বিভূতিভূষণ বন্দোপধ্যায়ের নাম মানেই চোখের সামনে উঠে আসে একটি একটি সমৃদ্ধ, সুরুচিসম্পন্ন, বাস্তবতায় ভরা বাংলা সাহিত্য। পথের পাঁচালি নিঃসন্দেহে বিভূতিভূষণ এর একটি অনবদ্য সৃষ্টি। বাংলা সাহিত্যে সর্বাধিক পঠিত সেরা দশটি উপন্যাসের মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি উপন্যাস পথের পাঁচালি। অপুর ডাগর চোখের বিষ্ময় আর দুর্গার দুরন্তপনায় ভরা শৈশবকে কাগজে কলমে মুড়িয়ে দিয়েও বাস্তবতায় তুলে এনেছেন লেখক।
বিভূতিভূষণ বন্দোপধ্যায় ১৮৯৪ সালের ১২ ই সেপ্টেম্বর ( ২৮ ভাদ্র, ১৩০১) পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বাংলা সাহিত্যের একজন বিখ্যাত গল্পাকার, প্রাবন্ধিক, উপন্যাসিক। পাঠশালার প্রাথমিক জ্ঞান সম্পন্ন করে তিনি ভর্তি হন বনগ্রাম উচ্চ বিদ্যালয়ে। অষ্টম শ্রেনীতে থাকাকালীন তার পিতৃবিয়োগ ঘটে।
তিনি প্রথম বিভাগে ইনট্রান্স পাশ করেন ১৯১৪ সালে এবং কলকাতার রিপন কলেজ ( বর্তমান সুরেন্দ্রনাথ কলেজ) থেকে ১৯১৬ সালে আই এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯১৮ সালে তিনি ডস্ট্রিংশন সহ বি.এ পাশ করে ওই একই কলেজ থেকে। কিন্তু ১৯১৯ সালে তিনি প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখার গন্ডি থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন।
তার সর্বশ্রেষ্ঠ উপন্যাস পথের পাঁচালি ও অপরাজিত। এছাড়া বিভূতিভূষণ এর উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি গুলো হলো – আরন্যক, ইছামতি, একটি আদর্শ হিন্দু হোস্টেল, চাঁদের পাহাড়, অশনি সংকেত, মেঘমল্লার, দৃষ্টি প্রদীপ ইত্যাদি।
১৯৫০ সালের ১ নভেম্বর, ঘাটশিলায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ইছামতি উপন্যাসের জন্য ১৯৫১ সালে তিনি পশ্চিমবঙ্গের সর্বোচ্চ সাহিত্য পুরষ্কার “রবীন্দ্র পুরষ্কার” (মরনোত্তর) লাভ করেন বিভূতিভূষণ বন্দোপধ্যায়।
বাংলা সাহিত্যের একটি কালজয়ী উপন্যাস “পথের পাঁচালি”। এই উপন্যাসটির মূল চরিত্র অপু (অপূর্ব কুমার রায়)।
নিশ্চিন্দিপুর গ্রামের একটি দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবার হরিহর রায়ের। পৈত্রিক জমিজমা আর সামান্য উপার্জনে টেনে নেয়া সংসার। হরিহর ও সর্বজয়ার প্রথম সন্তান দুর্গা। ইন্দির ঠাকুরন, হরিহর রায়ের দুঃসম্পর্কের ভগ্নি।
অল্প বয়সে বিয়ে তারপর বিধবা হওয়ায় তার দূকুলে কেউ নেই তাই আশ্রয় নিয়েছেন হরিহরের ভিটায়। কবি এখানে দেখিয়েছেন অসহায়ত্বের ও কিরুপ তাচ্ছিল্য পোহাতে হয়৷ ইন্দির ঠাকুরনকে নিয়ে উঠতে বসতে অবহেলা আর অনিয়মের অন্ত ছিল না সর্বজয়ার। দুর্গার সাথে বেশ ভালই বনিবনা ছিল ইন্দির ঠাকুরনের। উপন্যাসের ষষ্ঠ পরিচ্ছেদে ইন্দির ঠাকুরনের মৃত্যু হয়। তখন লেখক বলেছেন –
“ইন্দির ঠাকুরনের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে নিশ্চিন্দিপুর গ্রামে সেকালের অবসান হইয়া গেল।”
এর পরের অংশ (আম আঁটির ভেপু) শুরু হয় অপু দুর্গার খুনসুটি, ভালবাসা আর দারিদ্রের সাথে তাদের এক ছাদের তলায় বাসবাসের কথা নিয়ে। একদিন দুর্গা প্রতিবেশির গছের আম চুরি করে, সেকথা অপু সর্বজয়াকে বলে। পরে অপু মারও খায় দুর্গার হাতে। দূর্গাকে গ্রামের দস্যি মেয়েও বলা চলে। শুধু দুবেলা খাওয়ার জন্যই তার ঘরে ফেরা বাকি সময় সে সারা পাড়া, বন, জঙ্গল, এবাড়ি সেবাড়ি বেড়িয়ে আসে৷
আরও পড়ুনঃ বিজ্ঞানের চেতনায় বাংলার ধ্র্রুবতারা জামাল নজরুল ইসলাম
ঝড় এলেই শুরু হয় অপু দুর্গার আম কুড়ানো নিয়ে হৈ চৈ। পাড়া বেড়িয়ে আম কুড়িয়ে আনে দুর্গা৷ সেজন্য পাড়াপ্রতিবেশির গালমন্দ খায় সাথে সর্বজয়ার ভাগের টাও৷ প্রচন্ড অভাব অনটনে দিন কাটায় অপু দুর্গা৷ কেবল শাকপাতা দিয়েই কতদিন চলে যায় তাদের। অপুর গায়ের কেবল একটি ছেড়া জামা নিয়ে দুঃখ করেন সর্বজয়া।
অপু সারাদিন পরে থাকে তার টিনের বাক্স নিয়ে, দুর্গা খুপড়ি, নাটা ফল জোগাড় করে সারা বন জঙ্গল ঘুরে ঘুরে। যাত্রা দেখতে যায় বাবার সাথে। যাত্রার গান বেশ ভাল লাগে অপুর। একদিন অপু দুর্গা মাঠ পেরিয়ে বহুদূরে যায় ট্রেন দেখতে কিন্তু অগত্যা ট্রেনের দেখা না পেয়ে তারা বাড়ি ফিরে আসে।
এরপর একবার দুর্গা জ্বরে পরে। তখন অপু পাশে বসে দিদিকে বলে। এবার জ্বর ছাড়লে একবার রেলগাড়ি দেখতে যাবি তো? কিন্তু দুর্গার আর সেই রেলের চাকা দেখা হয় না, ম্যালেরিয়া জ্বর আর অবহেলায় চলে যায় দুর্গা।
‘অত্রুর সংবাদ’ নামক উপন্যাসের শেষ অংশে বিয়োগান্তক দিক দেখানো হয়েছে। দুর্গার মৃত্যুর পর হরিহর নিশ্চিন্দিপুর ছেড়ে কাশী গিয়ে থাকার বন্দোবস্ত করে। সেখানে গঙ্গার ঘাটে পালা গেয়ে কোনমতে দিন কাটত তাদের। এরপর একদিন হরিহরও পৃথিবী ত্যাগ করে৷ কাশীতে বেশ একা লাগে অপুর, সে দিদির কথা মনে করে খুব৷
পরে অভাব আর দারিদ্রের তাড়নায় ব্রাহ্মণ বউ সর্বজয়ার আশ্রয় নিতে হয় মানুষের ঘরে। পেট চালাতে হয় মানুষের কাজ করে৷ এখানে কবি দেখিয়েছেন ধনী গরিবের বৈষম্য কত গাড় খাঁজে আঁকা থাকে৷ সেখানে সর্বজয়ার দুঃখ বোঝার কেউ ছিল না।
পথের পাঁচালি উপন্যাসটি মূলত একটি বিয়োগাত্মক উপন্যাস যেখানে দারিদ্রতা কাঁধে নিয়ে অপু বারবার হারানোর শোক আত্মস্থ করেছে।
কবি প্রকৃতিকে পাঠেকের চোখের সামনে উপস্থাপন করেছে যেখানে বাস্তবতার সাথে জীবনের নিগুঢ় দুঃখভোগের নৈসর্গিক মিলন ঘটেছে। সত্যজিৎ রায় এই উপন্যাসকে চলচ্চিত্রে রুপ দিয়েছেন। “পথের পাঁচালি” উপন্যাসটি অবলম্বনে তিনি একটি চলচ্চিত্র তৈরি করেন যার সুনাম এখনো অক্ষুণ্ণ রয়েছে। তিনি সাহিত্য ও চলচ্চিত্রের মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন। ইংরেজি সহ আরও বেশ কয়েকটি ভাষায় অনূদিত হয়েছে পথের পাঁচালি। হাজার হাজার কাল ধরে পাঠকের হৃদয় জুড়ে থাকবে পথের পাঁচালি।
ছবিঃ সংগৃহীত
অসাধারণ, আপু 💙
Sabbas, carry on. Best of luck
ভালো লিখছো