বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ফরিদপুরের গণ সমাবশে (১২-১১-২০২২) রাষ্ট্রের বিষয়ে কিছু ভাল কথা বলেছেন, তিনি ধন্যবাদ পাবার যোগ্য। তিনি বলেছেন, তাঁরা রাষ্ট্রকে মেরামত করবেন। ন্যায় বিচারের স্বার্থে বিচার বিভাগকে নতুন করে সাজাতে চান। নতুন করে প্রশাসনকে সাজাতে চান ভালো প্রশাসনের জন্য। তাঁরা অর্থনীতিতে দুর্নীতি বন্ধ করতে চান। সত্যিকার অর্থে দেশে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র তারা নির্মাণ করবেন। নতুন আলোয় উদ্ভাসিত করতে চান বাংলাদেশকে (প্রথম আলো ১৩-১১-২০২২২)।
কথাগুলো খুবই আশাব্যঞ্জক, বাঙালীর নষ্টালজিয়ায় ভাল রকম ঢেউ তুলতে সক্ষম। তিনি তো নয়ই অন্য কেউ আগে এরকম কথা বলেছেন বলে জানা নাই। সবসময় শোনা গেছে জনগণকে ভোটের (যে ভোট দিতে গিয়ে জনগণের দফারফা অবস্থা) অধিকার ফিরিয়ে দেবার কথা, দুর্নীতি (যা কেবল বেড়ে যাওয়া ছাড়া কমেনি) দুর করার কথা।
রাষ্ট্র সংষ্কার এর বিষয়ে রাজনীতিকদের বক্তব্য এই প্রথম শোনা গেল। এটা যেন সাপের ঝাঁপি, কেউ হাত দিতে চাননা। আমরা সব সময়ে আশাবাদী তাই ভুতের মুখে রাম নামের প্রবচনটি মনে আসলেও আশা যায়না। তাঁর বক্তব্য নিঃসন্দেহে ব্যতিক্রম। সময় বলবে কথাগুলি কেবল জনগণের মনভুলানোর জন্য নাকি এর বাস্তব কোন দিক আছে। আগে এমন বক্তব্য কেউ না দেয়ায় পরিণতি যাচাই করা সম্ভব হয়নি।
রাজনীতিকেরা নির্বাচনের আগে যে সব কথাবার্তা বলেন সেগুলো পরে আর বাস্তবায়ন হয়না। তাই বাস্তব কিছু দেখার আগে মানুষের মন হতে অতীতের ছবি গুলি অপসারিত হবেনা। মানুষ এতদিন পর্যন্ত কেবল কথার কথা শুনতে অভ্যস্ত, কাজের কথা অধরা ছিল। এবার যে তারা উল্টোটা শুনছেন সেটা বাস্তবতায় না গড়ানো পর্যন্ত বিশ্বাস করবেন কীভাবে।
রাষ্ট্র মেরামতের কথা নিকট অতীতে একবার উঠেছিল এবং তা তুলেছিল শিক্ষার্থী শিশু-কিশোরেরা। নিরাপদ সড়কের দাবীতে গড়ে ওঠা আন্দোলনে একটি শিশুর হাতে ধরা পোষ্টারে লেখা ছিল ‘রাষ্ট্র সংষ্কার চলিতেছে।
সাময়িক অসুবিধার জন্য দুঃখিত’। তাই বলতে হয় রাষ্ট্র ব্যবস্থা সংষ্কারের আন্দোলনে অগ্রণী ভুমিকা শিক্ষার্থী শিশু-কিশোদের। এটা স্বাধীনতার সময়ে নতুন রাষ্ট্র গড়ে তোলার বিষয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মতই। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হচ্ছে কিনা তা সময়ে বলা যাবে।
গত ২০১৮ সালের ২৯ শে জুলাই কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সামনের বিমান বন্দর সড়কে দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান শহীদ রমজিউদ্দীন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী আব্দুল করিম রাজীব ও দিয়া খানম মীম। এরপর শিক্ষার্থীরা নিরাপদ সড়কের দাবীতে আন্দোলন -এ নামে। তখন ঐ পোষ্টারের লেখাগুলি ব্যাপক আলোচনায় আসে।
কেবল যে শিশুরারাই রাষ্ট্র সংষ্কার -এর বিষয়টি বুঝতে পারল তা-ই নয়, বড়রাও তা বোঝে এবং অনেক বেশী ও অনেক আগে থেকে কিন্তু কেউ এতদিন এভাবে বলেননি। শিশুরা বলার পরে অনেকে মুখ খোলেন এবং শিশুদেরকে অভিনন্দন জানান। এটা আমাদের এক গুরুতর বৈশিষ্ট্য যে, আমরা চাই অন্যের মাধ্যমে আমাদের ইচ্ছেটা পুরণ হোক।
আমরা কেবল সুবিধাটুকু ভোগ করব আর বাহবা দেব। এভাবে বিভিন্ন সময়ে সাধারণ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা গেছে কিন্তু তার ফল পরবর্তীতে সাধারণ মানুষ পায়নি। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ ৭১এর মুক্তিসংগ্রাম।
নিরাপদ সড়কের ঐ আন্দোলনে শিশু-কিশোররা বলেছিল কেবল সড়ক পবিহন নয়, রাষ্ট্রের কোন কিছুই ঠিকভাবে চলছেনা। তাই ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতা থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে তারা রাষ্ট্র সংষ্কারের বিষয়টিকে সামনে আনে।
এতে আমাদের পরিচিত বুদ্ধিীজীবি পরিসরের সুবিধা হয়, তারা মুখর ও উল্লসিত হবার মত এক মোক্ষম সুযোগ হাতের নাগালে পেয়ে যান। ফলে আর দশটা সমসাময়িক বিষয়ের মত শুরু হয় রাষ্ট্র সংষ্কারের সাতকাহন। নেট খুঁজলে এসব কাহিনী পাওয়া যায়।
শিশুদের আন্দোলন সবার মনযোগ আকর্ষণ করেছে কিন্তু ঐ পর্যন্তই, কাজের কাজ কিছু হয়নি। ঐ বছরে পাশ হয় সড়ক পরিবহন আইন তবে পরিবহন খাতের বিরোধিতায় বাস্তবায়ন হয়নি।
ইলিয়াস কাঞ্চন ১৯৯৩ সালের ১ ডিসেম্বর থেকে ২৯ বছর ধরে “নিরাপদ সড়ক চাই” আন্দোলন নিয়ে সরব তবু কিছু হচ্ছেনা। তখন স্বভাবিকভাবেই আরো অনেক কিছু সংষ্কারের প্রয়োজনীয়তা সামনে আসে, আসে রাষ্ট্র সংষ্কার এর বিষয়টিও। এটা অনেক বড় কাজ, করার জন্য রাজনৈতিক পক্ষ দরকার । সে রকম পক্ষ খুঁজে পাওয়া যায়না। তখন শুরু হয় এটা করতে হবে, ওটা করা দরকার -জাতীয় কথা-বার্তার। বিষয়টি কিছুদিন প্রচার মাধ্যমে আলোড়ন তোলে অতঃপর সময়ের বিধান অনুসরণ করে কিছুদিন পর মিলিয়ে যায়।
এবার ঘটল ব্যতিক্রম, ঐ কাজগুলি করতে ইচ্ছুক একটি রাজনৈতিক দলকে পাওয়া গেল। কথাগুলি মুখের না মনের তা এখনি বোঝা সম্ভব নয়। কথার ফুলঝুরির দেশে কাজের কিছু আশা করা যায়না।
তবু এই পরিবর্তনটা দেখার অপেক্ষা রাখে। রাষ্ট্র সংষ্কার এর বিষয়টা মানুষের মনে ধীরে ধীরে জাগরিত হচ্ছে। সবাই বুঝতে পারছেন একেবারে গোড়ায় কিছু সংষ্কার বা পরিবর্তন দরকার। তা ছাড়া প্রশাসন পুলিশ আইন উপদেশ পরামর্শ আহ্বান আকুতি দিয়ে জমে ওঠা বিপুল জঞ্জাল সরানো যাবেনা।
গোড়া বলতে বোঝায় রাষ্ট্রের একবারে প্রথম বা সবার উপরের দিকগুলি যেমনঃ সংবিধান, বিচার বিভাগ প্রশাসন বাংলাদেশ ব্যাংক, দুদক প্রভৃতি। রাজনীতি নিজেও একটি গোড়ার বিষয়। এরও খোলনলচে পাল্টানো দরকার।
ষন্ডাপান্ডা দালাল চামচা ছাতুখোর দিয়ে রাজনীতি ভর্তি আর এর মালিকানা কতিপয়ের হাতে। সামনে নির্বাচন। রাজনীতি এখন খুব সক্রিয় এবং জনসমর্থন আকৃষ্ট করার জন্য নানা রকম কৌশল প্রণয়ন করবে। এটা সেইরকম কোন কৌশল কিনা তা সময়ে পরিষ্কার হবে।
মানুষ চায় সেরকম কিছু না হোক। এখন একই সংগে বৃহদাকৃতির নানা লাগসই নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি উৎপাদন ও বাজার জাত করার মৌসুম। যথারীতি এগুলি পরে আর থাকেনা, নানা ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদনের মত হারিয়ে যায়।
এবার কি হবে অভিজ্ঞতার আলোকে তা ঠাহর করা গেলেও এখনি কোন মন্তব্য করা সমীচিন নয়। বাস্তবতা ভিন্ন, রাষ্ট্র সংষ্কার করা খুব কঠিন। এজন্য অনেক স্পর্শকাতর জায়গায় হাত দিতে হবে, অনেক বড় বড় পাথর উল্টানো দরকার, বড় বড় অনেক গাছ কেটে ফেলতে হতে পারে।
সেসব করার ক্ষমতা ও দক্ষতার উপরে নির্ভর করে উচ্চারিত সংষ্কারের বাস্তবায়ন। তাই মানুষের জানার আগ্রহ সংষ্কারের স্বরুপটা কেমন হবে। নাকি সবকিছু থেকে যাবে অতীতের মাঠগরম করা বক্তৃতার মতই অন্তসার শুন্য।