ব্রণ বা একনি বর্তমানে টিনএজারদের অন্যতম দুশ্চিন্তার কারণ। অধিকাংশ মেয়েদেরকে ভুগতে হচ্ছে এ সমস্যায়। শুধু মেয়েরা নয়, কিছু ছেলেদের ক্ষেত্রেও এ সমস্যা দেখা যায়। এই সমাধানে অনেকেই ছুটছে বিভিন্ন কেমিক্যালযুক্ত ক্রিম ব্যবহারের দিকে। তবে এসকল ক্রিম ত্বকের আরও ক্ষতির কারণ হয়ে দাড়ায়।
তাছাড়া ব্রণের কারণে স্থায়ী দাগের সৃষ্টি হয় ক্ষতস্থানে। যার ফলে ব্রণ নিয়ে হতাশায় ভুগছে অনেক তরুণ-তরুণী। আজকের আর্টিকেলটিতে ব্রণ সমস্যা সমাধানে কিছু গুরুত্বপূর্ণ টিপস্ তুলে ধরা হয়েছে। ব্রণ সমস্যার সমাধানের আগে আমাদের প্রথমেই জানতে হবে, ব্রণ কি এবং কি কারণে এটি হয়ে থাকে?
ব্রণ কি ও কেন হয়?
ব্রণ ইংরেজিতে যেটাকে বলা হয় Acne vulgaris বা Acne। এটি হচ্ছে আমাদের শরীরের ত্বকের ফলিকলের এক প্রকার দীর্ঘমেয়াদী রোগ। সাধারণত মুখমন্ডল, গলা, বুক, পিঠের উপরিভাগ এই রোগটা হয়ে থাকে।
এসব স্থানে ছোট ছোট দানা, ফোড়া, সিস্ট এমনকি নোডিউল হতে পারে। এ রোগটা সাধারণত মুখমন্ডলেই বেশি হয়ে থাকে। সাধারণত বয়ঃসন্ধিকালে হরমোন টেস্ট্রোরেন আর প্রোজেস্ট্রোরেনের প্রভাবে ত্বকের সিবেসিয়াস গ্রন্থি অধিক হারে তেল নিঃসরণ শুরু করে।
কোনো কারণে সিবেসিয়াস গ্রন্থির নালির মুখ বন্ধ হয়ে গেলে সেবাম নিঃসরণের বাধার সৃষ্টি হয় এবং তা ভেতরে জমে ফুলে উঠে যা ব্রণ নামে পরিচিত। এর উপর জীবাণুর সংক্রমণ ঘটলে পুঁজ তৈরি হয়। অনেক সময় ত্বকের গভীর পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে। ব্রণের সংক্রমণ সেরে গেলেও মুখে কাল দাগ থেকে যেতে পারে।
সাধারণত ১৩ -১৯ বছর বয়স পর্যন্ত শতকরা ৯০ জনের এ রোগটি কমবেশি হয়ে থাকে। আবার কখনও কখনও ২০ থেকে ৩০ বছর বয়সেও এটি হতে পারে এবং অনেক বয়স পর্যন্ত থাকতে পারে।
ব্রণের প্রকারভেদ:
*ট্রপিক্যাল একনি– অতিরিক্ত গরম এবং বাতাসের আর্দ্রতা বেশি হলে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ব্রণ হয়ে থাকে।
*প্রিমিন্সট্রুয়াল একনি– কোনো কোনো নারীর পিরিয়ডের সাপ্তাহ খানেক আগে অল্প সংখ্যক ব্রণ মুখে দেখা দেয়।
*ব্রণ কসমেটিকা– কোনো কোনো প্রসাধনীর ব্যবহারের ফলে মুখে ব্রণ হয়ে থাকে।
*ব্রণ ডিটারজিনেকস– মুখ অতিরিক্ত ভাবে সাবান দিয়ে ধুলেও ব্রণ বেড়ে যায়।
*স্টেরয়েড একনি– স্টেরয়েড ঔষধ সেবনে হঠাৎ করে ব্রণ দেখা দেয়।
ব্রণ নিরাময়ে পানির গুরুত্ব:
সুস্থ ও সুন্দর ত্বকের জন্য পানির কোনো বিকল্প নাই। বলা হয়ে থাকে “পানির অপর নাম জীবন”। পানি ত্বকের আদ্রতা ধরে রাখতে সাহায্য করে। একইসাথে পানি আমাদের শরীরের বিষাক্ত টক্সিন নষ্ট করে দেয়।
একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের দৈনিক দু্ই থেকে তিন লিটার পানি করা উচিত। তাছাড়া বিশেষজ্ঞদের মতে সকালে ঘুম থেকে উঠে খালি পেটে পানি পান করা স্বাস্থ্যের জন্য অনেক ভালো।
গবেষণায় দেখা গেছে পরিমাণ মতো পানি পান করলে ব্রণের সমস্যা নিমিষেই নির্মূল করা সম্ভব। তাই ব্রণ সমস্যা সমাধানে সবচেয়ে প্রথম ধাপ হিসেবে বেছে নিতে হবে প্রচুর পানি পান করাকে।
আমারা অনেকেই পানি খাওয়ার ব্যাপারে অনেক উদাসীন। এক্ষেত্রে কিছু অ্যাপস আছে যা পানি খাওয়ার রিমাইন্ডার হিসেবে বেশ জনপ্রিয়। এধরণের অ্যাপস মোবাইলে ইনস্টল করে নিলেই পানি খাওয়ার অভ্যাসটা খুব সহজেই গড়ে তোলা যাবে।
ব্রণ থেকে মুক্তি পেতে খাদ্যাভাসের তালিকার পরিবর্তন:
ভিটামিন সি ব্রণ দূর করার ভালো উৎস। কারণ এতে আছে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা শরীরে কোষকলার মাত্রা বাড়ায়। এটা কোষ ও ত্বকের স্বাস্থ্য ভালো ও সুস্থ রাখে। তাই ভিটামিন-সি সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া নিয়মিত খাদ্যাভাসের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
এছাড়াও জিংক ব্যাক্টেরিয়ার কারণে হওয়া ব্রণ কমাতে সাহায্য করে। তাই যেসব খাবারে জিংক আছে সেসব খাবার খাদ্য তালিকার অন্তর্ভুক্ত করা যায়।
আরও পড়ুনঃ
ঘরোয়া উপাদানে সাত দিনেই ফিরিয়ে আনুন ত্বকের জেল্লা
ত্বক: মানবদেহের সর্বাপেক্ষা বৃহত্তম অঙ্গ সম্পর্কে জানুন
ভিটামিন আমাদের কোন শক্তি প্রদান করে না
পাঁকা পেঁপেতে আছে অত্যাবশ্যকীয় এনজাইম- প্যাপাইন ও কায়ম্যাপোপেইন, যা ব্রণ কমাতে চমৎকার কাজ করে। পেঁপে খাওয়া হলে এটা লোমকূপকে উন্মুক্ত করে, ব্রণের দাগ কমায় এবং ত্বকে রংয়ের ভারসাম্যহীনতা থাকলে তা দূর করে। পেঁপে ভিটামিন এ সমৃদ্ধ যা ত্বকের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি সরবারহ করে।
দৈনন্দিন খাবারে পুষ্টিকর শাকসবজি ব্রণ নিরাময়ে অনন্য ভূমিকা পালন করে। এছাড়া উচ্চ গ্লাইসেমিক ইন্ডেক্স সমৃদ্ধ খাবার যেমন- সাদা রুটি, ভুট্টার গুঁড়া, আলু ভাজা, প্রক্রিয়াজাত চিনি সমৃদ্ধ মিষ্টি খাবার ইত্যাদি থেকে দূরে থাকতে হবে।
কেননা এসকল খাবারে ব্রণ বৃদ্ধির জন্য দায়ী। অনেক ক্ষেত্রে গরুর দুধ খেলেও ব্রণের সৃষ্টি হতে পারে। তাই এর বদলে বাদাম, ওট মিল্ক বা ছাগলের দুধ গ্রহণ করা যেতে পারে। অতিরিক্ত মসলা ও আচার খাওয়া থেকে নিজেকে বিরত রাখতে হবে।
সুস্থ ত্বকের জন্য পর্যাপ্ত ঘুম:
ঘুম মানুষের শরীরের ওপর প্রত্যক্ষভাবে প্রভাব ফেলে। পর্যাপ্ত ঘুম না হলে মানুষের নানান অসুখ বিসুখ দেখা দেয় সেই সাথে ব্রণসহ ত্বকের বিভিন্ন অসুবিধা পরিলক্ষিত হয়।
রাত জাগলে ব্রণের মাত্রাও যেন বেড়ে যায়। তাই সুস্থ ও ব্রণমুক্ত ত্বকের জন্য সময়মত ঘুমানো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একজন মানুষের দৈনিক ৭-৮ ঘণ্টা ঘুমানোর প্রয়োজন। পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুমালে এবং রাত জাগার বদঅভ্যেস ত্যাগ করলে ব্রণের সংক্রমণ অনেকাংশে কমে যাবে।
ব্রণের জন্য ফেসওয়াশের ব্যবহার:
ব্রণমুক্ত ত্বকের জন্য ত্বক নিয়মিত পরিষ্কার রাখা খুব জরুরি। ত্বকে লোমকূপে ময়লা জমে ব্রণের সৃষ্টি হয়। তাই ভালো মানের ফেসওয়াশ দিয়ে ঘন ঘন ত্বক পরিষ্কার করা অনিবার্য। তবে সেক্ষেত্রে বাজারের কেমিক্যাল যুক্ত ফেসওয়াশ ব্যবহারে সতর্ক থাকতে হবে। সাধারণত ব্রণ তৈলাক্ত ত্বকে হয়ে থাকে, তাই যেসকল ক্লিনজার ওয়েল কন্ট্রোল করে সেগুলো ব্যবহার করা উপযুক্ত হবে।
প্রসাধনি ব্যবহারের প্রভাব:
ত্বকে ব্রণ থাকলে কোনো ধরনের প্রসাধনি ব্যবহার না করাই উত্তম। প্রসাধনি ব্যবহারে সাময়িক সৌন্দর্যতা বৃদ্ধি করলেও অনেক সময় ত্বকের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে দাড়ায়। তাই যতটা সম্ভব কেমিক্যাল যুক্ত প্রসাধনি এড়িয়ে চলতে হবে এবং অথেনটিক প্রডাক্ট ব্যবহার করতে হবে যেগুলো তৈলাক্ত ত্বকের জন্য উপযোগী।
ব্রণ কমাতে কার্যকর ভেষজ উপাদান:
ব্রণ মোকাবেলায় কেমিক্যাল যুক্ত প্রডাক্ট ব্যবহারের থেকে হারবাল প্রডাক্ট ব্যবহার করা অনেক বেশি কার্যকর। এক্ষেত্রে কিছু ভেষজ উপাদান অসাধারণ ভূমিকা পালন করে। যেমনঃ
*নিম পাতাঃ নিম পাতা বেটে অথবা গুরা করে প্যাক বানিয়ে মুখে মাখলে ব্রণের জন্য অনেক উপকারী। নিমে আছে অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল এজেন্ট যা ব্রণের ইনফেকশন কমাতে অনেক সাহায্য করে থাকে।
*অ্যালোভেরা জেলঃ অ্যালোভেরা জেল ত্বকের আদ্রতা বজায় রাখতে সহায়তা করে পাশাপাশি এতে রয়েছে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, ভিটামিন সি, এ এবং ই। এগুলো ত্বক উজ্জ্বল করে। অ্যালোভেরাতে থাকা এক ধরনের এসিড ব্রণের জন্য দায়ী ব্যাকটেরিয়া দূর করতে সক্ষম।
*মধুঃ এতে রয়েছে ভিটাইন বি, ক্যালসিয়াম, জিংক, পটাশিয়াম এবং লৌহ। এর প্রদাহরোধী উপাদান ত্বকের অতিরিক্ত তেল দূর করে এবং প্রতিদিন ব্যবহারে ত্বকের ভারসাম্য বজায় রাখে।
*কাঁচা হলুদঃ প্রাচীনকাল থেকেই রূপচর্চায় হলুদের ব্যাবহার অতুলনীয়। হলুদের যে উপাদানটি সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে কারকুমিন’। এর শক্তিশালী অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি প্রভাব রয়েছে এবং এটি খুব শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট। যা ব্রণ এবং ব্রণের দাগ দূর করতে অনেক কার্যকর।
কিছু বোনাস টিপস্ঃ ত্বক ঘন ঘন পরিষ্কার করার অভ্যাস করা। বাইরে গেলে সানস্ক্রিন ব্যবহারের অভ্যাসটা গড়ে তুলতে হবে। বাইরে থেকে এসে ভালোভাবে ত্বক ধুয়ে এক টুকরা বরফ দিয়ে ত্বকে মেসেজ করে নেয়া। এতে করে ত্বকের ভেতর ময়লা জমতে পারেনা এবং পোর মিনিমাইজ করতেও সহায়তা করে।
ব্রণ থেকে মুক্তি পেতে এসব নিদর্শনা মেনে চললে ব্রণসহ ত্বকের বিভিন্ন সমস্যা রোধ করা সম্ভব হবে।