মানুষ অনেক সময় এমন কিছু বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করে থাকে, যার সাথে তার কর্মে বিরাট তফাৎ থেকে যায়। তারা এমন কিছু বিষয় নিয়ে ভাবতে থাকে, যা মূলত আমাদের কর্মের ফলাফলের সাথে একদমই সম্পর্কিত নয়। আর এরকম কিছু বিষয় নিয়েই আমরা বেশি বাড়াবাড়ি করে থাকি। যেমন, রাসূল মুহাম্মদ (সা.) কিসের তৈরি? নুরের নাকি মাটির?
আমরা আকিদা ও ইবাদতের ক্ষেত্রে উদাসীন কিন্তু অপ্রয়োজনীয় কথা বা প্রশ্ন নিয়ে একটুও উদাসীনতা বোধ করি না। এটা খুবই দুঃখজনক, যে আমরা আমাদের পরকালের প্রশ্নের উত্তর না খুঁজে, অপ্রয়োজনীয় প্রশ্ন নিয়ে বাড়াবাড়ি করছি! আচ্ছা বলুন তো মুহাম্মদ (সা.) কিসের তৈরি ছিলেন, এ প্রশ্ন আমাদের দুনিয়া ও পরকালে আল্লাহ্ তায়া’লা কোথায় জিজ্ঞেসা করবেন? উত্তর হবে কোথাও না।
তারপরও যেহেতু এই বিষয়টি নিয়ে আমাদের সমাজে অত্যন্ত বাড়াবাড়ি লক্ষ্যণীয়। তাই এ সম্পর্কে এখন ভালো করে জেনে নেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেননা তা না হলে আমরা বিভ্রান্তির মাঝেই থেকে যাব। নতুবা আকিদা বা কর্মের মাঝে ফিতনা সৃষ্টির আশঙ্কা থেকে যেতে পারে। তাই আজ আমরা পবিত্র ও সহিহ হাদিসের আলোকে বিষয়টি নিয়ে একটি তাত্ত্বিক আলোচনা তুলে ধরার চেষ্টা করছি। চলুন তবে মূল আলোচনা যাওয়া যাক, ইংশাআল্লাহ।
মহান আল্লাহ্ তায়া’লা পবিত্র কুরআনে ঘোষণা করছেন তিনি মানুষ সৃষ্টি করছেন মাটি থেকে। সৃষ্টির শুরু থেকে আজ পর্যন্ত যত মানুষের জন্ম হয়েছে, তারা সবাই এক আদম (আ.) ও হাওয়া (আ.) থেকে এসেছে। আর তাঁরাই হল আমাদের আদি পিতামাতা। আল্লাহ্ তায়া’লা পবিত্র কুরআনে স্পষ্ট করে বলেছেন-
“যিনি তাঁর প্রত্যেকটি সৃষ্টিকে সুন্দর করে সৃষ্টি করেছেন এবং মানব সৃষ্টির সূচনা করেন কাদামাটি থেকে।” [সূরা সাজদাহ: ০৭]
যেহেতু মানব সৃষ্টির সূচনা বা প্রথম মানব হযরত আদম (আ.), তাই এটা স্পষ্টত যে, তিনি মাটির থেকে সৃষ্ট ছিলেন। এরপর তাঁদের মাধ্যমেই পৃথিবীতে এক এক পরম্পরায় মানুষের জন্ম হয়েছে। আবার এই মানুষের মধ্য থেকেই অগনিত নবী ও রাসূল আল্লাহ্ পাঠিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে মুহাম্মদ (সা.) হলেন সর্বশেষ নবী এবং রাসূল। তাহলে এটা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন যে, মুহাম্মদ (সা.) ও একজন আদম সন্তান।
আমরা জানি, নবী হযরত আদম (আ.)-এর স্ত্রী ছিল, সংসার ছিল, সন্তান-সন্ততি ছিল, তিনিও খাবার খেতেন এবং প্রকৃতির ডাকে সারা দিতেন। তাঁরও জন্ম ও মৃত্যু হয়েছে এবং তিনি আল্লাহর ইবাদত করতেন। তারই ধারাবাহিকতায় আমরা তাঁর সন্তানরাও এসবের মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছি।
আবার নবী মুহাম্মদ (সা.)-এরও স্ত্রী ছিল, সন্তান- সন্ততি ছিল, তাঁরও ক্ষুধা লাগতো, খাবার খেতেন এবং প্রকৃতি ডাকে সারা দিতেন। তাঁরও জন্ম ও মৃত্যু হয়েছে এবং তিনিও আল্লাহর ইবাদত করতেন। কেননা তিনিও ছিলেন একজন আদম সন্তান। তাহলে যারা তাকে নুরের তৈরি বলে থাকে, তারা কোন যুক্তিতে এটা বলে থাকেন আমার বুঝে আসে না। তবে তো আদম (আ.) কেও নুরের সৃষ্টি বলা উচিত ছিল!! তাই নয় কি?
আচ্ছা একটা কথা চিন্তা করুন আমরা জেনেছি যে, আল্লাহ্ তায়া’লা নুর দিয়ে ফেরেশতা সৃষ্টি করেছেন। এমনকি আল্লাহর নিজেরও নুর রয়েছে। আর আল্লাহ্ জ্বীন সৃষ্টি করেছেন আগুন দিয়ে। তাহলে এখন প্রশ্ন, ফেরেশতারা কি খাবার খায়, বিয়ে করে, প্রকৃতির ডাকে সারা দেয়? উত্তর হবে না। তবে মুহাম্মদ (সা.) কিসের তৈরি? এই প্রশ্নে নুরের কথা আসে কোথা থেকে? আশ্চর্য !!
যদি তারা রাসূল (সা.) মানুষ ছিলেন এ কথায় বিশ্বাসী হয়, তবে তাঁকে মাটির তৈরি বলতে সমস্যা থাকার কথা নয়। মহান আল্লাহ্ তায়া’লা পবিত্র কুরআনে স্পষ্ট অনেক আয়াত নাজিল করেছেন, যে তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন মাটি থেকে।
যেমন মহান আল্লাহ তায়া’লা বলেন-
“আমি তো মানুষকে সৃষ্টি করেছি মৃত্তিকার মূল উপাদান হতে।”[সূরা মুমিনুনঃ ১২]
এখন রাসূলুল্লাহ (সা.) যে মানুষ ছিলেন এবং তিনিও মাটি থেকে সৃষ্ট ছিলেন, এক্ষেত্রে আর কোন সন্দেহের অবকাশ থাকার কথা নয়। নবী মুহাম্মদ (সা.) কে উদ্দেশ্য করে মহান আল্লাহ্ তায়া’লা বলেন-
“বলুন, আমি তো তোমাদের মতই একজন মানুষ। আমার প্রতি প্রত্যাদেশ হয় যে, তোমাদের মাবুদ একজন। সুতরাং যে তার প্রতিপালকের সাক্ষাৎ কামনা করে, সে যেন সৎকর্ম করে ও তার প্রতিপালকের ইবাদতে কাউকেও শরীক না করে।” [সূরা কাহাফঃ ১১০]
পবিত্র আল-কুরআনে অন্য সূরায় এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ্ তায়া’লা আরও বলেন-
“বলুন, আমি তো তোমাদের মতই একজন মানুষ। আমার প্রতি ওহী হয় যে, তোমাদের মাবুদ একমাত্র মাবুদ।” [সূরা হামীমঃ ০৬]
“বলুন,পবিত্র মহান আমার প্রতিপালক। আমি তো শুধু একজন মানুষ, একজন রাসূল।”[সূরা বনি ইসরাঈলঃ ৯৩]
এ আয়াত থেকে স্পষ্টত যে, রাসূল (সা.) আমাদের মতই একজন মানুষ ছিলেন। আর কুরআনের আয়াত অনুযায়ী আল্লাহ্ তায়া’লা মানুষ সৃষ্টি করেছেন মাটি থেকে। সুতরাং এ বিষয় আর কোন সন্দেহ থাকতেই পারে না। যারা রাসূল (সা.) কে মানুষ হিসেবে বিশ্বাস করে থাকে, আবার নুরের সৃষ্টিও বলে, এই আয়াত গুলোই তাদের ভুল ধারনা ভেঙে দিতে যথেষ্ট। এরপরও যদি তারা না বুঝে থাকে, তাহলে তারা নিত্যন্ত জাহেল বা অজ্ঞ ছাড়া আর কিছু নয়।
একঃ রাসূূল (সা.) এর অস্তিত্ব সম্পর্কে মহান আল্লাহ তায়া’লার বাণী আমরা জেনেছি। ঠিক তেমনটি হাদিস শরিফেও উল্লেখ করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-
“নিশ্চয়ই আমি তোমাদের মতই একজন মানুষ। আমি ভুলে যাই যেমনভাবে তোমরা ভুলে যাও। সুতরাং আমি ভুলে গেলে তোমরা আমাকে স্মরণ করিয়ে দিবে।”[সহীহ বুখারী, মুসলিম]
দুইঃ অন্য আরেকটি সহীহ হাদীসে রাসুলুল্লাহ (সা.) ফেরেশতা, জ্বীন ও মানব সৃষ্টি সম্পর্কে বলেছেন-
“ফেরেশতাদের সৃষ্টি করা হয়েছে নূর থেকে,ইবলিসকে সৃষ্টি করা হয়েছে উত্তপ্ত অগ্নি শিখা থেকে আর আদমকে সৃষ্টি করা হয়েছে তা থেকে যা তোমাদের কাছে বিধৃত করা হয়েছে।”[সহীহ মুসলিম]
এখন মুহাম্মদ (সা.) কিসের তৈরি? এ প্রশ্নে যারা বলে থাকেন তিনি নুরের তৈরি, তারাও কিছু হাদিস উপস্থাপন করে থাকেন। কিন্ত প্রকৃত সত্য হচ্ছে, তারা যে সকল হাদিস উল্লেখ করে থাকে তা বাতিল, বানোয়াট বা জাল হাদিস হিসেবেই প্রমাণিত হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে উক্ত সহিহ হাদিস উল্লেখ করে শাইখ নাসিরউদ্দীন আলবানী (রহ.) বলেছেন-
তিনঃ রাসুলুল্লাহ (সা.) কিসের তৈরি নুরের নাকি মাটির? এ প্রসঙ্গে বিশ্ব বরেণ্য বিখ্যাত দুই ইসলামিক স্কলারের বক্তব্য লক্ষ্য করুন।
যেমন ইমাম ইবনে হাযাম (রহ.) বলেন-
এবং শাইখ আব্দুল্লাহ বিন বায (রহ.) বলেন-
এরপরও কিছু লোক বাড়াবাড়ি করে থাকে, যা তাদের আকিদা বা ইমান সম্পর্কিত জ্ঞানের চরম অবক্ষয় ছাড়া আর কিছু বলতে পারছি না। এরাই সমাজে বিভ্রান্ত ও বিদ’আতী দলের অন্তর্ভুক্ত। তাদের যুক্তি রাসূল (সা.) কে মাটির তৈরি বললে নাকি তাঁর সম্মান কমে যায়। এটা চরম মূর্খের মত কথা।
কেননা মহান আল্লাহ্ তায়া’লা যাঁর সম্মান ও মর্যাদা সম্পর্কে ঘোষণা করছেন, তাঁর জন্য এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কি হতে হবে। দুনিয়া বা পরকালের কোন বস্তু বা সম্পদ দিয়ে তা পরিমাপ করা মূর্খতা ছাড়া আর কিছু নয়।
রাসূল মুহাম্মদ (সা.) কিসের তৈরি নুরের নাকি মাটির!! এ বিষয়ে বাড়াবাড়ি এখনই বন্ধ করা উচিত। আমরা পবিত্র কুরআন ও সহিহ হাদিস থেকে এটা স্পষ্ট হয়েছি যে, রাসূল (সা.) আমাদের মত একজন মানুষ ছিলেন। তাঁর সাথে আমাদের পার্থক্য শুধু একটাই, তিনি আল্লাহর রাসূল অর্থাৎ তার কাছে আল্লাহর বাণী বা ওহী নাজিল হয়, কিন্তু আমাদের কাছে তা হয় না এবং তিনি নিষ্পাপ।
মূলকথা, পবিত্র কুরআন ও সহিহ হাদিস থেকে যতটুকু আমরা জানতে পেরেছি, তার উপর আমরা দৃঢ় বিশ্বাস করব। কেননা এর বেশি জানার ক্ষমতা আমাদের নেই। তাই নবী মুহাম্মদ (সা.) সম্পর্কে কুরআনুল কারীমে ও সহিহ হাদিসে যা এসেছে তা থেকে অতিক্রম করা অথবা বাড়াবাড়ি করাও কখনো বৈধ নয়।
ঠিক তেমনি তাঁর সম্পর্কে এটা বলাও বৈধ নয় যে, তিনি নূর, তাঁর কোনো ছায়া ছিল না অথবা তিনি নূরের সৃষ্টি। এরূপ বলা সমাজে এক ধরনের বিভ্রান্তি সৃষ্টি ও বাড়াবাড়ি ছাড়া আর কিছু নয়। বরং বিদ’আতীরা এসব নিয়ে বাড়াবাড়ি করে থাকে। যা তাদের চরম মুর্খতা ও জাহিলিয়াতের প্রমাণ। স্বয়ং রাসূল (সা.) তাঁর ব্যাপারে এসব নিষেধ করেছেন।
তিনি (সা.) ইরশাদ করেছেন-
“তোমরা আমার ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করো না, যেমন ঈসা ইবনে মারইয়ামের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করা হয়েছে। তোমরা বল আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল।” [সহীহ বুখারী]
সুতরাং ইতিহাস ও গবেষণার খাতিরে এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের জানার প্রয়োজন হতে পারে। কিন্তু আমাদের মত সাধারণ মানুষের তা না জানলেও কোন দোষ নেই অর্থাৎ পাপ হবে না। আর আমাদের জন্য এসব বিষয় নিয়ে তর্ক বা বিতর্ক করাও জায়েজ নয়। তাই এসকল বিষয়ে মাথা ব্যাথা না করে, পরকালের প্রশ্নের উত্তর নিয়ে চিন্তা এবং সে অনুযায়ী আমল করা উচিত ও জরুরী।
হযরত মুহাম্মদ (সা.) কিসের তৈরি নুরের নাকি মাটির? এ প্রসঙ্গে বিশ্ব বিখ্যাত জনপ্রিয় ইসলামি ফাতওয়ার অনলাইন ওয়েবসাইট Islamqa.info থেকে শাইখ মুহাম্মাদ সালিহ আল-মুনাজ্জিদ (হাফি.) এর ফতোয়া বিস্তারিত জেনে নিতে পারেন।
মহান আল্লাহ্ তায়া’লা আমাদের যেন সকল প্রকার বিভ্রান্তি, ফিতনা ও বিদ’আত থেকে মুক্ত থাকার তৌফিক দান করেন। আমিন।
মন্তব্য লিখুন