এ আর রাহমান (আল্লাহ রাখা রাহমান) যিনি শুধু ভারতেই নয়, সারা বিশ্বের বিখ্যাত মিউজিক কম্পোজারদের মধ্যে তিনি অন্যতম। ভারতের একটি সাধারন পরিবারে জন্মগ্রহন করেও, তিনি বিশ্বের অন্যতম একজন খ্যাতিমান মিউজিশিয়ান হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
অসংখ্য ভারতীয় মুভির মিউজিক কম্পোজ করেছেন তিনি। অনেক মুভি রয়েছে যেগুল শুধুমাত্র তার কম্পোজ করা গান ও মিউজিকের জন্য জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তিনি একাধারে একজন মিউজিক কম্পোজার , গান লেখক, গায়ক ও মিউজিক প্রডিউসার। তিনি হিন্দি, উরদু ও তামিল সহ বেশ কয়েকটি ভাষার মিউজিকের উপর কাজ করেছেন।
তার ক্যারিয়ারে ভারত সরকার কর্তৃক প্রদত্ত তৃতীয় সর্বোচ্চ নাগরিক পুরুষ্কার পদ্মভূষন, অস্কার, ফ্লিম ফেয়ার পুরুস্কারসহ অসংখ্য পুরুস্কার রয়েছে। এ আর রাহমান হিন্দু ধর্মালম্বী হিসেবে জন্মগ্রহন করলেও পরবর্তীতে মুসলিম ধর্ম গ্রহন করেন।
আর্টিকেলে যা থাকছেঃ
এ আর রহমার ৬ জানুয়ারি ভারতের চেন্নাইতে একটি হিন্দু পরিবারে জন্মগ্রহন করেন। এ আর রাহমানের তখন নাম ছিল দিলিপ কুমার। তিনি খুবই সাধারন পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বাবা-মা ও তিন বোন এর সাথে বসবাস করতেন। তার বাবার নাম ছিল শেখর , মায়ের নাম ছিল কাস্তুরি। তার তিন বোন কাঞ্চানা, বালা ও রেখা। তার বাবা ভাল হারমনিয়াম বাজাতে পারতেন।
নিজের দক্ষতার জন্য তিনি দক্ষিন ভারতীয় মুভির মিউজিক ডিরেক্টর এর সাথে কাজ করার সুযোগ পান। ভাল কাজ ও প্ররিশ্রমিক স্বভাবের জন্য লোকাল মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে তার বাবা বেশ পরিচিত ছিলেন।
রাহমানের পরিবার ভালোই চলছিল। কিন্তু পরবর্তীতে এমন একটি সময় আসে যার কারনে তাদের পরিবার ভিষন বিপর্যয়ের মধ্যে পরে। এ আর রাহমান যখন ৪ বছরের ছিলেন তখন তার বাবা অসুস্থ হয়ে পরেন। তার বাবার অসুস্থতার কারন ঐ সময়ে কোন ডাক্তার ধরতে পারেনি। স্বল্প পরিমানে অর্থ থাকায় তারা উচ্চপর্যায়ে চিগিৎসা দিতে পারে নি।
এ আর রাহমানের বাবা ৫ বছর ধরে অসুস্থ ছিলেন। যখন রাহমানের বয়স ৯ বছর তখন তার বাবা মারা যায়। এই ঘটনা তার জীবন পরিবর্তন করায় যথেষ্ঠ ভুমিকা পালন করেন। তার বাবার মৃত্যুতে তাদের পারিবারিক জীবন সম্পূর্ণ বির্পযয়ের সম্মুখীন হয়ে পরে। কারন পুরো পরিবারের একমাত্র আয়ের উৎস তার বাবা ছিলেন। তখন রাহমান স্কুল এ পরাশুনা করতেন। তার বাবার মৃত্যর পরের কয়েক বছর তার মা সংসার চালাতে পারলেও এমন একটি সময় আসে যখন রাহমানের উপর সব দায়িত্ব এসে পরে।
আরও পড়ুনঃ অরিজিৎ সিং এর বায়োগ্রাফি জনপ্রিয় সংগীত শিল্পী
পরিবারের জন্য কিছু আয় করা এ আর রাহমানের জন্য খুবই প্রয়োজন হয়ে ওঠে। তিনি স্কুলের পরে কিছু কাজ করতেন। এবং সেখান থেকে যা উপার্জন করতেন তা দিয়ে পরিবারকে সাহায্য করতেন। তার বাবাকে স্থানীয় মানুষ অনেক শ্রদ্ধা করতো। তার বাবার মৃত্যুর পর স্থানীয় মানুষ তাদের পরিবারের উপর সহানুভুতিশীল ছিল। তাদের সহযগীতায় রাহমান একটি রেকডিং স্টডিও তে কাজ করার সুযোগ পায়।
রাহমান সকালে স্কুল এ যেতেন এবং স্কুল শেষে অনেক বেলা পর্যন্তু রেকডিং স্টুডিওতে কাজ করতেন। যেহেতু তার বাবা মিউজিক এর উপর কাজ করতেন তাই তিনিও মিউজিকের সাথে কিছুটা পরিচিত ছিলেন। কাজ করতে করতে রাহমানের মিউজিকের প্রতি প্রবল আকর্ষন তৈরি হয়। কাজ করার সাথে সাথে তিনি কয়েকটা বাদ্যযন্ত্র বাজনো শিখে ফেলেন।
কিন্তু স্কুল এর পরে কাজ করা খুবই কস্টকর হয়ে উঠেছিল। তিনি অনেক বার স্কুল ছুটির আগেই স্টডিওতে চলে যেতেন। এক সময় তিনি বুঝতে পারেন যে একসাথে দুইটা করার ফলে সে কোনটাই ভাল করে করতে পারছেন না। তখন তাকে যেকোন একটা নির্বাচন করা খুবই প্রয়োজন হয়ে ওঠে। সে বুঝতে পারছিল না তাকে কোনটা গ্রহন করা উচিত। তখন সে তার মায়ের সাথে কথা বলে এবং জানতে চায় তাকে কোনটা করা উচিত।
তিনি তার মাকে বলেন,‘মা আমি দুইটি কাজ ঠিকভাবে করতে পারছি না। আমাকে এই মুর্হুতে কোন কাজটি বেছে নেওয়া উচিত? আমি চাই হয় স্কুল অথবা মিউজিক, যাতে আমি ভালভাবে আমার কাজে মনযোগ দিতে পারি। তখন তার মা পরাশুনা ছেড়ে মিউজিকের উপর ফোকাস করতে বলেন।
বর্তমানের এ আর রাহমানের মতে তার মায়ের ঐ দিনের সিদ্ধান্ত তাকে আজকের এ আর রাহমান হতে সাহায্য করেছে। কারন ঐ সময় তিনি সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না। তিনি বুঝতে পারছিলেন না কোনটা তার জন্য সঠিক আর কোনটা তার জন্য ভুল। সবাই স্কুলে পরাশুনা করে সফল হয় কিন্তু মিউজিকের জন্য পরাশুনা ছেড়ে দেওয়ায় রাহমান কিছুটা অনিশ্চয়তার মধ্যে পরেন।
তার মা ঐ দিন তার সকল কনফিউশন দুর করে তার স্বপ্নের পথে যেতে বলেন। এটি তার জন্য এমন একটি পথ ছিল যার মাধ্যমে সে শুধু ভারত নয়, সারা বিশ্বের উজ্জল নক্ষত্র হয়ে উঠেছেন। রাহমান বলেন তার বাবার মৃত্যুর পরে তার পরিশ্রম ও তার মায়ের দেওয়া ঐ দিনের সিদ্ধান্ত তাকে আজকের এ আর রাহমান বানিয়েছে।
১৯৮০ থেকে ১৯৯০ সাল ছিল তার ক্যরিয়ারের জন্য একটি বিশেষ সময়। এই সময় এ আর রাহমান তার সকল মনোযোগ কাজের উপর নিয়ে আসেন। তিনি তখন বিভিন্ন মিউজিক ডিরেক্টর দের মিউজিক কম্পোস করতেন। তখন তার মুভিতে স্বাধীনভাবে মিউজিক তৈরি করার কোন চিন্তা ভাবনা ছিল না।
মিউজিকের উপর নিজের দক্ষতাকে বাড়ানোর জন্য তার কাছে যা বাদ্যযন্ত্র ছিল তাই দিয়ে মিউজিকের কাজ করতে শুরু করেন। তিনি তখন শুধু টিভি বিজ্ঞাপন ও কমার্শিয়াল পর্যায়ে মিউজিক তৈরি করতেন। এই কাজের ফলে সে ঐ সময়ে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। তখন দক্ষিন ভারতীয় অনেক বড় বড় কোম্পানির বিজ্ঞাপন এর মিউজিকের জন্য তৈরি করতেন।
পরিশেষে এমন একটি সময় আসে যখন সে তার বাবার অকালে চলে যাওয়ায় পরিবারের বেহাল দশা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হন এবং পরিবারের জন্য একটি ভাল আয় করতে শুরু করেন।
১৯৮৮ সালে এ আর রাহমান হিন্দু ধর্ম থেকে ইসলাম ধর্ম গ্রহন করেন। তার নাম দিলিপ কুমার পরিবর্তন করে রাখেন আল্লা রাখা রাহমান ( এ আর রাহমান)। যখন রাহমানের বয়স ২১ বছর তখন তার বোন (যার বর্তমান নাম এ আর রেহেনা) খুব অসুস্থ হয়ে পরেন।
তাকে অনেক যায়গায় চিগিৎসা করানোর পরেও তাকে সুস্থ করা যায়নি। তারা তার বোন কে নিয়ে ভীষন বিপদের সম্মুক্ষীন হয়। কারন তার বাবারও যখন মৃত্য হয় তখন তার বাবাও তার বোনের মত এমন একটি দূরারোগ্য রোগে আক্রন্ত হয়ে ছিলেন। তাই রাহমানের পরিবার আরও চিন্তিত হয়ে পরেন।
তখন তিনি তার এক বন্ধুর পরার্মশে তার বোনকে নিয়ে শেখ আবদুল কাদির জিলানি নামে এক মুসলিম পিরের দরগায় যান। সেখানে থাকা এক মুসলিম পীরের সৎ উপদেশ ও আল্লার রাহমতে তার বোন ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে যায়। এই ঘটনার পর তাদের পরিবারের ইসলাম ধর্মের উপর বিশ্বাস চলে আসে।
এছাড়ও তার বাবার মৃত্যুর সময় ও সমাজের অবহেলা ও তার বোনের অসুখের সময়ে পিরের সৎ উপদেশ তরুন দিলিপ কুমারকে ভিষন ভাবে প্রভাবিত করে। যার ফলে দিলিপ ও তার পুরো পরিবার ইসলাম ধর্ম গ্রহন করেন।
এক সমেয়ে তার মিউজিকের প্রতি অনিহা আসতে শুরু করে কারন তিনি যে শ্রেণির মিউজিক তৈরি করতে চাইতেন তার সুযোগ তিনি পাচ্ছিলেন না। কিন্তু ঐ সময়ে সে এমন একটি সুযোগ পান , যার মাধ্যমে তার পুর ক্যারিয়ার পরিবর্তন হয়ে যায়। ১৯৯০ সালের দিকে মানি রাতনাম নামে একজন মুভি ডিরেক্টর ছিলেন, যিনি এক এর পর এক হিট মুভি তৈরি করতেন।
তিনি তার মুভিতে অতুলনীয় মিউজিকে এর কাজের জন্যও বিখ্যাত ছিলেন। তিনি তখন একটি নতুন মুভির কাজ করছিলেন। সেই মুভিতে মিউজিকের জন্য তিনি ভাল ও দক্ষ মিউজিশিয়ান খুজছিলেন। তখন তিনি এ আর রাহমানের নাম শোনেন তাকে তার মুভির জন্য কাজ করতে বলেন।
যখন রাহমান এই প্রস্তাব পায় তখন সে খুবই বিশ্মিত হয়ে যান। কারন মানি রাতনাম ঐ সময়ে দক্ষিন ভারতের একজন বিখ্যাত মুভি ডিরেক্টর ছিলেন এ আর রাহমান তখনও শুধু বিজ্ঞাপনের জন্য মিউজিক তৈরি করতেন। একদিন মানি রাতনাম রাহমানের স্টুডিওতে আসেন। রাহমান খুবই ঘাবরে গেলেও তার সেরাটি দিয়ে মানি রাতনামকে তার মিউজিক শোনান।
আরও পড়ুনঃ দক্ষিণ ভারতীয় অভিনেত্রী কাজল আগারওয়াল এর জীবনী
মানি রাতনাম তার মিউজিক শোনেন এবং কিছু না বলেই সেখান থেকে চলে যান। রাহমান ভেবেছিলেন মানি রাতনাম এর কাছে তার কোন সুরই ভাল লাগেনি। কিন্তু মানি রাতনাম তার মিউজিক শুনে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। পরবর্তিতে তিনি এ আর রাহমানকে দিয়ে কাজ করাতে রাজি হন।
তখন তাদের সম্মিলিত কাজে ‘রোজা’মুভি তৈরি হয়। যা ঐ সময়ে অন্যতম সেরা মুভি ছিল। এই মুভির কাহিনির থেকে এর গান গুল দর্শকের কাছে বেশি জনপ্রিয়তা পায়। শুধু দক্ষিন ভারতেই নয় বরং পুর ভারতেই সমান জনপ্রিয়তা পায়। তারপর আর তাকে পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। একের পর তিনি এক হিট মুভিতে কাজ করেন।
তিনি তার ক্যারিয়ারে বেশ কয়েকটি এওর্য়াড পান তার মধ্যে উল্লেখযগ্য হল ‘জায় হো’গানের জন্য তিনি বিশ্বের অন্যতম সম্মানিত পুরস্কার অস্কার পান। ভারত সরকার কর্তৃক প্রদত্ত তৃতীয় সর্বোচ্চ নাগরিক পুরুষ্কার পদ্মভূষন, ফ্লিম ফেয়ার পুরুস্কারসহ অসংখ্য পুরুস্কার রয়েছে তার ক্যারিয়ারে। বর্তমানে এ আর রাহমান মুম্বাই-এ একটি বাড়ি কিনে সেখানে বসবাস করছেন।
মন্তব্য লিখুন