প্রাচীনকাল থেকে কৃষি আমাদের দেশের সকল ক্ষেত্রের সাথে ওতপ্রোত ভাবে মিশে আছে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে এদেশের জনসংখ্যা যেমন বাড়ছে তেমনি কৃ্ষি জমির পরিমান সমানতালে কমে আসছে। তার সাথে বিভিন্ন প্রাকৃ্তিক দূর্যোগ, নদী ভাঙন, লবণাক্ততা, দূষণ প্রভৃতি কারণে জমির উর্বরতা প্রতিনিয়তই হ্রাস পাচ্ছে। তাই দেশের কৃ্ষি উৎপাদন অব্যাহত রাখতে এবং জমির গুনগতমান উন্নয়নে জৈবসার অতুলনীয়। আর এক্ষেত্রে বায়োচার প্রযুক্তি এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে। কারন, বিজ্ঞানীদের মতে এই প্রযুক্তির জৈব সার শুধু জমির মানোন্নয়নই করে না, দীর্ঘসময় (কিছু ক্ষেত্রে প্রায় ১০০ বছর) কার্বনকে মাটিতে সংবদ্ধ করে রেখে পরিবেশে কার্বন অবমুক্ত হওয়া রোধ করে, যা বৈশ্বিক উষ্ণায়ন রোধেও বিশেষ ভূমিকা রাখে।
বায়োচার এক প্রকার চারকোল বা বিশেষ প্রকার কয়লা জাতীয় জৈব সার। এটি খুব সীমিত অক্সিজেনের উপস্থিতিতে বা অক্সিজেনবিহীন ভাবে তাপ প্রয়োগের মাধ্যমে তৈরি করা হয়। এই প্রক্রিয়াটি পাইরোলাইসিস নামে পরিচিত। এটি গৃহস্থালিতে উৎপাদিত জৈব আবর্জনার সাহায্যে সহজেই তৈ্রী করা যায়, তাই কৃ্ষকের কাছে এটি একটি সহজলভ্য ও দীর্ঘস্থায়ী সমাধান।
বায়োচার তৈরী হয় মুলত বিভিন্নপ্রকার জৈব উপাদান যেমন, রান্নার জ্বালানী কাঠকয়লা, শাক-সবজির অবশিষ্টাংশ, ধানের তুষ, কাঠের গুঁড়া, হাস মুরগির বিষ্ঠা, কচুরিপানা, এমনকি নালা-নর্দমার বর্জ্য পদার্থ সহ গৃহস্থালির প্রায় সব জৈব বর্জ্যসমূহ থেকে।
কৃষকের ঘরে সব থেকে সহজ উপায়ে এই সার উৎপাদনের উপায় হলো “আখা” নামক এক প্রকার বিশেষভাবে প্রস্তুত পরিবেশবান্ধব চুলা ব্যবহার করা। এই “আখা” এমনভাবে বৈজ্ঞানিক উপায়ে তৈ্রি করা হয়েছে যেন এতে রান্নার সময় জ্বালানীসমূহে পাইরোলাইসিস প্রক্রিয়া চলতে থাকে। এতেই রান্না শেষে ব্যবহৃত জ্বালানীর ৪ ভাগের ১ ভাগ বায়োচার উৎপন্ন হয়। এছাড়া বানিজ্যিক ভাবেও বিভিন্ন দেশে বায়োচার তৈরি করা হয়ে থাকে।
ছবিঃ জৈবসার “বায়োচার”
কৃষি ক্ষেত্রে একটি বড় সমস্যা হলো দীর্ঘদিন চাষাবাদের ফলে মাটির গুণগত মান হ্রাস পাওয়া যার কারনে ফসল উৎপাদন ব্যাহত হয়। কার্বন বায়োচার এমন একটি জৈব সার যা প্রায় ১০০ বছর পর্যন্ত মাটিতে কার্বন ধরে রাখতে পারে।
কার্বন মাটির একটি গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদান। এটি মাটির লবণাক্ততা ও অম্লত্ব কমায়। পানি বিশুদ্ধকরণেও এটি ভূমিকা রাখে। এটি অন্যান্য সারের কার্যকারিতাও বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে।
বায়োচার মাটিতে গাছের খাদ্য উপাদানগুলো ধরে রাখতে পারে। জমিতে খরার প্রাদূর্ভাব দূর করে। বায়োচার ব্যবহারে জমিতে রাসায়নিক সার ও পানি সেচ কম দিতে হয়, ফলে কৃষকের খরচ কমে যায়।
মাটিকে পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ করে বায়োচার মাটিতে অবস্থানকারী অণুজীবগুলোকে সক্রিয় করে তোলে। ফলে জমিতে বিভিন্ন উপকারী অনুজীব ও প্রাণীর আবাসস্থল গড়ে ওঠে । এতে ফসলের ফলনও দ্বিগুণ বৃদ্ধি পায়।
বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রভাব নিয়ে বর্তমানে সারা বিশ্ব শঙ্কিত। এক্ষেত্রে রান্নার জ্বালানী থেকে নির্গত ধোঁয়াও ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করে । আখার রান্নায় খুব কম ধোঁয়া নির্গত হয়। তা ছাড়া এতে জ্বালানী কম লাগে ফলে এটি পরিবেশের জন্য অধিক উপযোগী।
বায়োচার দীর্ঘকাল যাবত মাটিতে কার্বন ধরে রাখে। ফলে উন্মুক্ত জমি থেকে কার্বন নির্গত হয়ে পরিবেশের সাথে মিশে যেতে পারে না। অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন এটি গ্রীন হাউজ ইফেক্ট প্রতিরোধে একটি কার্যকরী পদক্ষেপ।
অনেক দেশেই বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে মুক্তির জন্য মাটিতে বায়োচার ব্যবহার করা হচ্ছে। বাংলাদেশেও সাম্প্রতিকালে এটি নিয়ে অনেক গবেষণা চলছে।
দেশের বিভিন্নপ্রান্তে বর্তমানে বায়োচার ব্যবহৃত হচ্ছে। প্রথমে পরীক্ষামূলক প্রয়োগে সীমাবদ্ধ থাকলেও এখন কৃ্ষকগণ এর উপকারিতা উপলব্ধি করতে শুরু করেছেন। বায়োচার প্রয়োগে দেখা গেছে জমিতে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারের পরিমান কমে যায়। সাথে সেচের পরিমানও হ্রাস পায় অর্থাৎ জমির পানি ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। সার ও সেচের প্রয়োজনীয়তা হ্রাস পাওয়ায় চাষাবাদের খরচ অনেকাংশে কমে যায়। প্রায় সকল ফসলেই এই প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে ফলন কয়েকগুন পর্যন্ত বৃ্দ্ধি পায়; কৃ্ষক অনেক বেশি লাভবান হতে পারেন।
আরও পড়ুনঃ কৃষকের নতুন আশার আলো ভাসমান সবজি ক্ষেত
বিশ্বের অনেক উন্নত দেশেই চাষাবাদে বায়োচারের ভূমিকা প্রমানিত হয়েছে। বেশিরভাগ দেশেই জৈব সার হিসেবে এটি কিনে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু খুব অল্প দেশের কৃ্ষকগণই আমাদের মতো ঘরোয়া পদ্ধতিতে বায়োচার তৈ্রি করে ব্যবহার করেন। এই প্রযুক্তি আমাদের দেশের কৃ্ষি ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে সক্ষম। সেই সাথে এটি পরিবেশ দূষণ রোধ এবং বৈশ্বিক উষ্ণায়ন রোধেও কার্যকর ভূমিকা পালন করতে সক্ষম।
পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় বায়োচারের প্রভাব নিয়ে বর্তমানে বিভিন্ন দেশে গবেষণা চলমান রয়েছে। ইতিমধ্যে আমাদের দেশের বিভিন্ন স্থানে মাঠপর্যায়ে কৃ্ষি উৎপাদনে বায়োচারের ব্যবহার অত্যন্ত সফলভাবে পরীক্ষিত হয়েছে। কৃ্ষকের ঘরে ঘরে এই প্রযুক্তি পৌঁছে দেওয়া গেলে দেশের কৃ্ষি ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধন সম্ভব হবে। এদেশের মাটিতে জৈব উপাদানের পরিমান দিন দিনই আশংকাজনক হারে কমে আসছে যা প্রতিরোধ করতে বায়োচার হতে পারে একটি সহজ ও দীর্ঘস্থায়ী সমাধান।
ছবিঃ সংগৃহীত
মন্তব্য লিখুন