বর্তমানে বিশ্বে স্বাধীন দেশের সংখ্যা ১৯৫টি। স্বাধীন দেশ হওয়া সত্বেও এর মধ্যে এমন অনেক দেশ আছে যাদের মাথাপিছু আয় উন্নত দেশগুলোর তুলনায় অনেক কম এবং এমন অনেক দেশ আছে যাদের জীবন যাত্রার মান এতটাই নিম্ন যা আপনার অকল্পনীয়। আজ আমরা বিশ্বের এমনই ৬টি দরিদ্র দেশ সম্পর্কে জানতে চলেছি।
প্রথমেই বলে রাখি যে একটি দেশ কতটা ধনী বা কতটা দরিদ্র তা নির্ভর করে সে দেশটির সম্পদ এবং সেদেশের জনসংখ্যার পরিমাণের উপর। দুটি উপাদানই যথাযথ পরিমাণে থাকলে সেদেশের অর্থনীতির উন্নয়ন ঘটে। কিন্তু যদি সম্পদের তুলনায় জনসংখ্যা বেশি হয় তখন দেশটির অর্থনৈতিক অবস্থা ভেঙে পরে এবং জীবন যাত্রার মান কমে। ফলে দেশটিতে দারিদ্রতা বৃদ্ধি পায়।
অর্থনীতিবিদদের মতে একটি দেশ কতটা ধনী বা দরিদ্র তা পরিমাপের একটি স্বীকৃত পদ্ধতি হচ্ছে জিডিপি (কোনো দেশের মোট অভ্যন্তরীন উৎপাদন) পার ক্যাপিটা। চলুন তাহলে জেনে নিই বিশ্বের ৬টি দরিদ্র দেশ সম্পর্কে:
আর্টিকেলে যা থাকছেঃ
পৃথিবীর সবচেয়ে দরিদ্র দেশের তালিকায় প্রথম অবস্থানে আছে বুরুন্ডি। বুরুন্ডি পূর্ব আফ্রিকার একটি দেশ। বুরুন্ডির উত্তরে রয়েছে রুয়ান্ডা, পূর্ব ও দক্ষিণ অঞ্চল জুড়ে আছে তানজানিয়া, এবং পশ্চিমে রয়েছে তাংগানিকা হ্রদ ও কঙ্গো রাষ্ট্র।
দেশটি দীর্ঘদিন পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে জার্মান ও বেলজিয়ামের অধীনে ছিলো। বুুরুন্ডি ১৯৬২ সালের ১লা জুলাই বেলজিয়ামের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। বুরুন্ডির রাজধানী ও সবচেয়ে বড় শহরের নাম বুজুম্বুরা। দেশটির আয়তন ২৭ হাজার ৮৩৪ বর্গকিলোমিটার। আয়তনের তুলনায় এর জনসংখ্যা অনেক বেশি, প্রায় ১ কোটি ১৭ লক্ষ ৪৬হাজার।দেশটির প্রধান ধর্ম খৃষ্টধর্ম। দেশটির অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই শোচনীয়।
দেশটির অর্থনীতি প্রধানত কৃষি নির্ভর, কিন্তু কৃষির পরিমাণ ও খুব ভালো না। এখানকার মানুষদের প্রায় ৮০% মানুষ দরিদ্র সীমার নিচে বসবাস করে। তাদের মাথাপিছি আয় মাত্র ৭২৭ মার্কিন ডলার। বুরুন্ডি দেশটির দারিদ্র্যের প্রধান কিছু কারণ হলো অধিক জনসংখ্যা, রাজনৈতিক অস্থিরতা, দুর্নীতি গৃহযুদ্ধ,ইত্যাদি। স্বাধীনতা লাভ করার পরেও ১৯৭০ এর দশক এবং ১৯৯০ এর দশকে দেশটিতে দুটি গৃহযুদ্ধ সংগঠিত হয় যাতে অনেক মানুষ মারা যায়।
জাতীয়তা: বুরুন্ডিয়ান
ভাষা: রুন্ডি, ফরাসি
সরকার: প্রজাতন্ত্র
জিডিপি: ৭৪৪ মার্কিন ডলার
পৃথিবীর দরিদ্র দেশের তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে আছে পশ্চিম আফ্রিকার একটি দেশ নাইজার। পশ্চিম আফ্রিকার সবচেয়ে বড় দেশ এটি। দেশটির পুরো নাম দ্যা রিপাবলিক অব নাইজার বা নাইজার প্রজাতন্ত্র। নাইজার নদীর নামানুসারে দেশটির নামকরণ করা হয়েছে।
দেশটির উত্তরে আলজেরিয়া ও লিবিয়া, দক্ষিণে নাইজেরিয়া , পূর্বে চাঁদ এবং পশ্চিমে বুরকিনা ফাসো ও মালি রাষ্ট্র গুলো অবস্থিত । ১৯৬০ সালে দেশটি স্বাধীনতা লাভ করে। স্বাধীনতা লাভের পূর্বে দেশটি দীর্ঘদিন ফ্রান্সের শাসনাধীন ছিলো। নাইজারের রাজধানী ও বৃহত্তর শহরের নাম নিয়ামে। কৃষি প্রধান এই দেশটির অর্থনীতি কৃষির উপর নির্ভরশীল।
এছাড়াও দেশটি ইউরেনিয়ামের আকরিক রপ্তানি করে তবু দেশটির অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই দুর্বল এর বৃহৎ জনসংখ্যার চাহিদার তুলনায়। নাইজার একটি ধর্ম নিরপেক্ষ দেশ তবে এখানে মুসলিম ধর্মের মানুষের সংখ্যাই বেশি প্রায় ৯৯% ।
দেশটির প্রায় ৮০ শতাংশ জায়গাজুড়ে সাহারা মরুভূমি অবস্থিত। দেশটির দক্ষিণাঞ্চল অপেক্ষাকৃত কিছুটা উর্বর তাই এই অঞ্চলটি কৃষিসমৃদ্ধ কিন্তু তা চাহিদার তুলনায় খুবই কম। নাইজার দেশটির আয়তন প্রায় ১২ লাখ ৬৭ হাজার বর্গকিলোমিটার। এবং এর জনসংখ্যা আনুমানিক ২কোটি ৬ লক্ষ ৭২ হাজারের ও বেশি। মাথাপিছু আয় ১১৫৩ মার্কিন ডলার। অশিক্ষা, অনুন্নত চিকিৎসা ব্যাবস্থা,প্রাকৃতিক মরুকরণ ইত্যাদি কারণে দেশটি বিশ্বের দরিদ্র দেশের তালিকায় অবস্থান করছে।
জাতীয়তা: নাইজারিয়েন
সরকারি ভাষা: ফরাসি
সরকার: সংসদীয় গনতন্ত্র
জিডিপি: ১০৬৩ মার্কিন ডলার
আরও পড়ুনঃ
দরিদ্র দেশের তালিকায় তৃতীয় স্থানে আছে লাইবেরিয়া। পশ্চিম আফ্রিকার আটলান্টিক মহাসাগরের উপকূলে অবস্থিত ছোট একটি দেশ লাইবেরিয়া।দেশটির পুরো নাম দ্যা রিপাবলিক অব লাইবেরিয়া বা লাইবেরিয়া প্রজাতন্ত্র।
দেশটির দক্ষিণ ও পশ্চিম অঞ্চল জুড়ে রয়েছে আটলান্টিক মহাসাগর। উত্তরে সিয়েরা লিওন ও গিনি এবং পূর্বে কোত দিভোয়ার অবস্থিত। ২৬ জুলাই ১৮৪৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে দেশটি। ১৯ শতকে স্বাধীনতা পাওয়া মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গ দাসেরা এই দেশটি প্রতিষ্ঠা করেন।
দেশটির রাজধানী ও বৃহত্তর শহরের নাম মনরোভিয়া। লাইবেরিয়ার অর্থনীতি প্রধানত কৃষি নির্ভর। দেশটির অধিকাংশ লোক বাস করে গ্রামাঞ্চলে। দেশটির অর্থনৈতিক বেহাল অবস্থার একমাত্র কারণ হলো দীর্ঘ ১৪ বছর যাবৎ চলা গৃহযুদ্ধ, যা ২০০৩ সালে শেষ হয়।
এরপর ২০১৪ ইবোলা ভাইরাস দেশটিতে মহামারীর আকারে ছড়িয়ে পরে যা দেশটির অর্থনীতিকে একেবারে ভেঙে ফেলে। দেশটির প্রায় ৮৫% মানুষ দরিদ্র সীমার নিচে বসবাস করে। ছোট এই দেশটির আয়তন ১ লাখ ১১হাজার ৩৬৯ বর্গকিলোমিটার। এবং জনসংখ্যা প্রায় ৪৫ লাখ ৩ হাজার। এখানকার মানুষের মাথাপিছু আয় ৮৮১ মার্কিন ডলার। দেশটির অধিকাংশ মানুষই নাস্তিক। অশিক্ষা, দুর্নীতি ও দুর্বল সরকার ব্যবস্থার কারণে দেশটিকে বিশ্বের দরিদ্র দেশের কাতারে অবস্থান নিতে হয়েছে।
জাতীয়তা: লাইবেরিয়ান
ভাষা: ইংরেজি
সরকার: প্রজাতন্ত্র
জিডিপি: ১৩০৮ মার্কিন ডলার
দরিদ্র দেশের তালিকায় চতুর্থ স্থানে আছে মালাউই।মালাউই পূর্ব আফ্রিকার একটি দেশ। দেশটির পুরো নাম দ্যা রিপাবলিক অব মালাউই বা মালাউই প্রজাতন্ত্র। মালাউই পূর্বে নিজাল্যান্ড নামেও পরিচিত ছিলো। মালাউই দেশটির পশ্চিমে জাম্বিয়া, উত্তরে তানজানিয়া এবং দক্ষিণ -পূর্ব দিকে মোজাম্বিক অবস্থিত।
৬ ই জুলাই ১৯৬৪ সালে যুক্তরাজ্যের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জন করে মালাউই।মালাউই এর রাজধানীর নাম লিলংগো।দেশটির অর্থনীতি প্রধানত কৃষি নির্ভর। এবং প্রধান রপ্তানির দ্রব্য হলো কফি। তবু দেশটির অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই নাজুক।এখানকার প্রায় ৫৩% মানুষ দারিদ্র্যসীমার নীচে বসবাস করে।
এখানকার জনগণের মাথাপিছু আয় মাত্র ১২৩৪ মার্কিন ডলার। এর আয়তন ১ লক্ষ ১৮ হাজার ৪৮৪ বর্গকিলোমিটার। এর জনসংখ্যা ১ কোটি ৮১ লক্ষ ৪৩ হাজার ২১৭ জন। দেশটির প্রায় এক- তৃতীয়াংশ জায়গা দখল করে আছে লেক মালাউই। অধিক জনসংখ্যা,এবং দুর্বল কৃষি ব্যবস্থার কারণে দেশটি দরিদ্র দেশের কাতারে চলে এসেছে অধিক শিশু মৃত্যুহার,এইচআইভি এইডস এর ব্যাপকতা ইত্যাদি দেশটির অন্যতম দুইটি প্রধান সমস্যা।
জাতীয়তা: মালাউইয়ান
সরকারি ভাষা: ইংরেজি
সরকার: বহুদলীয় গণতন্ত্র
জিডিপি: ১৩১১ মার্কিন ডলার
দরিদ্র দেশের তালিকায় পঞ্চম স্থানে আছে পূর্ব আফ্রিকার একটি দেশ মোজাম্বিক। দেশটির সরকারি নাম দ্যা রিপাবলিক অব মোজাম্বিক বা মোজাম্বিক প্রজাতন্ত্র। রাজধানী এবং বৃহত্তর শহরের নাম মাপুতো। মোজাম্বিক ১৯৭৫ সালের ২৫ জুন পর্তুগাল থেকে স্বাধীনতা লাভ করে ।
মোজাম্বিক দেশটির আয়তন ৮ লাখ ১ হাজার ৫৯০ বর্গকিলোমিটার এবং এর জনসংখ্যা প্রায় ২ কোটি ৮৯ লাখের মতো।দেশটিতে খৃষ্টান ধর্মাবলম্বীর সংখ্যা বেশি দেশটিতে অনেক প্রাকৃতিক সম্পদ থাকলেও এখনো কৃষি নির্ভর এর অর্থনীতি। তবে খাদ্য, পেট্রোলিয়াম ও অ্যালুমেনিয়াম নির্ভর শিল্প দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবু দুর্বল সরকার ব্যবস্থা, অশিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতের কারণে দেশটি ধীরে ধীরে দরিদ্র দেশের তালিকায় চলে এসেছে। যার ফলে দেশটির অধিকাংশ মানুষ দরিদ্র সীমার নিচে বসবাস করে। মাথাপিছু আয় ১২৬৬ মার্কিন ডলার। দেশটির আর একটি বড় সমস্যা হলো এখানে এইচ আই ভি এইডস এ আক্রান্ত লোকের সংখ্যা অনেক বেশি।
জাতীয়তা: মোজাম্বিকান
সরকারি ভাষা: পর্তুগিজ
সরকার: প্রজাতন্ত্র
জিডিপি: ১৪৫৯ মার্কিন ডলার
দরিদ্র দেশের তালিকায় ষষ্ঠ অবস্থানে আছে পশ্চিম আফ্রিকার একটি দেশ সিয়েরা লিওন।দেশটির পুরো নাম দ্যা রিপাবলিক অব সিয়েরা লিওন বা সিয়েরা লিওন প্রজাতন্ত্র। সিয়েরা লিওন দেশটির দক্ষিণ-পূর্ব দিকে লাইবেরিয়া, দক্ষিণ – পশ্চিম দিকে আটলান্টিক মহাসাগর এবং উত্তরে গিনি অবস্থিত।
১৯৬১ সালের ২৭ এপ্রিল দেশটি যুক্তরাজ্যের থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। সিয়েরা লিওনের রাজধানী ও বৃহত্তর শহরের নাম ফ্রিটাউন।দেশটির আয়তন ৭১ হাজার ৭৪০ বর্গকিলোমিটার এবং এর জনসংখ্যা প্রায় ৭৪ লাখেরও বেশি।সিয়েরা লিওন একটি ধর্ম নিরপেক্ষ দেশ, তবে এখানে মুসলিম ধর্মাবলম্বী লোকের সংখ্যা বেশি।
সিয়েরা লিওনের মাটির নিচে রয়েছে খনিজ সম্পদের এক বিশাল সম্ভার।দেশটির অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রধানত এই খনিজ সম্পদের উপর নির্ভরশীল।বিশেষ করে হীরা। এছাড়াও রয়েছে টাইটানিয়াম, বাক্সটাই, সোনা এবং রুটাইল।তবে এত খনিজ সম্পদ থাকা সত্বেও দেশটির মানুষেরা খুবই দরিদ্র জীবন যাপন করে।
দেশটির প্রায় ৭০% মানুষ দরিদ্র সীমার নিচে বসবাস করে । এজন্য সিয়েরা লিওন কে হীরার খনির গরীব দেশ বলা হয়।গৃহযুদ্ধ, সরকারের দুর্নীতি, দুর্বল শিক্ষা ব্যবস্থা,ও প্রাকৃতিক সম্পদের অব্যবস্থাপনার কারণে দেশটি দরিদ্র দেশের তালিকায় অবস্থান করছে।
জাতীয়তা: সিয়েরা লিওনীয়
সরকারি ভাষা: ইংরেজি
আনুষ্ঠানিক সরকারি ভাষা: বাংলা
সরকার: প্রজাতন্ত্র
জিডিপি: ১৬০২ মার্কিন ডলার
ছবিঃ সংগৃহীত
তথ্য সূত্রঃ ইউটিউব, উইকিপিডিয়া, বিএন কুওরা। (বিশ্বব্যাংক এর ২০১৯ সালের তথ্য অনুসারে)।
মন্তব্য লিখুন