বিনোদনের একটি জনপ্রিয় মাধ্যম হলো সিনেমা। সেটি হোক আমাদের দেশীয় সিনেমা কিংবা বলিউড, হলিউড সবই আনন্দের সাথে গ্রহণ করেছে বাংলাদেশি দর্শক। আর বাংলাদেশি দর্শকদের সিনেমা দেখার চাহিদা আরো বহুগুন বেড় যায় যখন বাংলাদেশী কোনো অভিনেতা বা অভিনেত্রী অন্য কোনো দেশের সিনেমায় অভিনয় করে। বাংলাদেশি অনেক অভিনেতা এবং অভিনেত্রী কলকাতার বাংলা সিনেমা এবং বলিউড সিনেমায় অভিনয় করেছেন এটা নতুন কিছু নয়। তবে আমাদের দেশের একজন অভিনেত্রী হলিউড সিনেমাতে অভিনয় করেছেন এটা অবশ্যই গর্বের বিষয়। “নায়লা আজাদ নূপুর” হলো প্রথম ও একমাত্র বাংলাদেশি যে হলিউড সিনেমায় অভিনয় করেছেন।
নায়লা আজাদ নূপুর -কে হয়তো অনেকই চেনেন। আবার অনেকে হয়তো কখনো তার নামই শোনেননি। নায়লা আজাদ নূপুর ছিলেন ১৯৮০’র দশকে বাংলাদেশের মঞ্চ নাটক এবং টিভি নাটকের একজন পরিচিত মুখ। শুধু মঞ্চ নাটক ও টিভি নাটক নয় তিনি অভিনয় করেছেন অসাধারণ কিছু বাংলাদেশি চলচ্চিত্রে। দেশের নাটক-সিনেমার পাশাপাশি তিনি হলিউড সিনেমাতেও অভিনয় করেছেন।
নায়লা আজাদ নূপুর এর জন্ম ১৯৫৮ সালের ৬ই ফেব্রুয়ারী ঢাকায়। ১৯৭৩ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় বানিজ্য বিভাগ থেকে মেধা তালিকায় দেশের প্রথমস্থান অর্জন করেন।
তিনি তার অভিনয় জীবন শুরু করেন মঞ্চ নাটকের মাধ্যমে। ১৯৭৪ সালে রত্নদ্বীপ নাটকের মাধ্যমে টিভি নাটকে তার অভিষেক ঘটে। এই নাটকটি বিটিভি তে প্রচারিত হতো। থিয়েটারের প্রতি তার আগ্রহ ছিলো অনেক।
১৯৭৯ সালে ভারতের পুনে থেকে থিয়েটারের উপর ৮ মাসের ডিপ্লোমা কোর্স করেন। কোর্স শেষে তিনি ঢাকায় ফিরে আসেন এবং ঢাকা থিয়েটারে কাজ শুরু করেন।
ঢাকা থিয়েটারের অনেক মঞ্চ নাটকে অভিনয় করেছেন তিনি। নায়লা আজাদ নূপুর ঢাকা থিয়েটারের একজন নিবেদিত কর্মী ছিলেন। তিনি একাধারে একজন অভিনেত্রী, নৃত্যশিল্পী এবং নাট্য নির্দেশক।
মঞ্চ নাটক ও টিভি নাটকের মতো চলচ্চিত্রেও প্রতিভার ছাপ রাখেন “নায়লা আজাদ নুপুর”। ১৯৮০ সালে সৈয়দ সালাউদ্দীন জাকি’র “ঘুড্ডি” সিনেমায় অভিনয়ের মাধ্যমে চলচ্চিত্রে অভিষেক ঘটে তার। এরপর ১৯৮২ সালে কিংবদন্তি পরিচালক আলমগীর কবির এর “মোহনা” সিনেমায় অভিনয় করেন। এছাড়াও “দহন” ও “শক্তি” নামে দুটি সিনেমায় তাকে দেখা যায়।
নায়লা আজাদ নূপুর এর ইচ্ছে ছিল থিয়েটার নিয়ে উচ্চ শিক্ষার। সেই সুযোগ চলে আসে ১৯৮৯ সালে। তিনি স্কলারশিপ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অ্যান্টিয়াক ইউনিভার্সিটিতে থিয়েটার নিয়ে পড়তে যান। সেখান থেকে তিনি তার স্নাতক ডিগ্রি সম্পন্ন করেন।
পরবর্তীতে ১৯৯৭ সালে তিনি ‘ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া’ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। পড়াশোনা শেষে তিনি যুক্তরাষ্ট্রেই স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।
যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরুর পর থেকে তিনি বিভিন্ন স্টেজ শো, স্বল্পদৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র এবং প্রামাণ্যচিত্রে অভিনয় করা শুরু করেন।
নায়লা আজাদ নূপুর ১৯৯৮ সালে ‘স্টর্ম ইন দ্য আফটারনুন’ সিনেমায় অভিনয়ের সুযোগ পায়। এই সিনেমার মাধ্যমে হলিউড সিনেমায় অভিষেক ঘটে তার।
‘স্টর্ম ইন দ্য আফটারনুন’ সিনেমায় চারটি কেন্দ্রীয় চরিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে যার একটিতে অভিনয় করেছেন নায়লা আজাদ নূপুর।
সিনেমাটিতে আমেরিকায় অবস্থানরত ইমিগ্রেন্টদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংঘাতের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। হলিউড সিনেমায় সচরাচর যেভাবে বাংলাদেশি ও ভারতীয় ইমিগ্রেন্টদের দেখানো হয় এই সিনেমায় তা দেখানো হয়েছে সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে। এই সিনেমায় অভিনয় করার মাধ্যমেই প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে হলিউড সিনেমায় অভিনয় করার কৃতিত্ব অর্জন করেন নায়লা আজাদ নূপুর।
তিনি হলিউডে ব্যাপকভাবে পরিচিতি পায় ২০০৯ সালে ‘ক্রসিং ওভার’ সিনেমায় অভিনয় করার মাধ্যমে। ‘ক্রসিং ওভার’ সিনেমাটি পরিচালনা করেন ওয়েন ক্র্যামার এবং সিনেমায় কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেন জনপ্রিয় হলিউড তারকা হ্যারিসন ফোর্ড।
এই সিনেমার কাহিনী গড়ে উঠেছে আমেরিকায় সন্ত্রাসী হামলাকে কেন্দ্র করে। এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত বিভিন্ন দেশ থেকে আসা অবৈধ অভিবাসীদের জীবন তুলে ধরা হয়েছে।
এমনই একটি বাংলাদেশি অভিবাসীদের পরিবারের সদস্য নায়লা আজাদ নূপুর। তার চরিত্রটির নাম রোকেয়া জাহাঙ্গীর। সিনেমাটিতে বেশ কিছু বাংলা সংলাপও রয়েছে।
সিনেমার পাশাপাশি নায়লা আজাদ নূপুর হলিউডের দু’টি জনপ্রিয় টিভি সিরিজে অভিনয় করেছেন। ফক্স টিভির ‘লাই টু মি’ সিরিজে ছোটো একটি চরিত্রে দেখা গিয়েছে তাকে।
নায়লা আজাদ নূপুর স্থায়ীভাবে যুক্তরাষ্ট্রে থাকলেও মাঝে মাঝে ছুটিতে দেশে এসে বেশ কয়েকটি নাটক ও সিনেমায় অভিনয় করেছেন।
অভিনিত সিনেমা সমূহঃ
ঘুড্ডি’ (১৯৮০), ‘মোহনা’ (১৯৮৩), ‘দহন’ (১৯৮৫), ‘কিত্তনখোলা’ (২০০০), ‘ঘাসফুল’ (২০১৫), ‘বাঙালি বিউটি’ (২০১৮) ইত্যাদি।
টিভি নাটক সমূহঃ
‘রত্নদ্বীপ’ (১৯৭৪), ‘নিশিত তৃষ্ণায়’ (১৯৮০), ‘আওরঙ্গজেব’ (১৯৮২), ‘আয়না’ (১৯৮২) ‘শেষ বংশধর’, ‘ভালোবাসি ঘাস’, ‘কোথায় যাব আমি কীসের বিচার চাইবো’, ‘ক্যাক্টাস’, ‘যাদুর শহর’ (২০১১), ইতি বৃত্তান্ত (২০১৫) ইত্যাদি।
মঞ্চ নাটক সমূহঃ
‘কেরামত মঙ্গল’, ‘শকুনতলা’, ‘মুন্তাসির ফ্যান্টাসি’, ‘ফণীমনসা’, ‘কিত্তনখোলা’ ইত্যাদি।
দীর্ঘ ২৫ বছর যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাস জীবন কাটিয়ে নায়লা আজাদ নূপুর ২০১৪ সালে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য বাংলাদেশে ফিরে আসেন। বর্তমানে তিনি দুটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন।
এছাড়াও একটি ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট ফার্মে আর্ট ডিরেক্টর হিসেবে কর্মরত আছেন তিনি। পাশপাশি তিনি বেশ কিছু মঞ্চ নাটকের নির্দেশনা দিয়েছেন। তাঁর অভিনীত ‘প্রতিরুদ্ধ’ সিনেমাটি বর্তমানে প্রক্রিয়াধীন আছে।
দেশে যদি যথাযথ কাজের সুযোগ পান তাহলে আর যুক্তরাষ্ট্রে ফিরবেন না “নায়লা আজাদ নূপুর”। দেশেই তিনি ভালো কাজের সুযোগ পাক এবং এগিয়ে নিয়ে যাক আমাদের সাংস্কৃতিক মাধ্যমকে এই কামনাই আমরা করি। অনেক অনেক শুভেচ্ছা শুভকামনা রইলো হলিউডে অভিনয় করা প্রথম বাংলাদেশি অভিনেত্রী নায়লা আজাদ নূপুর এর জন্য।
মন্তব্য লিখুন