নারী ও পুরুষের নামাযের মধ্যে পার্থক্য আছে কিনা? এ নিয়ে আমাদের উপমহাদেশে কম বিতর্ক নেই৷ একদল আলেম বলেন নারী-পুরুষের নামাযে পার্থক্য রয়েছে । আবার অন্যদল বলেন, নারী হোক বা পুরুষ হোক নামাযের পদ্ধতি একই কোনো পার্থক্য নেই৷ এখন প্রশ্ন হচ্ছে হাদিসে নারী-পুরুষের নামাযের পার্থক্য রয়েছে কিনা? এসম্পর্কে হাদিস শরিফে কি বর্নিত হয়েছে?
আলেমদের সকল মতামত কে শ্রদ্ধাসহিত সামনে রেখে, আজ আমরা হাদিসে নারী-পুরুষের নামাযের পার্থক্য সম্পর্কে একটি যথাযথ সিদ্ধান্ত গ্রহনের চেষ্টা করবো, ইনশাআল্লাহ ।
আর্টিকেলে যা থাকছেঃ
নারী ও পুরুষের নামাযে বেশ কিছু পার্থক্যের কথা হাদিস শরিফে লক্ষ্য করা যায়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে হাদিস গুলো সনদ ও মতনের দিক দিয়ে কতটা সহিহ। অর্থাৎ হাদিস গুলো সহিহ কিনা? আমরা হাদিস গুলো সহিহ কিনা এবং এ সম্পর্কে মুহাদ্দিসদের মন্তব্য কি তা একটু পরে আলোচনা করছি।
প্রথমে আমরা দেখে নেই নারী ও পুরুষের নামাযের পার্থক্য সম্পর্কে হাদিসে কি বর্নিত হয়েছে-
হযরত ইয়াযিদ ইবনু আবি হাবিব (রহ.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন-
“একবার রাসূল (সা.) নামাযরত দুই মহিলার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন তাদেরকে বললেন, যখন সাজদাহ করবে তখন শরীর যমীনের সাথে মিলিয়ে দেবে। কেননা মহিলারা এ ক্ষেত্রে পুরুষদের মত নয়।”(আবু দাউদ, কিতাবুল মারাছিল)
আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন-
“মহিলা যখন নামাযের মধ্যে বসবে, তখন যেন (ডান) উরুর উপর বাম উরু রাখে। আর যখন সাজদাহ করবে তখন যেন পেট উরুর সাথে মিলিয়ে রাখে; যা তার সতরের জন্য অধিক উপযােগী। আল্লাহ তা’আলা তাকে দেখে বলেন- ওহে আমার ফেরেশতারা! তােমরা সাক্ষী থাক, আমি তাকে ক্ষমা করে দিলাম।” (বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা)
হাদিসে নারী-পুরুষের নামাযের পার্থক্য সম্পর্কে যে সকল আলোচনা করা হয়, তার মধ্যে নামাযের শুরুতে কে কোথায় হাত উঠাবে তা অন্যতম একটি বিতর্ক। যেমনটি এ সম্পর্কে হাদিসেও বর্নিত হয়েছে।
হযরত ওয়াইল ইবনু হুজর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন-
“আমি রাসূল (সা.) এর কাছে হাজির হলাম, তখন তিনি বললেন,…এর মাঝে এটাও বললেন, হে
ওয়াইল বিন হুজর! যখন তুমি নামায শুরু করবে তখন কান বরাবর হাত উঠাবে । আর মহিলারা বুক বরাবর হাত উঠাবে।” (তাবারানী, আল মু’জামুল কাবীর)
হযরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন-
“মহিলা যখন সাজদাহ করবে। তখন যেন খুব জড়সড় হয়ে সাজদাহ করে এবং উভয় উরু পেটের সাথে মিলিয়ে রাখে।” ( ইবনে আবু শাইবাহ, আল মুছান্নাফ)
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রা.) কে জিজ্ঞেস করা হলাে- মহিলা কিভাবে নামায পড়বে? তিনি বললেন-
“খুব জড়সড় হয়ে, অঙ্গের সাথে অঙ্গ
মিলিয়ে।”(ইবনে আবু শাইবাহ, আল মুছান্নাফ)
মহিলারা কিভাবে নামায পড়বে এ বিষয়ে আলেমদের ভিন্ন মতামত ও বিতর্ক রয়েছে। যারা হাদিসে নারী-পুরুষের নামাযের পার্থক্য প্রমানের পক্ষে, তারা উক্ত হাদিসগুলো বেশি উল্লেখ করে থাকেন৷
এক: উল্লেখিত প্রথম হাদিস, ইয়াযীদ ইবনু আবি হাবীব (রহ.) থেকে বর্ণিত হাদিসটি একটি মুরসাল হাদিস। তাই এটি হাদিসে সনদে সহীহ মানে উন্নিত হয়নি।
দুই: হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত দ্বিতীয় হাদিসটি উল্লেখ করে, ইমাম বায়হাকী (রহ.) নিজেই হাদীছটিকে জঈফ বলেছেন- (সুনানুল কুবরা )
তিন: অনুরূপভাবে হযরত ওয়াইল ইবুন হুজর (রা.) কর্তৃক বর্ণিত হাদিসটিও যঈফ। এর সনদে মায়মুনাহ বিনেত হুজর এবং উম্মু ইয়াহইয়া বিনতে আব্দুল জাব্বার নামে দু’জন মাজহুল রাবী রয়েছেন। (সিলসিলা জঈফাহ)
চার: আর এ সম্পর্কিত সকল হাদিস গুলো সামনে রেখে বিংশ শতাব্দীদ শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস নাছির উদ্দিন আলবানী (রহ.) বলেন-
“পুরুষ ও মহিলার নামাযের পার্থক্য সম্পর্কে আমি কোন সহীহ হাদীছ জানতে পারিনি। যা এসেছে তা ব্যক্তির রায় ও ইজতিহাদ মাত্র।” (সিলসিলা জঈফাহ, হা-৫৫০০-এর আলােচনা দ্রষ্টব্য)
পাচ: হযরত আলী (রা.) ও আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্নিত হাদিসে নারী-পুরুষের নামাযের পার্থক্য সম্পর্কিত কিছু তথ্য লক্ষ্যনিয় ৷ এই পার্থক্য দ্বারা দলীল প্রদান করে একদল আলিম নারী ও পুরুষের নামাযে কিছু পার্থক্য রয়েছে, এ মর্মে মতামত ব্যক্ত করে থাকেন।
তবে একটি বিষয় লক্ষ্যনিয়, এ সকল পার্থক্যগুলাে একটিও ফরয ও ওয়াজিবের ক্ষেত্রে নয়। বরং পার্থক্যগুলো ২/৩টি মুস্তাহাব পর্যায়ের আমলের ক্ষেত্রে দেখা যায়। কিন্তু এ হাদিস গুলোর সনদ ও মতন নিয়েও মত পার্থক্য রয়েছে।
অর্থাৎ সনদে বা কোন ক্ষেত্রে মতনের দিক থেকেও এ হাদিস গুলো দূর্বল, যা আমরা আলবানী (রহ.) মন্তব্য থেকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। তাই এসকল বিষয়ে অবশ্যই সতর্ক থাকা উচিত। যেহেতু এগুলো শ্রেষ্ঠ তম ইবাদত নামাযের ক্ষেত্রে জড়িত।
* তবে একটি বিষয় উল্লেখ্য যে, নারী ও পুরুষ সকলের জন্য সাজদাহ করার সময় বাহুদ্বয় মাটির সাথে মিশিয়ে রাখা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অর্থাৎ বাহুদ্বয়ের কনুই অবশ্যই মাটি থেকে উপরে তুলে রাখতে হবে৷
আমাদের নামায কিভাবে পড়তে হবে এ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সা.) এর একটি সহীহ হাদিস রয়েছে।
মালেক ইবনু হুয়াইরিছ (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল (সা.) আমাদেরকে বলেন-
“তােমরা তােমাদের পরিবারের নিকট ফিরে যাও। তাদেরকে দীন শিক্ষা দাও। তাদেরকে (দীনি বিষয়ে) নির্দেশনা দাও এবং তােমরা নামায পড়, যেভাবে আমাকে পড়তে দেখেছ।”(সহীহ বুখারী)
এই হাদিস কে দলিল হিসেবে উপস্থাপন করে একদল আলিম বলেন- মৌলিক ভাবে হাদিসে নারী-পুরুষের নামাজের পার্থক্য সম্পর্কে কোন বক্তব্য নেই। কেননা রাসূল (সা.) সে ভাবে নামায পড়তে বলেছেন, যে ভাবে তিনি পড়েছেন। আর এ কথা তিনি নারী-পুরুষ সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন।
একটি বিষয় লক্ষ্য করুন, আমরা জানি রাসূল (সা.) ফরজ নামায মসজিদে আদায়ের পর সুন্নাত নামায বাড়িতে আদায় করতেন। আবার রাসূল (সা.) এর স্ত্রীগণ তাঁর সম্মুখেই হাজার হাজার ওয়াক্ত নামায আদায় করেছেন- কিন্তু উম্মাহাতুল মু’মিনীন থেকে নামাযে পার্থক্য প্রসঙ্গে কোন হাদিস পাওয়া যায় না। অথচ তাঁরা লক্ষাধিক হাদিস বর্ণনা করেছেন। কি আশ্চর্য!
আমাদের উপমহাদেশে সালাতে হাত বাধা নিয়েও বেশ বিতর্ক রয়েছে। অথচ উল্লেখ্য যে, মহিলাগণ বুকের উপর পুরুষগণ নাভীর নীচে হাত বাঁধবে এ জাতীয় ভিন্নতার কোন দুর্বল হাদীছও খুঁজে পাওয়া যায় না।
তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের নামাযে ভিন্নতা রয়েছে । যেমন-
আমরা হাদিসে নারী-পুরুষের নামাযের পার্থক্য সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত একটি স্পষ্ট ধারনা দেওয়া চেষ্টা করেছি৷ তবে আমাদের একটি বিষয় ভেবে দেখা উচিত, রাসূল (সা.) থেকে প্রমানিত সহিহ হাদিস গ্রহন করা উচিত? নাকি তুলনামূলক দূর্বল হাদিস?
একটি বিষয় চিন্তা করুন, নামায একটি নিত্যদিন আমল করা শ্রেষ্ঠ ফরয ইবাদাত। যা একজন মুসলমানের প্রধান স্তম্ভের একটি। অথচ হাদিসে নারী-পুরুষের নামাযের পার্থক্য প্রসংগে রাসূল (সা.) থেকে কোন সহীহ হাদিস নেই। তাই সেখানে গাইরে সহীহ হাদিসের ভিত্তিতে নামাযের এ পার্থক্য কতটুকু গ্রহণযােগ্য, তা প্রত্যেক ইবাদাতকারীকেই বিবেচনা করা দরকার।
মহান আল্লাহর আমাদের পবিত্র কুরআন-সুন্নাহর সহীহ বুঝ দান করুক৷আমিন।
ছবি সংগ্রহীত
তথ্য সহায়তাঃ
মন্তব্য লিখুন