নাতিশীতোষ্ণ শব্দটির সাথে নিশ্চয়ই পরিচিত আছেন সবাই। নাতিশীতোষ্ণ শব্দের সহজ-সরল মানে হলো “না গরম না ঠান্ডা”। অর্থাৎ গরম ও ঠান্ডার মাঝামাঝি একটা অবস্থা। যেমন আমাদের দেশের আবহাওয়া। আমাদের দেশে যেমন ছয়টি ঋতু দেখা যায় অনেক দেশে কিন্তু মাত্র দুটি ঋতু দেখা যায় গ্রীষ্মকাল এবং শীতকাল।
আমাদের দেশে গ্রীষ্মকাল ও শীতকালে যথাক্রমে মাঝারি মানের গরম ও মাঝারি মানের শীত অনুভব হয়।কিন্তু গ্রীষ্ম প্রধান দেশগুলোতে প্রচন্ড গরম এবং শীত প্রধান দেশগুলোতে প্রচন্ড শীত অনুভব হয়। আবার কিছু কিছু দেশ তো সারা বছরই বরফে বা তুষারে ঢাকা থাকে। যেমন পূর্ব সাইবেরিয়া, গ্রীনল্যান্ড, আলাস্কা, কানাডা ইত্যাদি শীতপ্রধান দেশ। আর এই শীত প্রধান দেশগুলোতে যারা বাস করে তাদের বলা এস্কিমো।
এই শীত প্রধান দেশগুলোতে গেলে চোখে পরবে অপূর্ব সুন্দর এক স্থাপত্য শিল্প কর্ম, নাম ইগলু। না না ইগলু কোনো আইসক্রিমের কোম্পানি নয়। ইগলু হলো বরফ বা তুষার দিয়ে তৈরি এক ধরনের গম্বুজ আকৃতির ঘর। এস্কিমোরা প্রচন্ড শীত থেকে বাঁচতে এবং নিজেদেরকে উষ্ণ রাখার উদ্দেশ্যে এই ইগলু বা বরফের ঘর তৈরি করে।
আশা করি একটু হলেও অবাক হয়েছেন। অবাক হবারই কথা। বরফের তৈরি ঘর কীভাবে এর ভেতরে থাকা মানুষদেরকে উষ্ণ রাখতে পারে! হ্যাঁ এটাই ঘটে ইগলুর ভেতরে। এটি কীভাবে সম্ভব তাই নিয়েই আজকের আলোচনা। তবে তার আগে এস্কিমোদের সম্পর্কে দু একটা কথা জেনে নেওয়া দরকার।
আগেই বলেছি যে সকল দেশ সারা বছর তুষারে ঢাকা থেকে তাদের বলে শীত প্রধান দেশ। আর এসব দেশে যারা বাস করে তাদের বলে এস্কিমো। অনেকের ধারণা এই এস্কিমোদের পূর্বপুরুষ হলো মঙ্গোলিয়ান উপজাতি। তবে হ্যাঁ শীতপ্রধান দেশের সবাই কিন্তু ইগলুতে থাকে না,সেখানে ও দালান বাড়ি আছে, যাতায়াতের জন্য গাড়ি আছে।
এস্কিমোদের প্রধান পেশা হলো মৎস্য শিকার। যেহেতু সারা বছর তুষারে মাটি ঢাকা থাকে তাই এখানে কৃষিকাজ সম্ভব হয় না। এরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সামুদ্রিক সীল মাছ শিকার করে এবং কাঁচা অথবা আগুনে পুড়িয়ে খায়।সীল মাছে অধিক পরিমাণে ফ্যাট থাকে যা এস্কিমোদের শরীর গরম রাখে। এরা যাতায়াতের জন্য কুকুর টানা স্লেজ গাড়ি ব্যবহার করে।
এবার তাহলে মূল আলোচনায় আসি। বরফের তৈরি ইগলু কিভাবে এর ভেতরের মানুষকে উষ্ণ রাখে। এই বিষয়টি বুঝতে চাইলে একটা ছোট প্রশ্নের উত্তর দিন। বলুন তো শীতকালে আমরা গরম পোশাক পরিধান করি কেন?
আপনি যদি বলেন যে,বাইরের শীত থেকে বাঁচতে, তাহলে আপনি আংশিক সঠিক উত্তর দিয়েছেন। কারণ আমরা শীতবস্ত্র পরিধান করি শুধু মাত্র বাইরের ঠান্ডা থেকে বাঁচার জন্য নয়। সেইসাথে যেন আমাদের শরীরের তাপ বাইরে যেতে না পারে একারণে ও। কারণ শীতবস্ত্র হলো তাপের কুপরিবাহী। অর্থাৎ শীতবস্ত্র শরীরে তাপ বাইরে যেতে দেয় না এবং বাইরের ঠান্ডা হাওয়া শরীরে ঢুকতে দেয় না। ঠিক এই একই কাজ করে ইগলু। বরফ হলো তাপের কুপরিবাহী। বরফের তৈরি ইগলুতে বাইরে থেকে ঠান্ডা বাতাস প্রবেশ করতে পারে না। অপরদিকে আমাদের শরীর থেকে প্রতিনিয়ত যে তাপ নির্গত হয় তা ইগলুর বাইরে যেতে পারে না। ফলে ইগলুর ভিতরের তাপমাত্রা কিছুটা বৃদ্ধি পায়। এছাড়াও ইগলুর ভিতরের তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য ইগলুর ভিতরে আগুন জ্বালানোর ব্যবস্থা থাকে।
এবার তাহলে ইগলু কিভাবে তৈরি করা হয় সে সম্পর্কে জেনে নেই। ইগলু তৈরির প্রধান উপকরণ হলো তুষার। আপনি চাইলে তুষার জমে অনেক পুরু হয়ে আছে এমন জায়গা থেকে ব্লক আকারে তুষার কেটে নিতে পারেন। কিন্তু এক্ষেত্রে একটা বড় সমস্যা হলো আপনি হয়তো একই আকারের ব্লক কাটতে পারবেন না। তাই আয়তাকার অথবা বর্গাকার কোনো পাত্রে তুষার ভরে ভালো করে চাপা দিয়ে একই আকারের ব্লক তৈরি করে নিতে পারবেন। এরপর যেখানে ইগলুটি তৈরি করতে চান সেখানে তুষারের ব্লকগুলো খাড়া করে বসিয়ে একটি বৃত্তাকার গঠন তৈরি করা হয়। এরপর এই ব্লকগুলো ছুরি দিয়ে কেটে একটা ঢালের মতো আকার করা হয়।
এরপর একের পর এক তুষার ব্লক সাজালে সহজেই গম্বুজ আকার তৈরি হয়। যদি সম্পুর্ণ ইগলুটি তুষারের ব্লক দিয়ে তৈরি করা হয় তাহলে ইগলু’র ভিতরে বেশ অন্ধকার থাকে তাই, অনেকই ইগলুর ছাদে তুষারের পরিবর্তে স্বচ্ছ বরফের ব্লক ব্যবহার করে। অনেকে আবার স্বচ্ছ বরফের ব্লক দিয়ে ইগলুর জানালাও তৈরি করে। ইগলুর উপরের দিকে একটি ছোট ছিদ্র রাখা হয় যাতে করে বাইরে থেকে অক্সিজেন ঢুকতে পারে এবং ভিতরের কার্বনডাই-অক্সাইড বের হয়ে যেতে পারে। ইগলুতে প্রবেশের জন্য একটা দরজা রাখা হয়। এই হলো একটি ইগলু’র বাহ্যিক গঠন।
একটি ইগলু’র ভিতরে সাধারণত তিনটি অংশ থাকে। সবার উপরের অংশে মানুষ থাকে বা ঘুমায়। মাঝের অংশে আগুন জ্বালানোর ব্যবস্থা করা হয়, এবং সবার নিচের অংশে ঠান্ডা পানি জমা হয়। একটা প্রশ্ন মাথায় আসতেই পারে যে আগুন জ্বালালে তুষার গলে যায় কিনা? উত্তর হলো না।কারণ খুব বড় আকারে আগুন জ্বালানো হয় না যে তুষার গলে যাবে।
হয়তো একটি পাত্রে আগুন জ্বালিয়ে সেটিকে আবার ঢেকে রাখা হয়। যদি প্রথম দিকে কিছু তুষার গলে যায় ও সেটুকু ইগলুর নিচের অংশে ঠান্ডা পানি হিসেবে জমা হয়। এভাবেই ইগলুর ভিতরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি করা হয়। বাইরে যদি -৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা থাকে তাহলে ইগলুর ভিতর তাপমাত্রা হবে প্রায় ২০/২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা আমাদের দেশের তীব্র শীতের তাপমাত্রা।
এস্কিমোরা তাদের থাকার জন্য ইগলু তৈরি করে। একটি মাঝারি আকারের ইগলুতে দুজন মানুষ থাকতে পারে। বেশি মানুষ থাকার জন্য অনেকগুলো ইগলু তৈরি করতে হয়। এক ইগলু থেকে অন্য ইগলুতে যাবার জন্য তুষারের নিচ দিয়ে সুড়ঙ্গ তৈরি করা হয় । দুজন পারদর্শী এস্কিমো মাত্র দুই থেকে তিন ঘন্টার মধ্যে একটি মাঝারি মানের ইগলু তৈরি করতে পারে। এভাবেই এস্কিমোরা জীবন যাপন করে এবং শীত থেকে বাঁচার জন্য হীম শীতল বরফ বা তুষার দিয়েই শীত নিবারন করে।
মন্তব্য লিখুন