শিক্ষা একটি জাতির শুধু মেরুদণ্ড নয় বরং শিক্ষা একটি জাতির মস্তিষ্কের স্নায়ুতন্ত্রের স্বরূপ। মেরুদণ্ড ভেঙে গেলেও মস্তিষ্কের স্নায়ুতন্ত্র সুস্থ থাকলে অদূর ভবিষতে সফল হওয়া সম্ভব। কিন্তু যদি মস্তিষ্কের স্নায়ুতন্ত্র অসুস্থ হয়ে যায়? তাই একটি রাষ্ট্রের শিক্ষার কেন্দ্র নামক মস্তিষ্কের স্নায়ুতন্ত্রের সুস্থতা সবার আগে প্রয়োজন। এখন প্রশ্ন বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা যেভাবে পরিচালিত হচ্ছে তা কি একটি আদর্শ শিক্ষিত রাষ্ট্র হিসেবে ভবিষ্যতে উপস্থিত হওয়ার জন্য প্রস্তুত? অদূর ভবিষ্যতে এই জাতির শিক্ষা নামক মস্তিষ্কের স্নায়ুতন্ত্রের অসুস্থতা সৃষ্টি করবে না তো?
তাই এখনই সঠিক সময় আমাদের রাষ্ট্রের শিক্ষা ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন ও সংস্কার সাধনের। যে শিক্ষা ব্যবস্থা এদেশের প্রগতিশীল প্রতিটি শিশুর মস্তিষ্কের স্নায়ুতন্ত্রের সুস্থতা ও উর্বরতা নিশ্চিত করবে, এমন শিক্ষাদান পদ্ধতি প্রয়োজন। তাহলে কেমন হওয়া জরুরি আমাদের প্রিয় বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা? আজ এ বিষয়টি নিয়েই সামান্য আলোকপাত করার চেষ্টা করব। ইনশাআল্লাহ।
পৃথিবীতে মানবজাতির জ্ঞানের সবটুকুই আল্লাহ প্রদত্ত নিয়ামতের সর্বোচ্চ দান ও মর্যাদা। এই জ্ঞানের কারনেই মানবজাতি সকল জীবের চেয়ে অনুপম বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। পৃথিবীর কোনো কোনো জাতি এই জ্ঞানের সঠিক ও সর্বাত্মক সুষ্ঠু ব্যবহারে বিশ্বের বুকে নিজেদের নাম লিখিয়েছে সম্মানসূচকে। আবার জ্ঞানের অন্ধকার দিকটি চর্চার কারনে স্মরনীয় হয়ে আছে নিন্দিতসূচকেও।
পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠে সর্বপ্রথম জ্ঞানের আলো আবর্তিত হয়েছিল মহান স্রষ্টার ওহীর মাধ্যমেই। এ কথা কারো অস্বীকার করার জো নেই। ওহীর জ্ঞানের আলোই মানুবজাতিকে শিখিয়েছে জীবনের যাবতীয় কর্মকাণ্ড ও মনুষ্য বৈশিষ্ট্যের সবকিছু। কিন্তু মানবজাতির কিছু কিছু অংশ ওহীর এই জ্ঞানকে অবজ্ঞা ও তাচ্ছিল্য করায় ইতিহাসে নিন্দিত হয়ে ধ্বংসস্তুপের সাক্ষী হয়েছে। আদ, সামুদ, পম্পেও, এশিরিয়া ও ব্যবিলনীয় জাতির কথা কি আপনাদের স্বরণে আছে? নতুবা প্লিজ স্বরণ করুন। কি কারনে তারা এতো প্রতাপশালী হয়েও ইতিহাসে নিন্দিত জাতি হিসেবে ধ্বংসস্তুপে পরিনত হয়েছে?
হ্যা, যে জাতিই ওহীর জ্ঞান থেকে নিজেদের গড়নের পাথেয় নেয়নি, তারা সাময়িক সময়ের জন্য নিজেদের প্রতাপশালী হিসেবে উপস্থিত করলেও তাদের জন্য ধ্বংসস্তুপের অপেক্ষা কেবলই ক্ষনকালের সময় মাত্র। সময়ের প্রবাহে তারা এমন ভাবে হারিয়ে যায় যে, নতুন প্রজন্মের কাছে তারা শুধু নিন্দিত জাতি হিসেবেই পরিচিতি পেয়ে থাকে। এই সুত্র পৃথিবীর প্রয়াত হওয়া পর্যন্ত চলমান থাকবে। এটাই প্রকৃতির নিয়ম।
ওহীর জ্ঞানের অবহেলা করে পার্থিব সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য মানবসৃষ্ট জ্ঞানের চর্চা যত বৃদ্ধি পাবে, কোনো জাতির মস্তিষ্কের স্নায়ুতন্ত্র বা বিবেক তত অসুস্থ হতে থাকবে। মানুষের মন-মস্তিষ্ক হবে আলো হতে বঞ্চিত ও অন্ধকারে নিমজ্জিত। যা সেই জাতির জন্য একপ্রকার ধ্বংসের বীজ বুনন। এক সময় তারাও উন্মাদনা ও অশ্লীলতার চুড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে যায়, অবশেষে তাদের ধ্বংস হওয়াই একমাত্র প্রাপ্ত হয়। তাহলে আমাদের ওহীর জ্ঞানের আলোকেই শিক্ষা ব্যবস্থাকে গড়ে তুলতে হবে এমনটাই জরুরি। নতুবা আমাদের নিন্দিত জাতি হিসেবেই ভবিষ্যত প্রজন্মের চোখে বিদ্ধ হয়ে থাকতে হবে। এ ব্যাপারে নিশ্চিত থাকুন।
মহান স্রষ্টা তার ওহীতে বলেছেন-
“এই কিতাব, যা আমরা তোমার প্রতি নাযিল করেছি, যাতে তুমি মানুষকে তাদের রবের অনুমতিক্রমে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে বের করে আন, পরাক্রমশালী সর্বপ্রশংসিতের পথের দিকে।’’ ( সূরা ইব্রাহিমঃ: ০১)
পবিত্র কুরআনের প্রথম নাজিলকৃত ওহী হলো-
‘‘পড় তোমার রবের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। তিনি সৃষ্টি করেছেন মানুষকে ‘আলাক থেকে। পড়, আর তোমার রব মহামহিম। যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি মানুষকে তা শিক্ষা দিয়েছেন, যা সে জানত না।’’( সূরা আলাকঃ১-৫)
অন্যত্র ওহীতে বলা হয়েছে-
‘‘(পরম করুণাময়) তিনি শিক্ষা দিয়েছেন কুরআন, তিনি সৃষ্টি করেছেন মানুষ, তিনি তাকে শিখিয়েছেন ভাষা।’’(সূরা আর-রহমানঃ২-৪)
আরো বলা হয়েছে-
‘‘তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে আসমান ও যমীনের সৃষ্টি এবং তোমাদের বর্ণের ভিন্নতা। নিশ্চয় এর মধ্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে জ্ঞানীদের জন্য।” (সূরা রুমঃ ২২)
এভাবে শত, সহস্রাধিক ওহী নাজিল হয়েছে জ্ঞান অর্জন ও গবেষণা করা প্রসঙ্গে। কিভাবে সম্ভব কে বা কেউ ওহীর জ্ঞান বাদ দিয়ে জ্ঞান অর্জন করবে? বরং যারা বলে ‘আমরা তো বিজ্ঞানের অনেক বই পড়েই জ্ঞান অর্জন করছি।’ আসলে তারা চরম নিন্দুক, অথচ তারা এটা জানে না বিজ্ঞানের রহস্য ও জ্ঞান ওহীর বানীর মধ্যেই গোপনীয় রয়েছে। যারা তা অনুসন্ধান করে তারা সব যুগেই হয় উন্নত ও স্বরণীয় ।
আসলে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় আমূল-পরিবর্তন ও সংশোধন প্রয়োজন। কেননা ইতোমধ্যে শিক্ষাক্রমে যে সকল বিষয় শাসকগোষ্ঠী হতে আনয়ন করা হয়েছে তা হয়তো সাময়িক সময়ের জন্য এদেশে মান কিছুটা বৃদ্ধি করবে কিছু উচ্ছূক মহলের দৃষ্টিতে। কিন্তু এর ধারাবাহিকতা অব্যাহত চলমান থাকলে ভবিষ্যত প্রজন্ম হবে বিবেকহীন এবং ওহীর জ্ঞান হতে বিচ্যুত।
হাল জামানায় স্পষ্ট লক্ষনীয় এ প্রজন্মের শিশুদের মাঝে ওহীর জ্ঞানের চর্চা করার চেয়ে, পার্থিব মানবসৃষ্ট জ্ঞান চর্চা বহুলাংশে বেশি। তারা ধর্মীয় নৈতিক শিক্ষা বইকে যেন অপশনাল সাবজেক্ট হিসাবে পড়ছে! সপ্তাহে দু-একদিনের জন্যও তাদের ধর্মীয় নৈতিক শিক্ষার বই পড়া যেন কঠিন হয়ে যায়। তাও যা পড়ে তা না বুঝে, না উপলব্ধি করে, না পালন করে। শুধু প্রাতিষ্ঠানিক পরিক্ষায় সাবজেক্টটি এখনও থাকায় একটুখানি তাদের জাস্ট পড়ার লক্ষণ রয়েছে। এজন্য আমাদের শিক্ষা পদ্ধতিতেই গলদ রয়েছে এমনটিই বলতে হবে।
কেননা দায়িত্ব মহল অন্য সকল সাবজেক্ট যত গুরুত্ব দিয়ে উপস্থাপন করছে, ততটা ধর্মীয় নৈতিক সাবজেক্টের ক্ষেত্রে তারা তা করছে না। শিক্ষার্থীরা অন্য সকল বই যত গুরুত্ব দিয়ে পড়তে থাকে ততটা গুরুত্ব ধর্মীয় সাবজেক্টে কেন দিচ্ছে না? এটাই প্রমান করে ধর্মীয় নৈতিক সাবজেক্ট শিক্ষার্থীদের মাঝে কতটা গুরুত্বহীন হয়ে পড়ছে। আসলে আমরা আদর্শ মানুষ গড়নের সুত্র হিসেবে বিজ্ঞান, কমার্স বা সাহিত্যের কিছু সাবজেক্টকে প্রাধান্য বেশি দিয়ে ফেলেছি। যেখানে ধর্মীয় মৌলিক ও নৈতিক সাবজেক্টগুলোর গুরুত্ব তেমন একটা নেই।
এখানে অনেকের প্রশ্ন হবে সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থায় কেন ধর্মী মৌলিক ও নৈতিক বিষয়গুলো গুরুত্ব দিয়ে পড়তে হবে? এটা তো আর ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়? যদি এ প্রশ্ন হয় তাহলে বলব, সাধারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা কি কোনো ধর্মের অন্তর্ভুক্ত নয়? এ সকল শিক্ষার্থীদের কি ধর্মীয় মৌলিক জ্ঞান অর্জন করা জরুরি নয়? সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি যদি ধর্মীয় আকিদা ও নৈতিকতা বিষয় সাবজেক্টগুলোর মৌলিক বিষয়গুলো তাদের অধ্যায়ন না করালে একজন প্রকৃত চারিত্রিক আদর্শবান ও দেশপ্রেমী মানুষ তৈরি করা কি আদৌ সম্ভব? আর এতে উপকার ছাড়া কোনো ক্ষতি আছে কি? বরং না থাকাটাই তো ক্ষতির কারন।
এবার আমাদের সমাজে বসবাস করা পাশাপাশি দুটো পরিবারের কথা চিন্তা করুন৷ একটি পরিবার তাদের সন্তানদের কাউকে মাদ্রাসা নামক ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে অধ্যায়ন করতে প্রেরন করলে। পাশের বাসায় মানুষেরা প্রকাশ্যে কিংবা গোপনে বলতে থাকে, ‘আমাদের সন্তানদের বিজ্ঞান বা কমার্স নিয়ে পড়াব। মাদরাসায় পড়ে কি হবে? আজকাল মাদ্রাসা পড়া ছেলে-মেয়েরা কিছু করতে পারে? বা হুজুর-টুজুরদের কোনো দাম আছে? তাদের পেট চলে তো ওই মসজিদের ইমামতি করে বা ওয়াজ করে।’
অথচ এ অজ্ঞরা এটা জানে না যে, ধর্মীয় শিক্ষা ও ওহীর জ্ঞানের চর্চা করা সেই স্বর্ণযুগের কথা। যখন এই মাদ্রাসাওয়ালা গবেষকগনই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ গবেষক, বিজ্ঞানী ও স্কলার ছিল। তখন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সব বিদ্যাপীঠগুলো মুসলিম জাতিদের ভূ-খন্ডেরই অন্তর্ভুক্ত ছিল। আর তাদের লিখিত সব বইগুলো থেকেই পশ্চিমা সমাজ কতটা জ্ঞান অর্জন করেছে! বিজ্ঞান ও গবেষণায় মুসলিম মাস্রসাওয়ালা মনীষীদের অবদান কতটা প্রভাবশালী ছিল। কিন্তু তারা তো প্রকৃত অর্থেই হলো অকৃতজ্ঞ।
তাদের এমন মন্তব্যে ধর্মীয় জ্ঞান অর্জনের অবজ্ঞা নিসন্দেহে। কিন্তু কিছুটা সত্যও আছে বটে। কেননা আমাদের প্রিয় বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা পরিচালনায় মাদ্রাসা শিক্ষারও ব্যাপক উন্নয়ন ও সংস্কার করা প্রয়োজন। স্কুল কলেজের চেয়ে মাদ্রাসারগুলোর ভবনের অবস্থা তো আরো করুণ। তবে কিছু ব্যক্তি উদ্যোগে অনেক ভালো প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। কিন্তু সেখানে স্বর্ণযুগেরের মত বহুমুখী গবেষণা আর নেই। তবে আদর্শ, নৈতিক, দেশপ্রেমী মানুষ গড়নে তারাই হাল জামানায় অগ্রগামী। এটা বলতেই হবে। কিন্তু স্কুল-কলেজ থেকে বর্তমানে অতি সামান্য কিছু আদর্শ ও দেশপ্রেমী মানুষ তৈরি হয়। তবে সেখানে প্রতিষ্ঠানের চেয়ে পরিবারের অনুশাসন তাদের বেশি প্রভাবিত করে থাকে।
আসলে আমাদের শিক্ষা কেন্দ্রগুলো আজও শিক্ষার প্রকৃত ইমারতে পরিনত হতে পারেনি। না দৈহিক, না আত্মিক, না ব্যবহারিক ভাবে। শিক্ষা কেন্দ্রগুলো আজও কেমন যেন ভঙ্গুর প্রকৃতির এবং অপরিচ্ছন্নতা তো সেখানে আছেই। আর কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আজ অনৈতিকতা ও উচ্ছৃঙ্খলতার চর্চা যেন আরও একটি এক্সট্রা এডুকেশনের সাবজেক্ট হয়ে গিয়েছে।
তবে কলেজগুলোতে একটু করাকরি কোথাও কোথাও থাকলেও, বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা একেবারেই উন্মুক্ত প্রকৃতির। কেননা কলেজগুলোতে অনেক ক্ষেত্রে কিশোর-কিশোরী বা ছেলে-মেয়েদের সহশিক্ষা থাকে না। তবে অধিকাংশ কলেজে তাও নেই। কিন্তু বাংলাদেশে দু-একটা বিশ্ববিদ্যালয় বাদে সব ভার্সিটিতে হয়ে থাকে উন্মুক্ত সহশিক্ষার ব্যবস্থা। প্রপ্তবয়স্ক এসকল শিক্ষার্থীরা তাই অনৈতিক ও উচ্ছৃঙ্খলতায় ছড়িয়ে পড়ছে হরহামেশা। কিন্তু এসকল প্রতিষ্ঠানে সহশিক্ষার ক্ষেত্রেও নৈতিকতা নিয়ে সামান্য করাকরির বিধান নেই। যার দরুন ফ্রী মিক্সিং নামে সবার নৈতিক ও চারিত্রিক বিপর্যয় আজ স্পষ্ট প্রতীয়মান।
বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা যেভাবে আমাদের শিক্ষার্থীদের গড়ে তুলছে তা একজন বিবেক বোধসম্পন্ন মানুষের জন্য সুস্পষ্ট মস্তিষ্ক বা মানসিক অসুস্থতার প্রমান। এখানে বিজ্ঞান শিক্ষার নামে অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রীদের ওহীর বানীর বিরুদ্ধে সন্দেহের উৎপত্তি ঘটচ্ছে প্রতিনিয়ত। বিজ্ঞান শিক্ষায় আমাদের দেশের বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর যত না অবদান আছে, তার চেয়ে বেশি আছে অপব্যবহার ও বাড়াবাড়িতে। অথচ আমাদের দেশের কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞানের এমন কোনো বড় অবদান নেই, যার জন্য বিশ্ব আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোকে চিনে থাকবে। বরং আমাদের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিজ্ঞান বিষয়ে বাড়াবাড়ি, আর ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রসঙ্গে ছাড়াছাড়ি বহুলাংশে বেশি। অথচ ওহীর বানী কখনো মানুষের চিন্তাশক্তির মুখাপেক্ষী নয়।
বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা যেমন চলছে তা যদি আরও সুস্পষ্ট ভাবে জানতে চান, তাহলে প্রতিবছর বিশ্বের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠগুলোর লিষ্টটা একটু দেখে নিবেন প্লিজ। সেখানে আমাদের বিদ্যাপীঠগুলোর অবস্থান কতটা উপরে? নাকি কতটা নিচে? এবার তবে উচ্চবিদ্যালয়গুলোর কথা বন্ধ করি।
কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা ও পদ্ধতিতে আমাদের শিশুদের চিত্তবিনোদনের মাধ্যমে শিক্ষা দেওয়ার নামে উদ্ভট সব নাচ-গান, ও ব্যঙের লাফ শিখানোর ট্রেনিং দেওয়া হয় আমাদের আদর্শ জাতি গড়নের শিক্ষক নামক কারিগরদের। অথচ এই সব উদ্ভট পদ্ধতি আমাদের শিশুদের মধ্যে উস্কে দিচ্ছে উন্মাদনা ও বাচালতা। এই শিশুরা না শিক্ষাগুরুকে ভালো সম্মান ও মর্যাদা দিতে শিখছে, না পরিবারের অবিভাবকদেরও। এ বিষয়ে শিশুদের অবিভাবকেরাও প্রতিবাদে বেশ সোচ্চার।
একজন আদর্শ শিক্ষক তার নবীন শিশুদের বিনোদন দিবেন এ নিয়ে কোনো আপত্তি তো থাকায় কথা নয়। তাই না? হ্যা, আমাদেরও তা নেই। কিন্তু বিনোদনের নামে তাদের কি শেখানো হচ্ছে সেটা বড় বিষয়। নৈতিক ও শিক্ষনীয় গল্প বা গান শিশুদের মধ্যে শেখার আগ্রহ জাগ্রত করতে সাহায্য করে। তাদের সে গল্পের ব্যক্তির মত হতে অনুপ্রেরণাও দিবে। কিন্তু তা কি হচ্ছে? এ নিয়ে স্বতন্ত্র আর একটি প্রবন্ধ লেখার যাবে। তাই এতোটুকু থাক এখানে এ বিষয়ে শব্দের সংখ্যা না বাড়াই।
বর্তমানে আমরা দেখতে পাচ্ছি বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা উন্নয়নের নামে এমন সব শিক্ষা কারিকুলাম চালু হচ্ছে, যা আমাদের শিক্ষার্থীদের প্রকৃত আদর্শ শিক্ষা হতে অসুস্থ শিক্ষা ব্যবস্থার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। যা আমাদের কোমলমতি শিশুদের মস্তিষ্কে সেকুলারিজমের কট্টর বিশ্বাসের জন্ম নিচ্ছে। শিশুদের মনে দখল করে নিচ্ছে চাকচিক্যময় কাঁচের টুকরো। আসলে এগুলো এখনই থামানো দরকার। নতুবা অদূরে তারা তাদের শিক্ষক ও পিতামাতাদের থেকে হারিয়ে যাবে অজ্ঞতার অন্ধকার অমানিশায়।
বাংলাদেশ শিক্ষা ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন ও সংশোধন করা এখনই প্রয়োজন। এখন আবার উন্নয়ন বলতে কেউ ঐসকল উদ্ভট পদ্ধতি মাথায় আনবেন না প্লিজ। এগুলো উন্নয়ন নয় বরং মস্তিষ্কের স্নায়ুতন্ত্র বা বিবেকের অসুস্থতার কারন। তাই আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার প্রকৃত উন্নয়ন সাধনের প্রয়োজন। যে শিক্ষা ব্যবস্থা আমাদের শিশুদের আদর্শ নৈতিক ও প্রকৃত দেশপ্রেমী মানুষ হিসেবে গড়তে সাহায্য করবে। এ ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত কয়েকটি বিষয় বিবেচনা করে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা পদ্ধতি সংশোধন করে নতুন কারিকুলাম প্রনয়ণ করা অতীব জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ মনে করছি। যেমন-
একঃ আমাদের শিক্ষা খাতে বাজেটের পরিমান দিগুণ করা প্রয়োজন। আমাদের দেশে প্রতিবছর যে পরিমাণ শিক্ষা বাজেট রাখা হয়, তা শিক্ষা খাতের জন্য পর্যাপ্ত বা যথেষ্ট নয়। আবার যা রাখা হয় তাও সব কার্যকর হয় না। বরং এর বিরাট একটা অংশ দূর্নীতির স্বীকার হয়ে থাকে।
দুইঃ শিক্ষা কেন্দ্রের ভবনগুলোকে শিক্ষার উপযুক্ত করে সেখানে জ্ঞানের গাম্ভীর্যতা ফুটিয়ে তুলে নতুন নকশায় ভবন গুলো বিনির্মান করা।
তিনঃ নৈতিক পদ্ধতিতে শিক্ষা ব্যবস্থা বাধ্যতামূলক করা। কেননা আমাদের শিক্ষা পদ্ধতিতে নৈতিকতার বেহাল অবস্থা লক্ষনীয়। প্রাপ্ত বয়স্ক শিক্ষার্থীদেরদের কথা মাথায় রেখে, সে অনুযায়ী নৈতিক পদ্ধতিতে শিক্ষাদান কর্মসূচি গ্রহণ করা জরুরি।
চারঃ ওহীর জ্ঞানকে প্রাধান্য দিয়ে বিজ্ঞান শিক্ষাকে প্রসারিত করা। আমরা জানি, বিজ্ঞানের কোনো বিষয় ওহীর জ্ঞানের সমতুল্য হতে পারে না। অথচ আমাদের পাঠ্যবইয়ের কিয়দংশ পড়ে বর্তমান শিক্ষার্থীরা সবকিছুকেই বিজ্ঞান দ্বারা যাচাই করতে গিয়ে ওহীর বানীর বিরুদ্ধে সন্দেহের উৎপত্তি ঘটাচ্ছেন। যা কোনো ক্রমেই গ্রহণযোগ্য নয়।
পাঁচঃ প্রতিটি প্রাইমারি, মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিশুদের জন্য ফ্রী শিক্ষা ব্যবস্থা এবং শিক্ষা উপকরণ দেওয়াও গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটি শিশুর পুষ্টি নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজন বিদ্যালয়ে পুষ্টিগুনস্পন্ন সুস্বাদু টিফিনের ব্যবস্থা করা।
ছয়ঃ মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে বিজ্ঞান ও ধর্মীয় সেমিনারের আয়োজন করা। যেখানে মুসলিম ও সনাতন ধর্মের নৈতিক বিষয়গুলো নিয়ে প্রতিযোগিতার আয়োজন করা। যা শিক্ষার্থীদের নৈতিকতা চর্চার দিকে আরো প্রভাবিত করবে।
সাতঃ আমাদের শিশুদের শিক্ষা কেন্দ্রে প্রতিটি পদক্ষেপ যেন তার জন্য চিন্তা ও অনুপ্রেরণার উপকরণ হয়, এমন সুপরিকল্পনা গ্রহন করা। শিক্ষাদান ও গ্রহনের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকা প্রয়োজন। কিন্তু এমন স্বপ্ন শিক্ষার্থীদের দেখানো উচিত নয়, যা শিক্ষার মৌলিক উদ্দেশ্যর পরিপন্থী। যেমন শুধু নির্দিষ্ট কিছু পেশার স্বপ্ন দেখানো। বরং শিক্ষার্থীদের এমন স্বপ্ন দেখানো উচিত, যেমন- সে যে বিষয়ে আগ্রহী তাই তার জন্য উপযুক্ত বিষয় হবে, তবে দেখতে হবে বিষয়টি যেন কল্যানকর হয়।
আটঃ কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও নৈতিক শিক্ষা পদ্ধতি বাস্তবায়ন করে, গবেষণা ও নিত্যনতুন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারে উদ্ভুক্ত করা। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রত্যেক বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্য নৈতিকতা চর্চা ও ওহীর জ্ঞানের মৌলিক বিষয়ের উপর কোর্স করা বাধ্যতামূলক করা।
নয়ঃ শিক্ষকদের জন্য আলাদা করে উচ্চতর শিক্ষা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গঠন করা। উদ্ভট সব প্রশিক্ষণ দিয়ে নাচানাচি, গান কিংবা কৌতুকের মাধ্যমে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের নামে তাদের মর্যাদা ছোট না করিয়ে। বরং তাদের জন্য উচ্চতর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। যা তাদের প্রকৃত একজন শিক্ষক হিসেবে সমাজে উপস্থাপন করতে সাহায্য করবে, শিক্ষকদের হাসির পাত্র হিসেবে উপস্থাপন করবে না।
দশঃ স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডি পেরিয়ে যখন একজন ছাত্র বের হবে তাকে চাকরির উত্তম কর্মের নিশ্চয়তা প্রদান করা। বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা ও পদ্ধতির প্রকৃত উন্নয়ন ঘটাতে হলে প্রতিটি গ্রাজুয়েশন বা মাস্টার্স পাস করা শিক্ষার্থীদের তাদের রেজাল্ট অনুযায়ী উপযুক্ত চাকরি, পেশা বা কর্মের শতভাগ নিশ্চয়তা প্রদান করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব হিসেবে নেওয়া জরুরি।
উপরোক্ত বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে শিক্ষা কারিকুলাম বিশেষজ্ঞ কমিটির পরামর্শে একটি আদর্শ শিক্ষা কারিকুলাম ব্যবস্থা প্রনয়ণ করা এখন সময়ের দাবি। নতুবা আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের আদর্শিক ও নৈতিক বিপর্যয় ইতোমধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছে।
বাংলাদেশ শিক্ষা ব্যবস্থা ও পদ্ধতিতে উন্নয়নের নামে অব্যবস্থাপনা ও আলতো ফালতু বিষয়গুলো যার কোনো উত্তম ভবিষ্যত নেই, এমন প্রচলিত পদ্ধতি বাতিল করে নতুন ও নৈতিকতাকে ভিক্তি করে যথাযথ ও উপযুক্ত শিক্ষা কারিকুলাম প্রণয়ন করা এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। নতুবা অদূরে ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য আমাদের দেশের শিক্ষা পদ্ধতি কখনোই ভালো ফলাফল বয়ে আনবে না।
আমাদের শিক্ষা পদ্ধতি এমন কেন হবে যে, একজন শিক্ষার্থী তার জীবনে প্রায় ১৬-১৮ বছর শিক্ষা অর্জনের পেছনে কাটানোর পর তাকে একটি চাকরির জন্য প্রতিযোগিতায় নামতে হবে? কেন অনিশ্চয়তা থাকবে এখানে? শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এতোগুলো বছর কাটানোর পরও তাদের চাকরির জন্য কেন আলাদা অভিজ্ঞতার প্রয়োজন হবে? তাহলে সে কি শিখল? এমন শিক্ষা পদ্ধতির কি প্রয়োজন?
আমাদের প্রিয় বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা ও পদ্ধতিতে নৈতিকতার বিপর্যয় বছরে বছরে বেড়েই চলেছে। এদেশের শিক্ষা কেন্দ্রগুলোতে না ছাত্রীরা নিরাপদ, না ছাত্ররাও নিরাপদ। অবৈধ লেনাদেনা ছাত্র-ছাত্রী, এমনকি পিতৃতুল্য শিক্ষকের সাথেও তা প্রতীয়মান। যা এখনই রোধ না করলে এ জাতি শিক্ষার কেন্দ্র নামক মস্তিষ্কের স্নায়ুতন্ত্র মরনব্যধীতে সংক্রমিত হবে। যার ফলাফল খুবই ভয়ংকর, কঠিন ও ভয়াবহ।
সুতরাং ওহীর জ্ঞানের আলোকে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা প্রণয়ন করাই এর একমাত্র সমাধান। আমাদের সুস্থ ও সুষ্ঠু শিক্ষা ব্যবস্থা হোক চিরন্তন।
Good