একটা সময় ছিল যখন ভূগোলোক থাকতো বাসায় বাসায় । আমরা যে পৃথিবী নামক গ্রহের বাসিন্দা, সেটা অলীক কল্পনা থেকে বাস্তবের ভাবনায় নিয়ে আসাটাই খুব শক্ত কাজ ছিল। পৃথিবীর গানিতিক আকৃতি, ভূগোলক ঘুরালে আমার মত হয়ত অনেকেরই মাথা ঘুরাতো এই ভেবে যে, আমদের যখন দিন তখন নাকি আমেরিকায় রাত! আমরা নাকি মাটির উপরে, তারা নাকি মাটির নিচে।
আরও একটু বেশি ভূগোল বিষয়ে আগ্রহিরা, বড়োজোর- উত্তর গোলার্ধ, দক্ষিণ গোলার্ধ কিম্বা কোথায় উষ্ণ, কোথায় শীত বা বরফাঞ্ছল এইটুকু ভাবতে ভাবতেই কিশোর কালটা পার করে ফেলতো।
কিন্তু এই সময়ে এসে একটু পরিবর্তনের কথাটা ভাবুন। এখন একদম প্রান্তিক পর্যায়ের একজন কিশোর কিংবা কিশোরী প্রথাগত উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত না হয়েও দিব্যি আমেরিকা, ইউরোপসহ পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশের সাথে ব্যবসা, বাণিজ্য, চাকরী ক্ষেত্রে সংযুক্ত ,যা সত্যিই অভূতপূর্ব।
আমরা এখন খুব সহজেই ভাবতে পারি আমরা এক পৃথিবীর বাসিন্দা। আমাদের চোখের সামনে এখন পরিষ্কার গ্লোবাল ভিলেজের ধারণা এবং চিত্র। আর তাইতো যে কোন বিষয়ে কোন আলোচনা একটু চাউর হলেই আমরা বলতাম ‘টক অব দ্য টাউন’, এখন হরহামেশা বলি ‘টক অব দ্য সিটি’, কিম্বা ‘টক অব দ্য ওয়ার্ল্ড!!’’ অর্থাৎ পৃথিবী এখন হাতের মুঠোয়।
সেই বিবেচনায় এই মুহূর্তের টক অব দ্য ওয়ার্ল্ড হল চ্যাটজিপিটি (chatGPT)! দেশ বিদেশের বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম আর সামাজিক মাধ্যমে এক নজর চোখ রাখলেই বোঝা যায় এই সময়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চ্যাটজিপিটি। বিষয়টা আসলে কি? কেনই বা এটা নিয়ে এত্ত আলোচনা? একদম আচমকাই কি এই আলাপের সূচনা? আর এটা নিয়ে এত দুশ্চিন্তারই বা কি কারণ?
মূলতঃ সভ্যতার যে অগ্রযাত্রা সেটি সাধিত হয়েছে সময়ের সাথে সাথে, বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির নতুন নতুন উদ্ভাবন, পরিবর্ধন-পরিমার্জন আর এর মধ্য দিয়ে আমরা দেখেছি তাক লাগানো সব নবতর সংযোজোন। অকল্পনীয় গতিময় এই বিশ্বের আজকের এই অবস্থানের পেছনে শিল্প বিপ্লবগুলোর ভূমিকা তাৎপর্যপূর্ণ।
আমরা যদি তৃতীয় শিল্প বিপ্লবের কথা ধরি, তাহলে দেখব সেটি হয়েছিল তথ্য প্রযুক্তির ওপর ভর করেই। এই সময়ে সুপার কম্পিউটারের যে চিত্র, তাতে তো পরিস্কারই ছিল- উৎপাদনের ক্ষেত্রে প্রযুক্তি নির্ভরতার কথা।
মানুষের জায়গা দখল করবে যন্ত্র, যোগাযোগ প্রযুক্তির বহুল ব্যবহারের কারণে-সেই শিল্প বিপ্লবের ধারাবাহিকতায় আমরা এখন শুনছি চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের কথা। শুনছি বললে ভুল হবে কারণ এখন পৃথিবীতে ঘটে চলেছে এই শিল্প বিপ্লব। এটিকে বলা হচ্ছে- I (4.O); আর এই সময়ের মধ্যেই আমরা শুনলাম চ্যাটজিপিটি’র কথা। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে সব চেয়ে বড় অবদান থাকবে- ক্লাউড কম্পিউটিং, ইন্টারনেট অব থিংস (IOT) এবং আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এর। সুনির্দিষ্ট ভাবে চ্যাটজিপিটি’র ওপর আলোচনার আগে একটু খানি ওপরের ৩ টি বিষয়ের ওপর আলোকপাত করা প্রাসঙ্গিক বলে মনে করছি। চলুন তবে জেনে নেই ছোট করে…
ক্লাউড কম্পিউটিং হল এমন একটা সিস্টেম যার মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের রিসোর্স ভোক্তা বা ক্রেতার সুবিধামত, চাহিদা অনুযায়ী অথবা প্রয়োজনের সময় ব্যবহারের সুযোগ প্রদান বা ভাড়া দেয়া হয়। বিভিন্ন ধরনের রিসোর্স বলতে এখানে নেটওয়ার্ক ,সার্ভার, স্টোরেজ, ইন্টেলিজেন্স ইত্যাদি। আরও সহজ করে বললে এটা কম্পিউটার এর একটি পরিষেবা যেটাকে বাড়ী ভাড়া দেয়ার সাথে তুলনা করা যায়।
ইন্টারনেট অব থিংস বা আইওটি বিষয়টাকে সহজ করে বললে বলা যায়, বিভিন্ন জিনিসপত্রের সাথে ইন্টারনেট এর সংযোগ । অর্থাৎ বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক সরঞ্জামাদির সঙ্গে ইন্টারনেট সংযুক্ত থাকে এবং নেটওয়ার্কে সংযুক্ত থাকার কারণে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে ওই সরঞ্জামাদি দিয়ে কাজ করা যায়। বাসার টিভি, ফ্রিজ, ওয়াশিং মেশিনের সাথে ইন্টারনেট সংযোগ এবং নেটওয়ার্কের সংযুক্তির মাধ্যমে উল্লেখিত সরঞ্জামগুলোই সক্রিয় ভাবে কাজ করবে।
তৃতীয় বিষয়টা হল আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স– যেটা নিয়ে বর্তমান সময়ে সব চেয়ে সব চাইতে বেশি আলোচনা চলছে বিশ্ব জুড়েই। বাংলায় যেটাকে আমরা বলছি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা । এর মাধ্যমে মানুষের বুদ্ধিমত্তা এবং চিন্তার শক্তিকে প্রযুক্তি নির্ভর যন্ত্রের মাধ্যমে প্রকাশ বা তার বাস্তবায়ন করা যায়।আজকে বিশ্ব জুড়ে চ্যাটজিপিটি নিয়ে যে এত আলোচনা তা কিন্তু এটারই একটা উন্নততর প্রায়োগিক দিক হিসেবেই গণ্য করা যায়।
এই পর্যন্ত আলোচনার পর নিশ্চয়ই মাথার মধ্যে আসতেই পারে, মানুষের অনেক কাজই তো তাহলে যন্ত্র করে ফেলবে! হুম করছেই তো বেশ আগে থেকেই। তৃতীয় শিল্প বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে যে তথ্য প্রযুক্তির যাত্রা শুরু হয়েছিল, তা এই সময়ে এসে বৈপ্লবিক একটা পরিবর্তনের জায়গায় চলে আসছে।
সেই বিপ্লবকেই আমরা বলছি চতুর্থ শিল্প বিপ্লব। সুতরাং বিষয়টা একদম ধারণার বাইরে বা অনুমেয় ছিল না তা কিন্তু নয় মোটেও। যারা একটু চোখ কান খোলা রেখে চলেন, তারা মোটামুটি জানেন বা জানতেন এই সময় টা হবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার। এই বিষয়ের ওপর কাজ বা গবেষণা যে সবেমাত্র শুরু হয়েছে তাও কিন্তু নয়।
আজকের এই ফরম্যাটে না হলেও, গত শতাব্দীর পঞ্চাশ-ষাটের দশকেই মানুষ এবং যন্ত্রের মিশেলে কাজের ভাবনার সূচনা হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বময় পুনর্গঠনের এবং দ্রুত অগ্রগতির ভাবনা থেকে। তবে এই শতাব্দীতে এসে সেটি বাস্তবায়নের এক অনন্য উচ্ছতায় পৌঁছে যায়।
বিশেষ করে ২০১৫ সালে স্যাম ও ইলন মাস্ক আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নিয়ে ব্যাপক কর্মযজ্ঞ শুরু করেন।পরবর্তীতে যদিও ইলন মাস্ক সেই কর্মযজ্ঞে থাকেননি তার অন্যান্য কাজের দিকে নজর দিতে। কিন্তু ঐ কর্মযজ্ঞ কিন্তু ঝড়ো গতিতে এগিয়েছে। বিভিন্ন প্রোজেক্ট -এ আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যাপক সাফল্য পায়। সুতরাং আমি আবারও বলছি , চ্যাটজিপিটি বিষয়টা উড়ে এসে জুড়ে বসেছে তা কিন্তু একদমই নয়।
গত বছরের নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান OPEN AI সামনে নিয়ে আসে ”চ্যাটজিপিটি”। আর তারপরই বিশ্বজুড়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে এটা নিয়ে। চোখ কপালে ওঠার মত বিষয় হল প্রথম পাঁচ দিনেই এর সাবস্ক্রাইবার গিয়ে দাঁড়ায় মিলিয়ন, যা ইতিপূর্বে কখনও কোন কিছুর ক্ষেত্রেই ঘটে নাই। এবং তারপর থেকে এখন পর্যন্ত সাবস্ক্রাইবার সংখ্যা হু হু করে বেড়েই চলেছে।
এখন মূল বিষয়টি পরিষ্কার করি,
সংক্ষেপে এবং সহজ করে বললে বলা যায়, এটি হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালিত চ্যাটবট। চ্যাটবট হল আলাপকারী মাধ্যম বা কম্পিউটার প্রোগ্রাম যেটিকে এমনভাবেই তৈরি করা হয়েছে যা শ্রবণের মাধ্যমে বা টেক্সটের মাধ্যমে বুদ্ধিদীপ্ত আলোচনা চালাতে সক্ষম।
OPEN AI এর চ্যাটজিপিটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে অনায়াসে যে কোন বিষয়ের ওপর সুনির্দিষ্ট আলোচনা, মতামত এবং সমাধান দিতে পারদর্শী।
যেমনঃ বাংলাদেশ নিয়ে যদি তাকে কবিতা লিখতেও বলা হয়, তাহলে তা অনায়াসে একদম মৌলিক ও স্বাতন্ত্র্য কবিতা লিখে দিতে সক্ষম। লেখা যদি মনের মত না হয় ,তবে পুনরায় চাহিদা জানালেই সেই অনুযায়ী চ্যাটজিপিটি তা করে দিতে সক্ষম।
এটা উদাহরন হিসেবে বললাম, কিন্তু চ্যাটজিপিটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’র প্রয়োগ ঘটিয়ে অতি দ্রুততার সাথে জটিল সব বিষয়ে কথোপকথনের মাধমে নির্ভুল শব্দ চয়নে এবং সঠিক ভাষা প্রয়োগে দ্রুত সমাধান দিতে পারঙ্গম।
তাহলে সার্চ ইঞ্জিন গুগলের দরকার কি শেষ?
সময় সব বলে দেবে, তবে বিশ্বের নামকরা সব প্রতিষ্ঠান যে কর্মী ছাঁটাই শুরু করেছে তা একটু খবরাখবর নিলেই জানা যাচ্ছে। মাইক্রোসফট ইতিমধ্যেই ১ হাজার কোটি ডলার ওপেন এআই -তে বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে।
গুগল বার্ড দিয়ে তার পরীক্ষা নিরীক্ষা চালাচ্ছে। অন্যান্য বড় বড় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানও এই খাতে বিনিয়োগের ঘোষণা দিচ্ছে এবং পুরনো কর্মী ছাঁটাই করছে।
সুতরাং সামনের সময়টা যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’র বৈচিত্র্যময় এবং অধিকতর উন্নত প্রয়োগ ঘটবে তা বলবার অপেক্ষাই রাখে না। আর এই প্রক্রিয়া হঠাৎ করে আচমকা যে হয়নি তা এতক্ষণের আলোচনায় স্পষ্ট হয়েছে আশা করি।
আর এ নিয়ে চিন্তার কারণ যে আছে তাও হয়ত কিছুটা ধারণা পাওয়া গেছে। চ্যাটজিপিটি এর নতুন সংস্করণ নিয়েও আলোচনা চলছে, হয়তো খুব শিগগির তা চলেও আসবে কারণ এই মুহূর্তে বিনিয়োগের কোন সমস্যা হবে না। তবে এই যে আশঙ্কা কর্মহীন হবার তার সাথে সাথে সম্ভাবনার জায়গাটাও খুঁজে বের করা তাই এই মুহূর্তে বুদ্ধিমানের কাজ হবে। উন্নততর দক্ষতা অর্জন ছাড়া সামনের দিনে টিকে থাকা কষ্ট হবে নিশ্চিত। পরিশেষে আশার কথা হল কৃত্রিম কোন কিছুই অকৃত্রিম স্বত্বার সমকক্ষ হতে পারবে না যদিও তার পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটে।
মন্তব্য লিখুন