বাংলাদেশে প্রচলিত জনপ্রিয় খেলাগুলোর ভিতরে ক্রিকেট এবং ফুটবলের পর নিঃসন্দেহে যে খেলার নাম চলে আসবে, তা হলো “ব্যাডমিন্টন”। শীতকালের শুরু থেকেই আবালবৃদ্ধবনিতা র্যাকেট হাতে মাঠে নেমে যায় আকর্ষণীয় এই খেলাটি উপভোগ করতে। আজকে কথা বলবো ব্যাডমিন্টনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, খেলার ও মাঠের নিয়ম, প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম এবং সরঞ্জাম প্রাপ্তিস্থান নিয়ে।
আর্টিকেলে যা থাকছেঃ
ঐতিহাসিক তথ্যমতে, ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে ভারতে নিযুক্ত ব্রিটিশ সেনা অফিসারেরা এই খেলা উদ্ভাবন করেন। তাঁরা ইংল্যান্ডের ঐতিহ্যবাহী খেলা ব্যাটলডোর ও শাটলককে একটি নেট যুক্ত করে এই খেলা চালু করেছিলেন। ব্রিটিশ গ্যারিসন নগরী পুনায় এই খেলা বিশেষ জনপ্রিয় ছিল বলে এই খেলার অপর নাম পুনাই।ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে এই খেলা ইংল্যান্ডে ব্যাপক প্রসার লাভ করে।
১৯৩০ সালে বিশ্ব ব্যাডমিন্টন নিয়ন্ত্রণ সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ব্যাডমিন্টন ফেডারেশন (বর্তমান ব্যাডমিন্টন ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন) প্রতিষ্ঠিত হয়। আধুনিক বিশ্বে ইউরোপের বাইরে চীন, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়াতেও ব্যাডমিন্টন বেশ জনপ্রিয়।
১৯৯২ সালে পাঁচটি ইভেন্টসহ ব্যাডমিন্টন অলিম্পিকের অন্তর্ভুক্ত হয়। এই ইভেন্টগুলি হল পুরুষ ও মহিলাদের সিঙ্গলস, পুরুষ ও মহিলাদের ডাবলস এবং মিক্সড ডাবলস। ১৯৯২ সাল থেকে নিয়মিত ব্যাডমিন্টন অলিম্পিকে ইনডোর গেমস হিসেবে খেলা হয়ে আসছে।
ব্যাডমিন্টন ইনডোর, আউটডোর উভয়ভাবেই খেলা হয়ে থাকে। কোর্টটি হবে আয়তাকার। একক এবং দ্বৈত উভয় ক্ষেত্রে কোর্টের মাপ দৈর্ঘ্যে হবে ৪৪ ফুট। প্রস্থের মাপ সিঙ্গেলস এবং ডাবলসে ভিন্ন হয়। একক হলে ১৭ ফুট এবং দ্বৈততে ২০ ফুট।
ব্যাডমিন্টন খেলায় প্রতিপক্ষ আর প্রতিদ্বন্দীর মাঝে থাকে নেট। নেটের উচ্চতা হতে হবে মাটি থেকে ৫ ফুট ওপরে। নেটটির প্রস্থ ২.৫ ফুট এবং লম্বা ২০ ফুট। লম্বায় কোর্টের দুই মাথা থেকে ১৫ ফুট দূরে আরও দুটি দাগ টানতে হবে প্রস্থ বরাবর। মাঝে যে ১৪ ফুট জায়গা থাকবে তার মাঝ বরাবর থাকবে নেট।
নেটের দুই পাশে ৭ ফুট করে জায়গা থাকে। এটা হলো শর্ট সার্ভিস লাইন। কোর্টের দুই মাথা থেকে ২ ফুট ৬ ইঞ্চি দূরত্বে প্রস্থ বরাবর আরও একটি করে দাগ টানতে হবে। যার নাম লং সার্ভিস লাইন। সেন্টার লাইন হয় প্রস্থ বরাবর কোর্টের মাঝখানে শর্ট সার্ভিস লাইন পর্যন্ত।
ব্যাডমিন্টন খেলায় খেলার নিয়ম অনুসারে কিছু সরঞ্জাম প্রয়োজন হয় যেমন: র্যাকেট, শাটল, নেট, পোস্ট এবং কোর্ট। এছাড়া আনুষঙ্গিক খেলোয়ার সুলভ পোষাক তো আছেই।
ব্যাডমিন্টন খেলায় র্যাকেট এবং শাটল কর্ক ব্যবহৃত হয়। সাধারণত পালক দিয়ে তৈরী করা শাটল কর্ক বেশি ব্যবহৃত হয়।
খেলোয়াড়দের লক্ষ্য থাকবে র্যাকেট দিয়ে শাটলকে এমনভাবে আঘাত করা যাতে এটা নেটের উপর দিয়ে ছুটে গিয়ে আপনার প্রতিপক্ষের কোর্টের মাটি স্পর্শ করে।
যতবার আপনি সেরকম করতে পারবেন ততবার আপনি একটা করে র্যালি জিতবেন। আপনি যদি বেশি র্যালি জিততে পারেন তাহলে আপনি পুরো ম্যাচ জিতলেন। আপনার প্রতিপক্ষের লক্ষ্যও একই। সে শাটলটিকে তার র্যাকেটে ধরে সেটাকে আপনার কোর্টের হাফ (কোর্টের সমান দুইভাগে বিভক্ত অংশ)- এ ফেরত পাঠাতে চেষ্টা করবে।
আপনি অবশ্য আপনার প্রতিপক্ষের কোনো ভুলের বিপরীতেও একটি করে র্যালি জিতবেন। সে যদি শাটলটিকে নেটে জড়িয়ে ফেলে বা নেটের নিচ দিয়ে পার করে দেয় অথবা শাটলটি কোর্টের বাহিরে গিয়ে মাটি স্পর্শ করে তাহলে আপনার পক্ষে একটি র্যালি অর্জন হবে।
আপনি যখনই বুঝতে পারবেন যে আপনার প্রতিপক্ষের শটটি কোর্টের বাহিরে চলে যাচ্ছে তখনই আপনার উচিত হবে সেটিতে আপনার র্যাকেট স্পর্শ না করে মাটিতে পড়তে দেয়া। তার বদলে যদি আপনি শাটলটিকে আঘাত করে ফেলেন তাহলে র্যালি আগের মতই চলতে থাকবে। শাটল যদি একবার মাটি স্পর্শ করে তাহলে একটি র্যালি শেষ হয়। এই হিসেবে ব্যাডমিন্টন টেনিস অথবা স্কোয়াস খেলার মত নয়, যেখানে বল বাউন্স করতে বা লাফিয়ে উঠতে পারে।
শাটলটিকে আঘাত করার সময় আপনাকে একবার স্পর্শ করেই ওটাকে নেটের উপর দিয়ে ওপাশে পার করে দিতে হবে । ব্যাডমিন্টন কিন্তু ভলিবলের মতোও নয় যেখানে নেটের উপর দিয়ে বল প্রতিপক্ষের কোর্টে পার করিয়ে দেয়ার আগে পক্ষদলের একাধিক খেলোয়াড় ওটাকে নিয়ে লোফালুফি করতে পারে।
২১ পয়েন্টের ৩ টি গেম নিয়ে একটি ম্যাচ হয়। প্রতিবার সার্ভ করলে একটি করে পয়েন্ট অর্জিত হয়। যে পক্ষ একটি র্যালি জেতে তার স্কোরের সাথে একটি পয়েন্ট যুক্ত হয়।
সর্বমোট ২০ পয়েন্টের খেলা শেষে যে পক্ষ প্রথমে ২ পয়েন্ট লিড নিয়েছিল সেই পক্ষই জিতবে। সর্বমোট ২৯ পয়েন্টের খেলা শেষে যে পক্ষ ৩০ নং পয়েন্টটি করতে পারবে সে ই জিতবে।মজার ব্যপার হচ্ছে যে পক্ষ একটি গেম জিতবে পরের গেম শুরুতে সেই সার্ভ করবে।
বিরতি এবং পার্শ্ব পরিবর্তনের একটা ব্যপার ব্যাডমিন্টন খেলায় রয়েছে। লিডিং পয়েন্ট যখন ১১ তে পৌঁছবে তখন খেলায় ৬০ সেকেন্ডের একটি বিরতি হবে। পরপর দুটি গেমের মধ্যে ইচ্ছা করলে ২ মিনিটের বিরতি নেয়া যাবে।
তৃতীয় বারের খেলায় লিডিং পয়েন্ট ১১ হলে খেলোয়াড়গণ পার্শ্বপরিবর্তন করবেন।
এবার আসা যাক সিঙ্গেল খেলার পয়েন্টের হিসাবের ব্যপারে।
খেলার শুরুতে (০-০) এবং সার্ভারের স্কোর যখন জোড়া সংখ্যা হবে তখন সে তার ডানের কোর্ট থেকে সার্ভ করবে। সার্ভারের স্কোর বিজোড় সংখ্যা হলে তার বামের কোর্ট থেকে সার্ভ করবে।একজন সার্ভার যখন একটি র্যালি জিতবে তখন সার্ভার একটি পয়েন্ট পাবে এবং তারপরে সার্ভার কোর্ট বদল করে সার্ভ করবে।
রিসিভার যদি কোনো র্যালি জেতে তাহলে তার স্কোরে একটি পয়েন্ট যুক্ত হবে এবং সে তখন সার্ভার হবে। সবসময় সঠিক সার্ভিস কোর্ট থেকে সার্ভ করতে হবে- স্কোর যদি বিজোড় হয় তবে বামের কোর্ট থেকে আর স্কোর যদি জোড় হয় তবে ডানের সার্ভিস কোর্ট থেকে সার্ভ করতে হবে।
আর দ্বৈত খেলায় প্রতি পার্শ্ব থেকে একজন করেই সার্ভিস খেলতে পারবে।খেলার শুরুতে এবং স্কোর যখন জোড় সংখ্যা হয় সার্ভার তার ডানের সার্ভিস কোর্ট থেকে সার্ভ করবে। যখন এটা বিজোড় হবে তখন তার বামের সার্ভিস কোর্ট থেকে সার্ভ করবে ।সার্ভিং পক্ষ যদি র্যালি জেতে তবে সাভিং পক্ষের স্কোরে একটি পয়েন্ট যুক্ত হবে এবং একই সার্ভার সার্ভিস কোর্ট বদল করে পুনরায় সার্ভ করবে।
সার্ভিং পক্ষ যদি কোনো র্যালিতে হেরে যায় তাহলে রিসিভিং পক্ষ একটি পয়েন্ট পাবে। তখন রিসিভিং পক্ষ নতুন সার্ভিং পক্ষতে পরিণত হবে।
আর হ্যাঁ, অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে যে কোনো পয়েন্ট অর্জন না করা পর্যন্ত খেলোয়াড়েরা কেউই নিজ নিজ সার্ভিস কোর্ট বদলাতে পারবে না।
শীতকালে সময় কাটানোর জন্য উপযুক্ত একটি খেলা হলো ব্যাডমিন্টন। ব্যাডমিন্টন খেলায় সবগুলো নিয়ম মেনে খেলতে হবে ব্যপারটা এমন নয়। পাড়ার ম্যাচে অনেক সময় পয়েন্ট কমিয়ে, নিয়ম শিথিল করে সবাই খেলে। মুখ্য বিষয় হলো খেলার আনন্দটা উপভোগ করা। তাই, আসুন সবাই এই মজার খেলাটিকে আরও জনপ্রিয় করি এবং সময় কাটানোর জন্য, সুস্থ দেহ সুন্দর মন গঠনে এই খেলার সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করি।
ছবি: সংগৃহীত
তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া, দৈনিক দেশ রূপান্ত।
মন্তব্য লিখুন