একটি সমাজ, জাতি, দেশ বা রাষ্ট্র যাই বলুন না কেন, একটি সুশৃঙ্খল অবকাঠামো বিনির্মানে অপরিকল্পিত উন্নয়ন হলো অপচয় ও দুর্নীতির অন্যতম রূপরেখা। আর অপচয় ও দুর্নীতি কখনোই অকল্যান ছাড়া ভালো কিছু বয়ে আনে না। সমৃদ্ধ দেশ ও শক্তিশালী অর্থনীতির গঠন তো দূরের কথা, বিদ্যমান শক্তিশালী অর্থনীতিকে ঋনের ঘরে যা জর্জরিত করে তা হলো অপরিকল্পিত উন্নয়ন। এখন চলুন সাম্প্রতিক এমন কিছু বিষয়াবলি নিয়ে আলোচনা করি।
অপরিকল্পিত উন্নয়ন নাকি পরিকল্পিত অপচয়?
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে আজ ৫০ বছরে আমরা কতটুকু দেশকে উন্নয়নের দিকে এগিয়ে নিতে পেরেছি? প্রশ্নটি অবান্তর নয়। একটু গভীর বিশ্লেষণ করলে আমরা এর গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারব। হয়তো অনেকেই বলে থাকবে ‘কম কিসে হলো?’ সমস্যাটা তো এখানেই। কেননা রাস্তাঘাট, কল-কারখানা, ব্রিজ কালভার্ট তো আর কম হয়নি। বেশ ভালোই হয়েছে। তবে দূর্নীতি ও অপচয়ের পরিমান এসকল ভিক্তি স্থাপনার চেয়ে কোনো অংশেই কম নয় বরং ঢের বেশি।
উন্নতির মানদন্ডে দালান-কোঠা যতটা না গুরুত্বপূর্ণ তার চেয়ে বহুগুনে গুরুত্বপূর্ণ দেশকে দূর্নীতিমুক্ত ও অপরিকল্পিত উন্নয়ন হতে রক্ষা করা। তবেই দেশের প্রত্যেক পেশার মানুষ তাদের নিজ নিজ ন্যায্য অধিকার ফিরে পাবে। জনগনের সুখে থাকাই তো হলো প্রকৃত উন্নয়ন।
আমাদের দেশের উন্নয়ন পরিস্থিতির দিকে একটু লক্ষ্য করুন। এদেশের রাস্তায় রাস্তায় প্রতি মাসে শুধু উন্নয়ন হচ্ছে। উন্নয়ন যেন কখনোই থেমে থাকে না। আসলেই কি তাই? তবে হ্যা, আমরা উন্নয়নের বিপক্ষে নই। দেশের উন্নয়ন মানে আমাদের উন্নয়ন ও জীবনযাত্রার মান সহজ হওয়া। কিন্তু একটি রাস্তা নির্মাণের সময় পরিকল্পনাহীনতা উন্নয়ন অপচয় ও দূর্নীতি ছাড়া আর কিছু নয়। এগুলো অনেকটা পরিকল্পিত অপচয়। কেননা এর মাধ্যমে কোনো একদলের সার্থ হাসিল হয় ও পকেট ভারী হয়ে থাকে।
আপনি লক্ষ্য করলেই দেখতে পাবেন, একটি রাস্তা প্রতি কয়মাস পরপর অন্তত তা খনন করা হয়? একবার গ্যাসের পাইপ লাইন বাসনো হয় তো অন্য মাসে বৈদ্যুতিক লাইন বসানোর কাজ চলে। আবার দেখবেন অন্য কোনো মাসে রাস্তা কেটে বা খনন করে ড্রেনের লাইন বসানো হচ্ছে। কোথাও আবার প্রতি দুই তিন মাস পর পর ড্রেনের অকেজো লাইনগুলো ঠিক করার নামে আবার রাস্তা পিচ ডালাইল খনন করার কাজ হয় । সারা বছর এভাবেই আমাদের উন্নয়ন বহু বছর ধরেই চলমান রয়েছে।
একটি রাস্তা নির্মাণে একবার রাস্তায় কনক্রিটের ডালাই দেওয়া হয় তো কয়েকমাস পর আবার সেই রাস্তায় পিচ ডালাইয়ের অনুমতি আসে। আবার সেই পিচ ডালাইয়ের রাস্তা বড়ো জোর ১ বছর বা দেড় বছর ভালো থাকে। এরপর আবার তা নির্মান করার প্রয়োজন হয়। আর এমন উন্নয়ন আমাদের স্বাধীনতার পর থেকেই চলমান। কখনোই তা থেমে থাকেনি। এখন বলুন গুলো মানুষের জীবনযাত্রার মান কতোটা সহজ করেছে? কতোটা দূর্যোগের কারণ হয়েছে? কতোটা সময় ও অর্থ অপচয় করেছে? কখনো ভেবে দেখেছেন কি?
পত্রিকায় এ নিয়েও কম রিপোর্ট হয়নি যে, কোনো কোনো এলাকায় কয়েক কোটি টাকার বাজেটে ব্রিজ ও কালভার্ট নির্মাণ করা হয়েছে অথচ তার সঙ্গে রাস্তার কোনো সম্পর্ক নেই। মানুষের কোনো প্রকার চলাচলের কোনো কাজেই তা লাগেনি। খোলা মাঠ কিংবা ধানী জমিতে এমন প্রকল্প পত্রিকার পাতায় চোখ রাখলে আপনাদের দেখে থাকা উচিত। যদিও হয়তো তাদের কোনো পরিকল্পনা ছিল এখানে নতুন রোড হবে বা রাস্তা হবে, কিন্তু পরবর্তীতে পরিকল্পনা পরিবর্তন হয়েছে। এমনটাই সাধারণত বেশি হয়। এখন বলুন, এগুলো কি পরিকল্পিত অপচয় নয়?
ঢাকার শহরে দীর্ঘ সময় পড়াশোনার জন্য বসবাস করছি। একটি রাস্তা ৫-৬ বছরে কতবার যে খনন করতে দেখলাম অর্থাৎ তাদের ভাষায় উন্নয়ন করতে দেখলাম এর হিসেব লিখে রাখা যদিও হয়নি। তবে দুর্ভোগ ছাড়া সুবিধার অর্থের হিসেবে নিতান্তই নগন্য অনুভব করেছি। এই শহরে যারা স্থায়ী বসবাস করেন তারা হয়তো আরও ভালো করে বলতে পারবেন।
এবার আমাদের শহরের দিকে তাকিয়ে দেখুন তো এগুলো কতটা সুসজ্জিত করে নির্মান করা হয়েছে? শহরে পরিবেশে জনগন ও যানবাহনের তুলনায় ফুটপাত ও রাস্তায় আয়তন কেমন? তবে এর উত্তর না হয় আজ নিরবে চেপে যান। বলতে হবে না। কেননা এখন বলেই বা কি হবে? এগুলো ভেঙে ফুটপাত ও রাস্তা বর্ধিত করা আবার রাষ্ট্রীয় অর্থের বিশাল অপচয় ও দুর্নীতির দার খুলে দেওয়ার নামান্তর । আমরা মানুষ হিসেবে তো এতোটা সৎ নই। আর তারা তো তাই চায়। নতুন প্রকল্প হোক, না হয় অপচয় ও দুর্নীতি হবে কিভাবে? পকেট ভারী হবে কিভাবে? আর যদি এই অপচয় করাও হয়, তারপরও দেখবেন আমাদের নগর পরিকল্পনাবিদগণ আবার নতুন করে কিছু উন্নয়ন করার জন্য ক্ষণকাল পরে এগুলো আবার ভাঙবে বা খনন করে থাকবে।
আমাদের উন্নয়ন কেন জানি কখনোই স্থায়ী হয় না। এগুলো ভাঙা ও গড়ার নিমিত্তে যেন উন্নয়ন বহমান থাকে। আর এই উন্নয়ন আজ ৫০ বছর ধরেই চলমান। তবুও আমাদের অচেতন মন অসচেতন হয় না। অথচ আমাদের এই দীর্ঘ স্বাধীনতার সময়ে বহু নিম্ন অবকাঠামো ও অর্থনীতির দেশ সুসজ্জিত হয়েছে। শিক্ষা ও গবেষণায় এগিয়ে গিয়েছে। আর আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা সেসকল দেশে স্কলারশিপ নিয়ে উচ্চ শিক্ষায় পারি দিচ্ছে। যাইহোক অনেক কথা বলছি, কথা সংক্ষিপ্ত করা ভালো, কেননা আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর অবকাঠামোর সাথে সেসকল দেশের অবকাঠামোর সাথে তুলনা করে নিজেদের আর ছোট করতে চাই না।
তবে এই অপচয় ও দুর্নীতি কবে বন্ধ হবে?
আমাদের অপরিকল্পিত উন্নয়ন কবে বন্ধ হবে? এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর হল, যেদিন আমাদের প্রশাসন দায়বদ্ধতার যথাযথ উত্তর দিতে সক্ষম হবে এবং তা বাস্তবায়ন করে দেখাবে। তখনই বলা যাবে দেশের প্রকৃত উন্নয়ন হচ্ছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে বহু সরকার এদেশের উন্নয়নের ভার কাঁধে নিয়েছেন। কিন্তু তাদের অপরিকল্পিত উন্নয়ন কখনোই থেমে থাকে নি। বরং অপচয় ও দুর্নীতিতে একাধিকবার আমরা বিশ্ব রেকর্ড করেছি। তবুও আজ উন্নয়নের নামে অপরিকল্পিত উন্নয়ন বহমান। আসলে এগুলো পরিকল্পিত অপচয় বা দূর্নীতি ছাড়া আর কিছু নয়।
একটু চিন্তা করুন একটি প্রকল্প যদি বার বার উন্নয়নের নামে ভাঙতে ও গড়তে হয়, তবে অতীতে এটি কেন নির্মান করা হয়েছিল? সেই অর্থ গুলো কোথা থেকে এলো? কেন আমরা কি সুপরিকল্পনা সহিত এসব কাজ করতে পারতাম না? কেন এক-দুই মাস পরপর একই প্রকল্পে উন্নয়ন করতে হবে? তবে হ্যা, ১০০ টি কাজের মাঝে দু একটি ভুল হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু এখন যেন দু একটি সঠিক হওয়া ভাগ্যের উত্থান।
আসলে কেনই বা করা হবে? আগেই বলেচি এটাও তো একশ্রেণীর পেশা ও জীবনধারণের মাধ্যম। নতুবা বহিঃ বিশ্বে বেগম পাড়া গড়ার মত উন্নয়ন কীভাবে হবে? আফসোস। মেগা প্রকল্পের নামে নিম্ন বিত্তের কষ্ট বাড়ানো ও বিত্তবানদের বিত্তশালী করা কখনো উন্নয়ন হতে পারে না। ধনীদের ধনী হওয়ার তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান দেখুন? আর সূখী হওয়ার তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান দেখুন? তবেই উন্নয়নের বাস্তবতা প্রতিফলিত হবে।
কি আর লিখব? লিখেই বা কি হবে? আমরা কি সচেতন হতে চাই? এভাবে তো বহু শব্দ লেখা যাবে, কিন্তু সচেতন জাতির জন্য বহু শব্দ নয় দু-একটি বাক্য লেখাই যথেষ্ট হওয়ার ছিল। তাই নয় কি? যাইহোক, আসুন অপরিকল্পিত উন্নয়ন কিংবা পরিকল্পিত অপচয় ও দুর্নীতিকে কঠোর জবাবে না বলি । এর বিরুদ্ধে নিজদের অবস্থান অনুযায়ী সচেতন হন ও প্রতিবাদে সোচ্চার হন, প্লিজ।
আসুন সুখের পরিমাণে জনগণ, দেশ বা জাতির উন্নয়ন গড়ি। শুধু রাস্তা, ব্রিজ, কালভার্ট বা বড় বড় ভবন নির্মাণে নয়। আর অপরিকল্পিত উন্নয়ন এর নামে অপচয় ও দুর্নীতির কালো হাত একটি একটি করে ভেঙে দেই। সুপরিকল্পিত উন্নয়ন গড়ি। তবেই সাধারণ জনগন হবে সুখী, হবে দেশের উন্নয়ন।