্য তিনি পিটারকে ওই অ্যাম্বার রুম উপহার দেন, বিনিময়ে অনেক অতিরিক্ত সুযোগ সুবিধা পান।
এরপর যত দ্রুত সম্ভব রুমের কারুকার্যের যতটুকু অংশ তৈ্রি হয়েছিল তা আঠারোটি বিশাল বাক্সে ভরে ফেলা হয়। সেই সব বাক্স রাশিয়ার পিটার্সবার্গে এসে পৌছায় ১৭১৭ সালের মধ্যে। কিন্তু সেই সময় রাশিয়া ও সুইডেনের যুদ্ধ চলাকালে ওই মূল্যবান ধনরাশি ওই ভাবেই বাক্সবন্দী হয়ে পড়ে থাকে। ১৭২১ সাল পর্যন্ত পিটার তার সাম্রাজ্য গঠনে মনযোগী থাকায় অ্যাম্বার চেম্বারের কাজ শুরু করে যেতে পারেন নি। এসময় তার মৃত্যু হলে তার কন্যা এলিজাবেথ ক্ষমতা গ্রহন করেন ও এর কাজ আবার শুরু করেন।
এলিজাবেথ রাশিয়ার মসনদে বসেই এই অ্যাম্বার চেম্বারটি স্থাপনের আদেশ দেন ক্যাথরিন সেন্ট পিটার্সবার্গের শীতকালীন প্রাসাদে। আর এর প্রধান দায়িত্ব দেন ইতালির স্থাপত্যবিদ বার্তলমিউ আরাস্ট্রেল্লিকে।
কিন্তু আরাস্ট্রেল্লি পড়লেন এক ঝামেলায়। এলিজাবেথ যে মাপে কক্ষটি তৈরি করতে বলেছেন কারুকার্যখচিত প্যানেলের সংখ্যা তার থেকে কম আছে। তখন তিনি বুদ্ধি করে কাঁচ ও বিভিন্ন চিত্রকর্ম ব্যবহার করে পুরো অ্যাম্বার চেম্বারটি তৈ্রি করলেন। কাঠের ফ্রেমগুলিও রং করলেন চকচকে অ্যাম্বারের রঙে। এভাবেই ১৮৪৩ সালে চোখ ধাঁধানো অ্যাম্বার রুমটি তৈ্রি হয়ে গেল।
তৈরি হয়ে যাওয়ার পরেও একটা খুঁত থেকেই গেল। প্রথম নকশা অনুযায়ী রুমে চারটি ফ্রেম ব্যবহারের কথা থাকলেও তিনটি ফ্রেম তৈ্রি সম্পন্ন হয়েছিল এবং সেভাবেই কক্ষটি সাজানো হয়েছিল। কিন্তু রানি এলিজাবেথের মনে এই বিষয়টি বেশ পীড়া দিচ্ছিল।
তখন প্রুশিয়ার রাজা ছিলেন দ্বিতীয় ফ্রেডারিক। তিনি কোনো ভাবে রানির এই মনোবাঞ্ছার কথা জানতে পারেন এবং তাকে না জানিয়েই নতুন একটা অ্যাম্বারের ফ্রেম তৈ্রি করে পাঠিয়ে দেন, তাকে চমকে দেওয়ার জন্য। ১৭৪৬সালে এই কক্ষ অবশেষে পূর্ণতা পায় এবং রানি এলিজাবেথ ৯বছর ধরে এটি তার শীতকালীন অভ্যর্থনা কক্ষ হিসেবে ব্যবহার করেন।
১৭৫২ সালে রানি এলিজাবেথের ইচ্ছায় আবারো এই রুমের অবস্থান পরিবর্তন করা হয়। এবার আনা হলো রানির ক্যাথরিন প্রাসাদে। কিন্তু এই রুমের মাপ অনুসারে অ্যাম্বার চেম্বার বসানোর জন্য এতে আবারো অনেক পরিবর্তন করতে হয়। ১৭৭০ সালে এর এই পর্যায়ের কাজ শেষ হয়। পরবর্তিতেও আরো অনেকবার এতে নানারকম সংস্কার কাজ করা হয়। একেক জনের আমলে এই কক্ষ একেকরকম কাজে ব্যবহার করা হতো।
একপর্যায়ে এই কক্ষের আয়তন ছিল ১৮০ বর্গ ফুট। প্রায় ছয় টন মূল্যবান অ্যাম্বার ও অন্যান্য আরো বিভিন্ন প্রকার দামী পাথর ও সোনায় মোরা ছিল এর পুরো কাঠামো। বর্তমানের হিসেবে এর উপাদান সমূহের আর্থিক মুল্যই দাড়ায় প্রায় ১৪২-৩০০মিলিয়ন মার্কিন ডলার। আর এর ঐতিহাসিক মূল্য এর থেকেও অনেক বেশি।
এরপর কমিউনিস্ট শাসনামলে কক্ষটির ব্যবহার বন্ধ করা হয় এবং পরবর্তীতে জোসেফ স্টালিন এটিকে জাদুঘরে পরিণত করে সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত করে দেন।
এরপর শুরু হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। জার্মান সেনারা সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমন করলে হিটলার বাহিনী এগিয়ে যেতে থাকে সেন্ট পিটার্সবার্গের দিকে। এদিকে তখন অ্যাম্বার রুমের কিউরেটর ছিলেন কুচুমভ।
তিনি জাদুঘরের মূল্যবান জিনিসগুলো বাক্সে ভরে অন্যত্র নিয়ে গেলেও সমস্যায় পড়লেন এই মূল্যবান অ্যাম্বারে মোড়ানো ঘরটি নিয়ে। ঘরের অ্যাম্বার প্যানেলগুলো খুলে অন্যত্র নিয়ে যাবার পরিকল্পনা ছিল তাদের। কিন্তু ওগুলো খুলতে গিয়ে দেখেন রত্নগুলো যে মোম দিয়ে লাগানো আছে তা অনেক ক্ষেত্রেই পুরাতন হওয়ায় বেশ দূর্বল হয়ে পড়েছে। খুলতে গিয়ে এর ক্ষতি হতে পারে এই আশংকায় তিনি অন্য উপায় বের করেন। তিনি একটি সাধারন কাপড় দিয়ে পুরো ঘরটি মুড়ে দেন। এর ফলে ঘরটি অন্যসব সাধারণ ঘরের মতোই দেখায়। তার ধারণা ছিল নাৎসি বাহিনী হয়তো ঘরটিকে খুঁজে বের করতে পারবে না।
কিন্তু ধূর্ত নাৎসিবাহিনী ঠিকই ঘরটির হদিস পেয়ে যায় এবং অ্যাম্বারের প্যানেল গুলোকে খুলে নিয়ে রেখে দেয় কনিসবার্গ দুর্গে। কিন্তু যুদ্ধের শেষের দিকে মিত্রবাহিনীর বোমা হামলায় কনিসবার্গ দুর্গ ভস্মীভূত হয়ে যায়। মূলত এরপর থেকেই অ্যাম্বার রুমের কোনো সন্ধান আর কোনো দিনই পাওয়া যায় নি।
অ্যাম্বার কক্ষটি কোথায় গেল তা নিয়ে অনেক রকম ধারনা প্রচলিত আছে। এর মধ্যে কিছু মানুষ মনে করেন কনিসবার্গ মিউজিয়ামের কিউরেটর রোহড মূল্যবান রত্ন ভর্তি বাক্সগুলো স্যাক্সোনির ওয়েশেলবার্গের দুর্গে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। সেই উদ্দেশ্যে তিনি সাগরপথে যাত্রীবাহী জাহাজ ভিলহেম-গুসোলফে বাক্সগুলো তুলে দেন।
কিন্তু রাশিয়ানরা সাবমেরিন জাহাজটিকে ডুবিয়ে দেয়। ২০০৩ সালে ডুবুরিরা ওই স্থানে সন্ধান করেন তবে কিছুই খুজে পাননি। যদিও ওই স্থানে এর আগেও অনেকের হস্তক্ষেপ পড়তে পারে বলে ধারণা করা হয়। ফলে জিনিসগুলো হারিয়ে গিয়ে থাকতে পারে।
আরেক পক্ষ দাবী করেন হিটলাররা তাদের পরাজয় আন্দাজ করে অ্যাম্বার রুম আশেপাশে কোথাও লুকিয়ে ফেলেছে। আবার অনেকে মনে করেন রাশিয়ানরাই এটি খুঁজে পেয়েছে এবং কোথাও লুকানো আছে।
এজন্য অনেকেই এখনো বনে জঙ্গলে, খনিতে মাটির নিচে বা বহুকাল পরিত্যাক্ত বাড়ি ঘরে এই গুপ্তধনের সন্ধান করেন। যদিও এবিষয়ে অভিজ্ঞ অনেকেরই মতামত কনিসবার্গ দূর্গে মিত্রবাহিনীর বোমা হামলার সময়েই অ্যাম্বার রুম পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়।
এই কক্ষ নিয়ে মানুষের মাতামাতি যেমন কম নয় তেমনি এ নিয়ে একটি অভিশাপেরও প্রচলন রয়েছে। প্রথমেই এর সাথে জড়িত একজন ব্যক্তি ছিলেন রোহড যিনি কনিসবার্গ দূর্গে ওই অ্যাম্বার প্যানেল ভর্তি বাক্সগুলো আসার পর তার রক্ষণাবেক্ষণ করেন। প
পবর্তীতে তিনি আর তার স্ত্রী বিশেষ রোগে ভুগে মারা যান বলে শোনা যায়। এক রাশিয়ান গোয়েন্দা কর্মকর্তা এই রুমের বিষয়ে মিডিয়ার সামনে কথা বলার পরেই গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা যান। আরেকজন জার্মান সেনা যিনি অ্যাম্বার রুমের সন্ধান করছিলেন, তারও একদিন লাশ পাওয়া যায় এক বনের ভেতর। এসব থেকেই মানুষের মনে এই গুপ্তধন খোঁজার ব্যাপারে একধরনের ভীতির সৃষ্টি হয়।
বর্তমানে অ্যাম্বার রুমের একটি রেপ্লিকা তৈরি করেছে রাশিয়া সরকার। এটি এখন রয়েছে সারস্কোয়ে সেলো স্টেট মিউজিয়ামে যেটি পূর্বে পরিচিত ছিল ক্যাথরিন প্রাসাদ হিসেবে। পঁচিশ বছর ধরে এবং প্রায় এগারো মিলিয়ন ডলার খরচ করে এই রেপ্লিকা রুমটি তৈ্রি করা হয়। ২০০৩ সালে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এটি উদ্বোধন করেন। বর্তমানে এটি সাধারন মানুষের জন্য উন্মুক্ত।
ছবিঃ সংগৃহীত
মন্তব্য লিখুন