‘সান্তিয়াগো’ নামের এক বৃদ্ধ এবং অভিজ্ঞ জেলে ছিল, যিনি টানা ৮৪ দিন যাবত কোন মাছ পাচ্ছিল না। তাই বৃদ্ধ এই জেলেকে সবাই ‘অপয়া’ হিসেবে আখ্যায়িত করে। ছোট একটা ছেলের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল যার নাম ম্যানোলিন।
ম্যানোলিন ছোট থেকেই বুড়ো সান্তিয়াগোর কাছেই মাছ ধরা শিখতো। প্রথম ৪০ দিনের যখন মাছ পাচ্ছিল না তখন ম্যানোলিনের বাবা-মা সান্তিয়াগোর সাথে মাছ ধরতে নিষেধ করে এবং অন্য নৌকায় পাঠিয়ে দেয় কারণ সান্তিয়াগো নিজেই একজন অসফল ব্যাক্তি ছিলেন।
ম্যানোলিনকে বৃদ্ধের সাথে যেতে না দিলেও সে সবসময় বৃদ্ধের খোঁজ-খবর রাখত। যেহেতু ম্যানোলিন সান্তিয়াগোর সাথে যেতে পারল না তাই বৃদ্ধ সান্তিয়াগো একা একা নৌকা নিয়ে সমুদ্রে চলে গেল। সেইদিন ছিল ৮৫ তম দিন। এরপর বড়শি ফেলে বসে ছিল। হঠাৎ করে জোরে একটা টান পড়লো। তার বড়শিতে ধরা পড়ল বিশালাকৃতির ১৮ ফিট লম্বা মারলিন মাছ।
মাছটি এত শক্তিশালী ছিল যে, নৌকাসহ বৃদ্ধকেই গভীর সমুদ্রের দিকে টেনে নিয়ে যেতে থাকলো। টানা ৩দিন লড়াই ও দস্তাদস্তির পরে অবশেষে বিশালাকৃতির মারলিন মাছটাকে বৃদ্ধ বাগে আনতে পারে। কিন্তু মাছ নিয়ে সে নির্বিঘ্নে বাড়ি ফিরতে পারল না।
তীরের দিকে রওনা হওয়ার পথে হামলা করল হাঙরের দলেরা। তীরে পৌঁছাতে পৌঁছাতে পুরো মাছটি খেয়ে ফেললো। যখন সান্তিয়াগো ডাঙায় চলে আসে তখন মাছের কঙ্কাল ছাড়া কিছুই অবশিষ্ট রইল না।
লেখক পরিচিতি
চিত্রঃ ‘দি ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সী’ উপন্যাসের লেখক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে
আর্নেস্ট হেমিংওয়ে জন্মগ্রহণ করে ১৮৯৯ সালের ২১ জুলাই। তিনি ছিলেন একজন মার্কিন সাহিত্যিক এবং সাংবাদিক। তিনি সাতটি উপন্যাস, ছয়টি ছোটগল্প এবং দুইটি অকল্পিত সাহিত্য গ্রন্থ প্রকাশ করেছিলেন। তার মৃত্যুর পর আরও তিনটি উপন্যাস, চারটি ছোটগল্প এবং তিনটি অকল্পিত সাহিত্যগ্রন্থ প্রকাশ হয়েছিল। ‘দি ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সী’ আর্নেস্ট হেমিংওয়ে এর সেরা উপন্যাসগুলির একটি।
এই ছোট উপন্যাসটি ১৯৫১ সালে কিউবায় অবস্থানকালীন সময়ে লিখেছেন এবং ১৯৫২ সালে এটি প্রকাশিত হয়। এটি লেখকের জীবনকালের শেষের দিকে লেখা।
১৯৫৩ সালে ‘দি ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সী’ সাহিত্যে পুলিৎজার পুরস্কার এবং ১৯৫৪ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কার লাভ করে। নোবেল পুরষ্কারের সমুদয় অর্থ তিনি কিউবার দাতব্য সংস্থায় দান করেন। এই কালজয়ী সাহিত্যিক মৃত্যুবরণ করেন ১৯৬১ সালের ২ জুলাই।
‘দি ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সী’ উপন্যাসের কিছু চরিত্র:
সান্তিয়াগো:
তিনি একজন বৃদ্ধ এবং অভিজ্ঞ জেলে। এই সান্তিয়াগোই ‘দি ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সী’ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় বা প্রধান চরিত্র । তার পরিবারে সে ছাড়া আর কেউ নেই। উপকূলের কাছেই ছোট একটি ঘরে একা বসবাস করে।সান্তিয়াগো একজন ভালো মনের মানুষ। টানা ৮৪ দিন কোনো মাছ ধরতে পারে নি তাই মানুষ তাকে বিভিন্নভাবে কটাক্ষ করে, তাও তিনি কারও সাথে খারাপ ব্যবহার করে না।
তার অনেক বয়স হয়েছে তাও তিনি যৌবনের কর্মচঞ্চলতার দিনগুলোর কথা মনে করেন। যৌবনে তিনি কত শক্তিশালী ও সফল ছিলেন একথা ভাবেন।তার অধিকাংশ সময় কাটে তার শিক্ষানবিশ ম্যানোলিনের সাথে যে তার কাছে ছোট থেকেই মাছ ধরা শিখে আসছে।ম্যানোলিন তাকে বয়সে বিভিন্নভাবে সাহায্য করে।
ম্যানোলিন:
‘দি ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সী’ উপন্যাসের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হলো ম্যানোলিন। সে একজন তরুণ কিউবান বালক। সে ছোটো থেকেই শান্তিয়াগোর কাছে মাছ ধরা শিখে আসছে।টানা ৪০ দিন সান্তিয়াগো কোন মাছ শিকার করতে না পারায় তার বাবা-মা সান্তিয়াগোর সাথে মাছ ধরতে নিষেধ করে এবং অন্য নৌকায় পাঠায়। অন্য নৌকায় গিয়ে মাছও পায় সে।
কিন্তু ম্যানোলিনের শ্রদ্ধা মিশ্রিত সাহায্য, সহানুভূতি আর ভালোবাসার হাত বরাবরই সান্তিয়াগোর দিকেই থাকে।টানা ৮৪ দিনও যখন মাছ পাচ্ছিল না তখনও সান্তিয়াগোকে সে অনুপ্রেরণা দিয়ে যায় সে অবশ্যই মাছ ধরতে পারবে ।এছাড়াও সান্তিয়াগোকে বিভিন্নভাবে সাহায্য করে সে।
মারলিন:
মারলিন হচ্ছে এক বিশালাকৃতির মাছ যেটাকে সান্তিয়াগো ধরতে সক্ষম হয়েছে।মাছটি ১৮ ফিট লম্বা ।এতবড় মাছ এর আগে কোন জেলে ধরে নি এমনকি সান্তিয়াগোর জেলে জীবনে এতবড় মাছ সে প্রথম শিকার করে।
সার্ক (হাঙর):
সান্তিয়াগোর শিকার করা মারলিন মাছটি নিয়ে যখন বাড়ির দিকে রওনা হচ্ছিল তখন হাঙরেরা মাছটিকে আক্রমণ করে এবং এটিকে সম্পূর্ণ খেয়ে ফেলে।
উপন্যাসের মূল থিম
মূল থিম হচ্ছে প্রকৃতির সাথে মানুষের প্রতিনিয়ত টিকে থাকার লড়াই। আর এই থিমটি আমাদের লেখক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে কিউবার একজন জেলের মাধ্যমে তুলে ধরেন যার নাম সান্তিয়াগো যে কিনা বিপদসংকুল সময়ে একা লড়াই করে সাহস, বীরত্ব ও পুরুষত্ব দেখিয়েছেন।
নিঃসঙ্গ এক ব্যক্তির দৈনন্দিন জীবনে শত বাধা অতিক্রম করে স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করার প্রচেষ্টা ও দক্ষতাকে তুলে ধরেন। এছাড়া ওস্তাদ ও শিষ্যের মধ্যকার সম্পর্কেও তুলে ধরেন।
আরও পড়ুনঃ
এডওয়ার্ড সাইদের ওরিয়েন্টালিজম: পশ্চিমের বুদ্ধিবৃত্তিক আগ্রাসনের স্বরূপ উন্মোচন
থিংস ফল অ্যাপার্ট: আধুনিক আফ্রিকান সাহিত্যের প্রথম উপন্যাস
উপন্যাসের হাঙরগুলো বাস্তব জীবনের বিভিন্ন বাধাকে তুলে ধরে ।সমুদ্র এখানে রুপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।মূলত মানুষের জীবন সমুদ্রের মতোই প্রবাহমান।
জীবন কখনো অনুকূলে চলে আবার কখনও চলে প্রতিকূলে। আর সেই সমুদ্রের মূল স্রোতধারা ধরে নানা চ্যালেন্জ মোকাবেলা করে আমাদের জীবনে এগিয়ে যেতে হবে যেখানে হতাশ হলে চলবেনা।
কাহিনী সংক্ষেপ:
উপন্যাসের নায়ক সান্তিয়াগো যিনি বুড়ো এবং অভিজ্ঞ কিউবান জেলে।ভাগ্য খারাপ হওয়ায় কারণে টানা ৮৪ দিন যাবত কোন মাছ ধরতে পাচ্ছিল না।
ফলে বৃদ্ধ এই জেলেকে নিয়ে সবাই কটুক্তি করে ও তার যোগ্যতা নিয়ে সবাই সন্দেহ প্রকাশ করে।তার সহকারী ও জেলে জীবনের একমাত্র সঙ্গী ম্যানেলিন। বৃদ্ধ ও বালক দুজনে মিলে সমুদ্রে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করত। টানা ৪০ তম দিনেও মাছ না পাওয়ার ছেলেটিকেও তার বাবা-মা অন্য নৌকায় পাঠায় এবং সেখানে গিয়ে মাছও পায় সে।
কিন্তু ম্যানোলিন সান্তিয়াগোর সাথে মাছ ধরতে না পারলেও বিভিন্নভাবে তাকে সাহায্য করত এবং তাকে অনুপ্রেরণা দিত সে অবশ্যই মাছ ধরতে পারবে।
এছাড়া বৃদ্ধের ভাগ্য ফেরার আশায় প্রার্থনাও করত। এতকিছুর পরেও সান্তিয়াগো নিরাশ হয়নি।নিজের স্বপ্ন ও বিশ্বাসের উপর ছিল তার আস্তা।
তার বিশ্বাস ছিল যে সে একদিন সমুদ্রের সবচেয়ে বড় এবং সুন্দর মাছটি ধরতে পারবে। আর এই স্বপ্ন বাস্তবায়নে সে চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে। অবশেষে ৮৫ তম দিনে তার স্বপ্ন বাস্তবায়ন হওয়ার সুযোগ আসে।সেইদিন তার বড়শিতে ধরা পড়ল এক বিশালাকৃতির মারলিন মাছ।।
মাছটি লম্বায় প্রায় ১৮ ফুট যা ছিল তার নৌকা থেকেও বড়। অভিজ্ঞ জেলে সান্তিয়াগো এটি বুঝতে পারলো তাই নৌকার সাথে বেঁধে মাছটিকে উপকূলে নিয়ে যাবে ঠিক করলো। কিন্তু মাছটা এত শক্তিশালী ছিল যে নৌকাসহ তাকে গভীর সমুদ্রের দিকে টেনে নিয়ে যেতে থাকে।এভাবে মাছটির সাথে বৃদ্ধের তিন দিন লড়াই চলল।
অবশেষে তিনি মাছটিকে নৌকার কাছে টেনে আনলেন এবং তার মাছ ধরার টুল দিয়ে মাছের মাথায় আঘাত করলেন।ফলে মাছটি মারা গেল।তার স্বপ্নও বাস্তবায়ন হলো।
এত যুদ্ধের পরে যখন বৃদ্ধের জয় হলো তখনি উপন্যাসের কাহিনীতে আসে ভিন্ন মোড়। মাছটিকে টুল দিয়ে মাথায় আঘাত করার ফলে মাছের মাথা থেকে রক্তক্ষরণ হয়। আমরা জানি সমুদ্রে কোন রক্তক্ষরণ হলে রক্তের গন্ধে হাঙরেরা ছুটে আসে। এক্ষেত্রেও একি ঘটনা ঘটে।
প্রথমে দুইটি হাঙর ছুটে আসে এবং তাদের মধ্যে একটিকে সান্তিয়াগো মাছ ধরার টুলের আঘাতে মেরে ফেললো ও অন্যটি চলে গেল। কিন্তু দূর্ভাগ্যক্রমে তার টুলটি পানিতে পড়ে গেল ফলে তার কাছে হাঙরদের তাড়ানোর কিছুই ছিল না। তীরে পৌঁছাতে পৌঁছাতে হাঙরের সংখ্যা ও আক্রমণ এত বাড়লো যে ওদের সাথে লড়াইয়ে পেরে উঠল না সান্তিয়াগো।
তার চোখের সামনে খেয়ে ফেললো বিশাল এই মারলিন মাছটি শুধু রেখে গেল মাছের কঙ্কালটি। তীরে ফিরে মাছটি নৌকার সাথে বেঁধে রেখে নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ে এবং গভীর ঘুমে হারিয়ে যায়।
অন্যদিকে সমুদ্রের তীরে বহু মানুষ জড়ো হয় কঙ্কালটি দেখার জন্য।তারা বুঝতে পারছিল না যে এটা মাছের কঙ্কাল নাকি অন্য প্রাণীর কঙ্কাল কারণ এত বড়ো মাছ এখন পর্যন্ত সেইখানার কেউ দেখেনি। জেলেরা অবাক চোখে কঙ্কালটি দেখে এবং বৃদ্ধের জন্য সহানুভূতি প্রকাশ করে। এভাবেই বৃদ্ধ হারানো সম্মান আবার ফিরে পায়।
অবশেষে বলা যায় যে, একজন মানুষ ধ্বংস বা শেষ হয়ে যেতে পারে তবে কখনো আশা বা স্বপ্নের কাছে পরাজিত হতে পারে না।
তথ্যসূত্রঃ
১। উইকিপিডিয়া
২। ‘দি ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সী’ – আর্নেস্ট হেমিংওয়ে
আমি স্কুলে পড়ার সময় উপন্যাসটি পড়েছিলাম!আমি ভুলিনি!উপন্যাসটি আমাকে নাড়িয়ে দিয়েছিল!তাই! এখন প্রায় ৭০ বছর বয়সে পৌঁছে বুঝতে পারছি হেমিংওয়ে যে সত্যিটা অন্তরে গেঁথে দিয়েছিলেন তার গভীরতা কতখানি! ইয়েস,”A man can be destroyed but not defeated!”..