মহাজাগতিক বস্তু গুলোর মধ্যে অন্যতম রহস্যময় এক বিস্ময় ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণগহ্বর। আমাদের সাধারণ বিচারবুদ্ধি দিয়ে ব্ল্যাকহোল অনুধাবন করা কিছুতেই সম্ভব নয়, কারণ এমন কোন কিছুর অস্তিত্ব মানুষ কখনও সরাসরি প্রত্যক্ষ করেনি।
মহাজাগতিক বস্তু চোখে দেখা না গেলেও এর উপস্থিত তো অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই কারণ ব্ল্যাকহোলের পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন মহাজাগতিক বস্তু থেকে এদের অস্তিত্বের সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়।
আর্টিকেলে যা থাকছেঃ
বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী আইস্টাইন এর আপেক্ষিতার সূত্রানুসারে স্থান ও সময় এর প্রতিনিয়ত পরিবর্তনের ফলে বদলে যাচ্ছে সম্পূর্ণ সৃষ্টিজগত। আর এই জগতের অন্যতম উপাদান হল ব্ল্যাক হোল। ব্ল্যাক হোল মহাকাশের এক অদ্ভুত বিস্ময়কর উপাদান। বাংলায় একে বলা হয় কৃষ্ণগহ্বর বা কৃষ্ণবিবর।
ব্ল্যাক হোল বলতে মূলত আমরা একটা কালো গর্তকেই বুঝি।আমরা যদি মহাবিশ্বকে একটা সমতল কাপড়ের সাথে তুলনা করি, তাহলে দেখা যাবে কাপড়ের কোন স্থানে যদি কোন ভারি বস্তু রাখা হয় তাহলে স্বাভাবিক ভাবেই কাপড়ের যেখানে ভারি বস্তুটি রাখা হয়েছে সেখানে কাপড়টি একটু নিচে নেমে যাবে।
ঠিক তেমনি মহাবিশ্বের কোনো স্থানে অস্বাভাবিক ভর কেন্দ্রভূত হলে সেখানে গর্তের ন্যায় সৃষ্টি হয়। যা কৃষ্ণ গহ্বর বা কালো গর্ত মানেও পরিচিত। ব্ল্যাকহোল মহাকাশের এমন এক অঞ্চল যেখানে মহাকর্ষ বল অত্যন্ত প্রবল। এই অঞ্চলে আয়তনের তুলনায় ভর অনেক বেশি , যার কারণে মহাকর্ষ বল অনেক প্রবল।
মহাকর্ষ বল এতো প্রবল হওয়ার কারণে তড়িৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গ আলো ও সেখান থেকে বের হয়ে আসতে পারে না।যার কারণে বস্তুটিকে দেখাও সম্ভব নয়,কিন্তু এট অস্তিত্বকেও অস্বীকার করা সম্ভব নয়।
আপেক্ষিকতার তত্ত্ব অনুসারে ব্ল্যাক হোল মহাবিশ্বের এমন এক স্থান যেখানে মহাকর্ষীয় বল অত্যন্ত প্রবল। কোনো একটা বস্তুর আয়তনের তুলনায় ভর ও ঘনত্ব অনেক বেশি হলে সেই সব বস্তু ব্ল্যাক হেলে পরিণত হতে পারে। খুব অল্প কোনো স্থানে অনেক ভর একত্রিত হলে সেটি স্বাভাবিক অবস্থায় থাকতে পারে না।
কোনো তারকা বা নক্ষত্রের জ্বালানী শেষ হয়ে গেলে এটি চুপসে গিয়ে ব্ল্যাক হোলে পরিণত হয়।এখানে মহাকর্ষীয় বল এতোটাই বেশি যে এখান থেকে কোন বস্তু বের হয়ে আসতে পারে না এমন কি আলো ও বের হয়ে আসতে পারে না।
আমরা ইতিমধ্যেই জেনেছি ব্ল্যাক হোলে প্রবল মহাকর্ষ বলের প্রভাবে সেখান হতে কোন কিছুই বের হয়ে আসতে পারে না। কোন বস্তু যদি নির্দিষ্ট সীমায় না থাকে অর্থাৎ নির্দিষ্ট সীমা পার করলে সে ব্ল্যাক হোলের শিকার হয়ে যেতে পারে।
ব্ল্যাক হোল কখনো দেখাও সম্ভব না তবে ব্ল্যাকহোলের নামে যা দেখা যেতে পারে তা হল এর চারদিকের সীমানা। চারদিকের এই সীমানাকে বলা হয় ইভেন্ট হরাইজন বা ঘটনা দিগন্ত কোন বস্তু এই সীমানা অতিক্রম করার সাথে সাথে তা ব্ল্যাকহোলের অতল গহ্বরে হারিয়ে যায়।
যখন নক্ষত্রের বাইরের তাপমাত্রার চাপে ভেতরের মধ্যাকর্ষন বাড়তে থাকে, তখন সেই বলের কারণে নক্ষত্র চুপসে যেতে শুরু করে। সমস্ত ভর একটি বিন্দুতে পতিত হতে শুরু করে। এটি ধীরে ধীরে ছোট এবং অধিক ঘনত্বে আসতে শুরু করে এবং এক সময় সমস্ত ভর একটি ছোট্ট বিন্দুতে ভিড় করে যার নাম সিঙ্গুলারিটি।
ভূতত্ত্ববিদ জন মিচেল (John Michell) ১৭৮৩ সালে তিনি তিনি একটি চিঠিতে রয়েল সোসাইটির সদস্য এবং বিজ্ঞানী হেনরি ক্যাভেন্ডিসকে (Henry Cavendish) সর্বপ্রথম ব্ল্যাক হোল সম্পর্কে লিখে জানান। তিনি বলেছিলেন, বিপুল পরিমাণ ভর বিশিষ্ট কোন বস্তু, যার মহাকর্ষ বলের প্রভাবে আলোক তরঙ্গ পর্যন্ত বের হয়ে আসতে পারে না।
১৭৯৬ সালে গণিতবিদ পিয়েরে সিমন ল্যাপলেস একই মতবাদ প্রদান করেন তার Exposition du système du Monde বইয়ের প্রথম ও দ্বিতীয় সংস্করণে। কৃষ্ণ গহ্বর সম্পর্কে মতামত উনবিংশ শতাব্দীতে আরও প্রকট ভাবে বেড়ে যায়। ১৯১৫ সালে আইনস্টাইন আপেক্ষিকতার সূত্র আবিষ্কারের পর বলেছিলেন ব্ল্যাক হোল থাকা সম্ভব।
১৯১৬ সালে জার্মান পদার্থবিদ গার্ল শোয়ার্জশিল্ড আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব ব্যবহার করে হিসেব করেন কোনো একটি বস্তু ব্ল্যাকহোলে পরিণত হতে পারে যদি তাকে যথেষ্ট সংকুচিত করা যায়।
এই তথ্যের মাধ্যমে ব্ল্যাকহোলের ধারণা মানুষের সামনে আসেন। দীর্ঘদিন এই তত্ত্ব আলোচনা পর্যায়ে থাকলেও ১৯৭১ সালে বিজ্ঞানীরা Constellation Cysnus (বক মন্ডল) পর্যবেক্ষেণ করতে গিয়ে প্রথম ব্ল্যাক হেল আবিষ্কার করে।
২০১৭ সালে ইভেন্ট হরাইজন টেলিস্কোপ দ্বারা মেসিয়ে ৮৭ ছায়াপথের কেন্দ্রে অবস্থিত অতিভারী কৃষ্ণগহ্বরের পর্যবেক্ষণের পর, দীর্ঘ বিশ্লেষণ শেষে ১০ এপ্রিল ২০১৯ সালে প্রথমবারের মত একটি কৃষ্ণবিবর ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের প্রত্যক্ষ চিত্র প্রকাশিত হয়।
ব্ল্যাক হোল বিভিন্ন আকারের হতে পারে। মহাবিশ্বে এত বিপুল পরিমাণ ব্ল্যাকহোল ছড়িয়ে আছে যা বিজ্ঞানীদের ধারণারও বাইরে। আমরা যে গ্যালাক্সিতে বসবাস করি যা মিল্কিওয়ে বা আকাশগঙ্গা নামে পরিচিত, এখানে ছোট-বড় মিলে দশ লক্ষেরও অধিক ব্ল্যাক হোল ছড়িয়ে আছে।
সবচেয়ে বেশি পরিচিত ব্ল্যাকহোল হল স্টেলার ব্ল্যাক হোল এবং সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোল। স্টেলার ব্ল্যাক হোল সূর্যের ভরের চেয়ে ১০ থেকে ২০ গুণ বেশি হয় ।
প্রত্যেক গ্যালাক্সির কেন্দ্রে অন্তত একটি করে সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোল থাকতে পারে। এমনকি আমরা যে আকাশগঙ্গা নামক গ্যালাক্সিতে বসবাস করি এর কেন্দ্রও Sagittarius-A নামে । একটি ব্ল্যাকহোল রয়েছে যার ভর সূর্যের চেয়ে 40 লক্ষ গুণ বেশি এবং ব্যাস পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব সমান।
আরও পড়ুনঃ বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল -পৃথিবীতে ব্যাখ্যাতীত ঘটনা ঘটে নাকি পুরোটাই মিথ
সবচেয়ে আশ্চর্য ব্যাপার হলো এগুলো সম্পূর্ণ অদৃশ্য এবং এখনো পর্যন্ত যত সব চিত্র দেখানো হয়েছে তার সবই বিজ্ঞানীদের কল্পনা আর শিল্পীদের বিশ্বাসযোগ্যতায় তৈরি করা।মহাজাগতিক বস্তু চোখে দেখা না গেলেও এর উপস্থিত তো অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। কারণ ব্ল্যাকহোলের পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন মহাজাগতিক বস্তু থেকে এদের অস্তিত্বের সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়।
কৃষ্ণ গহ্বরগুলো যদি স্টেলার বা ছোট গহ্বর হয় তাহলে প্রবল মহাকর্ষ বলের প্রভাবে আপনার দেহ চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাবে । আর ঘটনাটি যারা পর্যবেক্ষণ করবে তারা দেখবে আপনি কৃষ্ণগহ্বরে আস্তে আস্তে প্রবেশ করছেন , আপনার দেহ ক্রমশ অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে, কারণ সেখান থেকে আলো প্রতিফলিত হতে পারবে না।
আর যদি কৃষ্ণ গহ্বরটি Super massive ব্ল্যাক হোল হয় তাহলে আপনি কিছুটা ভ্রমণ করতে পারবেন এরপর আপনি ডেট জোনে প্রবেশ করবেন এবং আগের ঘটনা ঘটবে।
ইভেন্ট হরাইজনের প্রান্তে একটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্র রয়েছে যাকে বলা হয় The Photon Sphere . এ পর্যায়ে এসে আলো কৃষ্ণগহ্বরকে আবর্তন করতে থাকে এজন্য ব্ল্যাক হোলের চারপাশে আলো দেখতে পাওয়া যায়।
ব্ল্যাক হোল দেখা না গেলেও এর অস্তিত্বকে অস্বীকার করার সাধ্য নেই। ব্ল্যাক হোল পৃথিবী বা কোন গ্রহের কাছাকাছি অবস্থিত নয়। ।বলে পৃথিবী বা কোন গ্রহ ব্ল্যাক হোলের শিকার হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
মন্তব্য লিখুন