“পৃথিবীর সব ঘুঘু ডাকিতেছে হিজলের বনে;
পৃথিবীর সব রূপ লেগে আছে ঘাসে;
পৃথিবীর সব প্রেম আমাদের দু’জনের মনে;
আকাশ ছড়ায়ে আছে শান্তি হয়ে আকাশে।”
-জীবনান্দ দাশ
প্রকৃতির কবি হিসেবে সুপরিচিত কবি জীবনান্দ দাশ সহ বাংলার আরো অসংখ্য বরেণ্য কবি অপরূপ প্রকৃতি তথা প্রাকৃতিক পরিবেশের প্রেমে নিমজ্জিত হয়েই আমাদের সাহিত্যভান্ডারকে যুগ যুগ ধরে সমৃদ্ধ করে গিয়েছেন। প্রাকৃতিক পরিবেশ, পরিবেশের অবিচ্ছেদ্য একটি অংশ। সহজ ভাষায় যদি আমরা বলি, পরিপার্শ্বিক ভৌত অবস্হা, জলবায়ু এবং প্রভাব বিস্তারকারী বিভিন্ন রকম জীব ও জৈব উপাদানের সামগ্রিক রূপই হলো পরিবেশ। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, ১৯৯৫ সালে পরিবেশ আইন পাশ হলেও জনবিস্ফোরণ,বনাঞ্চল অবক্ষয়সহ নানাবিধ উদ্বেগজনক ঘটনার ফলস্বরূপ উক্ত আইন প্রয়োগে যথেষ্ঠ প্রতিবন্ধকতা ইতোমধ্যে আমরা লক্ষ্য করেছি।
একদম মূল থেকে বলতে গেলে আমরা পরিবেশের প্রধান দুইটি উপাদানের অস্তিত্ত্ব খুঁজে পাবো। একটি হল জীব, অপরটি জড়। পরিবেশবিদদরে মতে পরিবেশের আবার দুইটি শ্রেণিভেদ রয়েছে।
প্রাকৃতিক পরিবেশের অন্যতম কিছু উপাদানের কথা যদি বলতেই হয়, অবশ্যই তিনটি প্রধান উপাদানের কথা সামনে চলে আসে। সেগুলে হলোঃ মাটি, পানি এবং বায়ু। ২০১৯ সালের ৫ই মার্চ বাংলাদেশের পরিবেশ বিষয়ক ওয়েবসাইট “bdenvironment.com” এর “Bandarban Environment under threat for soil excavation” শিরোনামে খবর প্রকাশিত হয়। খবরটি সচেতন মহলকে বেশ চিন্তিত করে তুলে। খবরের শিরোনাম থেকে পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে পরিবেশের অন্যতম প্রধান নিয়ামক “মাটি” কে আমরা মানবসম্প্রদায় প্রতিনিয়ত দূষিত করে যাচ্ছি।
আরেকটু পিছনে যদি আমরা ফিরে যাই, ২০১৭ সালের ২০ অক্টোবর BBC বাংলা তাদের ওয়েবসাইটে “পরিকল্পনার অভাবে বাংলাদেশে দূষণের মাত্রা নিয়ন্ত্রণের বাইরে” শীর্ষক খবর প্রকাশ করে। এবার পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের কথায় আসা যাক।ভারতকে নিয়ে BBC News তাদের নিজস্ব ওয়েবসাইটে ৪ নভেম্বর, ২০১৯ সালে “India air pollution at unbearable levels” শীর্ষক নয়দিল্লির একজন বিশিষ্ট মন্ত্রীর উদ্বেগের খবর প্রচার করে। BBC News সম্প্রতি ২৭ মার্চ,২০২০ এ তাদের ওয়েবসাইটে “Corona virus: Lock downs continue to suppress European pollution” শিরোনামে খবর প্রকাশ করে।
চলতি বছরে বৈশ্বিক মহামারি করোনা ভাইরাস এর সংক্রমণের ফলে বাইরের পরিবেশের সাথে জনজীবনের সম্পৃক্ততা অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে। তারই সুফল হিসেবে ইউরোপের মত শিল্পে সমৃদ্ধ মহাদেশে দূষণ কমতে শুরু করেছে। এই খবরের অন্তর্নিহিত সত্য হলো, মানুষ এককভাবে পরিবেশ দূষণের জন্য দায়ী।
প্রাকৃতিক কিছু দুর্ঘটনাজনিত কারণ যেমনঃ আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের ফলে লাভা উদগীরণ, প্রাকৃতিক অগ্নিকান্ড, টর্নেডো সহ নানাবিধ কারণে পরিবেশ সামান্য দূষিত হলেও মানবসৃষ্ট কারণের কাছে এই ঘটনাগুলো নগণ্য।
পৃথিবীর সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, মেরু অঞ্চলের বরফ গলতে শুরু করেছে, সার্বিক বৈশ্বিক তাপমাত্রা রেকর্ড হারে বাড়ছে, গ্রীন হাউস নিঃসরণ মাত্রা স্বাভাবিক মাত্রাকে ছাড়িয়ে গিয়েছে। পরিবেশ রক্ষায় সচেতন হওয়ার এখনই সময়, পরিবেশকে হুমকির মুখ থেকে ফিরিয়ে আনার এখনই সঠিক সময়।
পরিবেশ দূষণের ফলে পরোক্ষভাবে বেশি ভোগান্তি পোহাতে হয় তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকে। সাধারণত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো শিল্পক্ষেত্রে তেমন অগ্রসর হয় না। যার ফলে, পরিবেশ দূষণে তাদের অবদানও প্রত্যক্ষভাবে আহামরি কিছুনা। সেই তুলনায় পরিবেশের সার্বিক দূষণের জন্য পাশ্চাত্য দেশগুলোকে দায়ী করাই যায়। ১৮ শতকের শুরুতে ইংল্যান্ডে যে শিল্প বিপ্লব শুরু হয়, তারই ধারাবাহিকতায় সমগ্র ইউরোপে শিল্প কারখানার দ্রুত বিকাশ ঘটে এবং পরিবেশ দূষণের বীজ তখন থেকেই ক্রমশই ডাল-পালা মেলে থাকা গাছে পরিণত হতে থাকে।
জেমস ওয়াটের বাষ্প ইঞ্জিন থেকে যে শিল্প বিপ্লব শুরু, সেটা যে বর্তমানের বিষবাষ্পের সৃষ্টি করবে, ব্যপারটা ছিল কল্পনাতীত। পাশ্চাত্য দেশগুলোর অতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণ বায়ুমন্ডলের ওজোনস্তরকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। বায়ুমন্ডলের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তর ওজোন স্তর যা সূর্যালোকের অতিবেগুনি রশ্মি থেকে পৃথিবীর বায়ুমন্ডলকে রক্ষা করে। ওজোন স্তরের ফলেই সূর্যালোকের অতিবেগুনী রশ্মি বায়ুমন্ডলে প্রবেশ করে মানব শরীরে নানাবিধ রোগের সৃষ্টি করতে পারেনা। কিন্তু পরিবেশ দূষণের ফলে বৈশ্বিক জলবায়ুর পরিবর্তন ওজোন স্তরকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। যার ফলে বৈশ্বিক বায়ুমন্ডল চরম হুমকির মুখোমুখি হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার এই বিশ্বে পরিবেশ দূষণ নিয়ে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত যথেষ্ট সচেতনতার অভাব রয়েছে। ভবিষ্যতে বাসযোগ্য, সুস্থ পরিবেশসম্পন্ন পৃথিবীর রূপরেখা দেখতে হলে বৈশ্বিকভাবে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা এখন সময়ের দাবি। কয়েকটি উল্লেখযোগ্য সাধারণ পদক্ষেপের ব্যপারে নিচে দৃষ্টিপাত করছি-
বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণ কমাতে হবে। ২০১৫ সালে প্যারিস চুক্তি করার মাধ্যমে চুক্তিবদ্ধ দেশগুলো তাপমাত্রা প্রাক শিল্প যুগের চেয়ে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস হ্রাস করার ব্যপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়। এরকম বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণের ব্যপারেও উন্নত দেশগুলোর সচেতন হওয়া উচিত।
গ্রীন টেক্সটাইলকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। গ্রীন টেক্সটাইল সম্পূর্ণ সবুজ টেক্সটাইল/গার্মেন্টস বিষয়ক মতবাদ। এই মতবাদের অন্যতম চ্যালেঞ্জ হলো কারখানার মোট জমির অর্ধেক জমির উপর সবুজায়ন করতে হবে এবং আন্তর্জাতিক সকল বিধি নিষেধ মেনে, দূষণের মাত্রা সর্বনিম্নে নামিয়ে কাজ করতে হবে।খুবই আনন্দের বিষয়,ইংরেজি সংবাদপত্র “The Daily Star” এ প্রকাশিত এক খবরে বলা হয়েছিলো, ২০১৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে সর্বোচ্চ সংখ্যক(৬৭ টি) গ্রীন টেক্সটাইল ছিল এবং নিশ্চিত ভাবেই বর্তমান সময়ে এই সংখ্যাটা বৃদ্ধি পেয়েছে।
বনায়ন সংরক্ষণ করতে হবে।বন হলো পরিবেশের অকৃত্রিম বন্ধু। দাবানল সহ কিছু অনাক্ঙ্খিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাদ দিলে বনায়ন সংরক্ষণের সম্পূর্ণ দায় মানবকূলের কাধে বর্তায়।বন সংরক্ষণের অংশ হিসেবে শুধু বৃক্ষরাজিই নয়,বিপুল পশুপাখির সংরক্ষণও অতীব জরুরি,নাহলে খাদ্যশৃঙ্খলে ব্যাঘাত সৃষ্টি হবে যার বিরূপ প্রভাব পরিবেশের উপর পড়বে।
বেশি বেশি বৃক্ষপরোপণ করতে হবে। জাতিসংঘের পরিবেশ বিষয়ক সংস্হা UNEP কে এই বিষয়ে সক্রিয় ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে।
বৈশ্বিকভাবে এসকল গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছাড়াও জাতীয় স্বার্থে প্রত্যেক দেশের নাগরিকের কিছু সাধারণ দায়িত্ব পালন করা উচিত। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু হলো-
১. স্ব স্ব উদ্যোগে বৃক্ষরোপণ করতে হবে।বাড়ির আঙ্গিনা থেকে খোলা মাঠ,রাস্তার পাশে,বাড়ির পিছনে যেকোনো উপযুক্ত জায়গায় বৃক্ষরোপণ করতে হবে।একই সাথে,বৃক্ষ নিধণকে নিরুৎসাহিত করতে হবে।
২. মাটি,পানি, বায়ু দূষিত হয়,এমন কোনো কাজ করা যাবেনা।সমগ্র পৃথিবীর সিংহভাগ পানি হলে ও সুপেয় পানির অনেক অভাব।পানি দূষণ থেকে ব্যক্তিগতভাবে বিরত থাকতে হবে।বায়ু দূষণকারী কালো ধোঁয়া নির্গমনকারী যেকোনো কিছুর ব্যবহার পরিত্যাগ করতে হবে।
৩. কৃষিপ্রধান দেশগুলোতে অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহৃত হয়।কীটনাশক মানব শরীরে ক্যান্সার সহ নানাবিধ জটিল রোগের কারণ হয়ে দাড়ায়।কীটনাশকের পর্যাপ্ত ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।মনে রাখতে হবে,কীটনাশক পোকা মাকড়ের ক্ষতি করুক বা না করুক,পরিবেশের ক্ষতি ঠিকই করে।
৪. সুষ্ঠু বর্জ্য ব্যবস্হাপনা নিশ্চিত করতে হবে।
৫. সর্বোপরি, সরকারি উদ্দ্যোগে প্রচুর পরিবেশ সচেতনতামূলক প্রচারণা চালাতে হবে। তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত যেনো সচেতনতা পৌঁছাতে পারে, সেজন্য প্রয়োজনবোধে ঘনবসতিপূর্ণ দেশগুলোর সরকারকে স্হানীয় সরকারের সাহায্য গ্রহণ করতে হবে।
আন্তর্জাতিকভাবে পরিবেশকে গুরুত্ববহ করে তোলার জন্য ৫ জুনকে বিশ্ব পরিবেশ দিবস ঘোষণা করা হয়েছে। পরিবেশের প্রতি ভালোবাসা আমাদের আদিকাল থেকে। এই পরিবেশই আমাদের প্রকৃতির কোলে আপন হাতে লালন করেছে,সভ্যতার উন্নত বিকাশে সহায়তা করেছে। সুতরাং,পরিবেশের প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতা রয়েছে। পরিবেশ সুন্দর রাখলে,দূষণমুক্ত রাখলে সুন্দর হবে আগামীর পৃথিবী,বাসযোগ্য হবে অক্সিজেন আর নাইট্রোজেন নির্ভর এই সুন্দর গ্রহটি।
পরিশেষে বলতে চাই, আসুন আমরা সবাই কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের সুরে সুর মিলিয়ে বলি-
“চলে যাব তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ
প্রাণপনে পৃথিবীর সরাবো জঞ্জাল,
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাবো আমি
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।”
তথ্যসূত্রঃ
ছবি: সংগৃহীত
মন্তব্য লিখুন