বিভিন্ন দেশি ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম থেকে আমরা জানতে পেরেছি, প্রথমবারের মত মক্কার মসজিদ আল-হারামে অবস্থিত মাকামে ইব্রাহিমের স্বচ্ছ ছবি প্রকাশ করেছে সৌদি আরব। গত বুধবার ছবিটি প্রকাশ করা হয়েছে। মসজিদ আল-হারাম ও মসজিদে নববীর ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ নবী হযরত ইব্রাহিম (আ.)-এর স্মৃতি বিজড়িত এই পাথরটির ছবি নতুন করে সংরক্ষণ করেছেন।
তারা মাকামে ইব্রাহিমের স্বচ্ছ ছবি তোলায় জন্য আধুনিক ফটোগ্রাফিক প্রযুক্তির ব্যবহার করেছেন। পবিত্র এই পাথরটি কাবা শরীফের তাওয়াফ করার খোলা চত্ত্বরের মাঝে অবস্থিত। যা মসজিদ আল-হারাম এবং পবিত্র কাবা শরীফের সাথেই সংলগ্ন রয়েছে।
মুসলিম বিশ্বের দুই পবিত্র মসজিদ বিষয়ক সৌদি ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ নবী হযরত ইব্রাহিম (আ.)-এর স্মৃতি বিজড়িত এই পবিত্র পাথরটির সম্পর্কে তাদের অফিসাল টুইটার অ্যাকাউন্টে বলেছেন যে, এটি জান্নাত থেকে আসা এক রক্তিম পাথর।
সৌদি কর্তৃপক্ষ ওই টুইটের ব্যাখ্যা করে আরো বলেছেন, স্মৃতি বিজড়িত এই পবিত্র বস্তুটি একটি প্রত্নতাত্ত্বিক পাথর। পবিত্র কাবাগৃহ নির্মাণের সময় পাথরটির ওপর নবী হযরত ইব্রাহিম (আ.) যখন দাঁড়াতেন তখন এটি ঠিক বর্তমান লিফটের মতো কাজ করতো। পবিত্র কাবাগৃহ নির্মাণের সময় কাবার উঁচ্চতা নির্মাণ করার জন্য এ পাথরটি ওপর দাঁড়ালে পাথরটি তাঁকে সেই উচ্চতায় নিয়ে যেত। ফলে খুব সহজে কাবার উচ্চতা নির্মাণের কাজ তাঁরা করতে পারতেন।আর এ পাথরটি জান্নাত থেকে তাঁদের কাজে সাহায্যের জন্য পাঠানো হয়েছিল।
সৌদি কর্তৃপক্ষ মূলত বর্তমান প্রযুক্তির সাহায্যে মাকামে ইব্রাহিমের স্বচ্ছ ছবি সংরক্ষণ ও গবেষণার জন্য তারা ছবিটি তুলেছেন। আর ছবিটি বিশ্ব মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ায় মুসলিম বিশ্বে এক নতুন উদ্দীপনা ও আলোরণ সৃষ্টি করছে।
ইসলামি পরিভাষায় মাকাম শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো, দন্ডায়মান ব্যক্তির পা রাখার স্থান। আর মাকামে ইব্রাহিম বলতে সেই পাথরকে বুঝায় যেটা কাবা শরীফ নির্মাণের সময় হযরত ইসমাইল (আ.) নিয়ে এসেছিলেন। যেন পিতা ইব্রাহিম (আ.) এর ওপর দাঁড়িয়ে কাবা ঘর নির্মাণ করতে পারেন। কাবা নির্মানের জন্য হযরত ইসমাইল (আ.) পাথর এনে দিতেন এবং ইব্রাহিম (আ.) তাঁর পবিত্র হাতে তা কাবার দেয়ালে জুড়ে দিতেন। এই কাজের জন্য ঊর্ধ্বে উঠার প্রয়োজন হলে এই পাথরটি অলৌকিকভাবেই ওপরের দিকে উঠে যেত।
সূরা আল ইমরানের এক আয়াতে আল্লাহ তায়া’লা বলেন-“তাতে অনেক সুস্পষ্ট নিদর্শন আছে, যেমন মাকামে ইবরাহীম।” (আয়াত :৯৭)
আয়াতের তাফসিরে বলা হয়েছে-
“কাবাঘর অর্থাৎ বায়তুল্লায় আল্লাহর কুদরতের পরিষ্কার নিদর্শন রয়েছে এবং খলিলুল্লাহ ইব্রাহিম (আ.) এর নিদর্শনাবলী রয়েছে। যার মধ্যে একটি হল তাঁর খলিল ইব্রাহিম (আ.) এর পদচিহ্ন, ওই পাথরে যার ওপর তিনি দাঁড়িয়েছিলেন।”[তাফসীরে তাবারি]
“কা’বাগৃহের বৈশিষ্ট্য ও নিদর্শনাবলীর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, মাকামে ইব্রাহিম। এ পাথরের গায়ে ইব্রাহিম (আ.)-এর গভীর পদচিহ্ন অদ্যাবধি বিদ্যমান। একটি পাথরের উপর পদচিহ্ন পড়ে যাওয়া আল্লাহ্র অপার কুদরতের নিদর্শন এবং এতে কা’বা গৃহের শ্রেষ্ঠত্বই প্রমাণিত হয়। যা আমরা মাকামে ইব্রাহিমের স্বচ্ছ ছবি প্রকাশ হওয়ায় স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি।
যারা হজ্জ করতে যায় তাদের এই পাথরটির কাছে সালাত আদায় করতে হয়। কেননা কুরআনে মাকামে ইব্রাহিমের কাছে সালাত আদায় করার আদেশ নাযিল হয়েছে। তাই তওয়াফকারীদের সুবিধার্থে পাথরটি সেখান থেকে সরিয়ে কা’বা গৃহের সামনে সামান্য দূরে যমযম কুপের নিকট স্থাপন করা হয়। তবে প্রথমে পাথরটি কাবাঘরের নীচে দরজার নিকটে অবস্থিত ছিল।
বর্তমানে মাকামে ইব্রাহিমকে সরিয়ে নিয়ে একটি কাঁচ-পাত্রে সংরক্ষিত করে দেয়া হয়েছে। তাওয়াফ-পরবর্তী নামায এর আশে পাশে পড়া উত্তম। কিন্তু শাব্দিক অর্থের দিক দিয়ে মাকামে ইব্রাহিম সমগ্র মসজিদে হারামকেও বুঝায়। এ কারণেই ফিকহবিদগণ বলেনঃ মসজিদে হারামের যে কোন স্থানে তওয়াফ পরবর্তী সালাত পড়ে নিলেই তা আদায় হয়ে যাবে।” [ তাফসিরে জাকারিয়া ]
চিত্রঃ মাকামে ইব্রাহিমের স্বচ্ছ ছবি
পাথটিতে হযরত ইব্রাহিম (আ.)-এর পদচিহ্ন ১০ সে.মি. গভীর ও অন্যটি ৯ সে.মি. গভীর। দৈর্ঘ্য প্রতিটি পা ২২ সে.মি. এবং প্রস্থে ১১ সে.মি।
বর্তমানে প্রায় ১ মিলিয়ন সৌদি রিয়েল ব্যয় করে মাকামে ইব্রাহিমের বক্সটি নির্মাণ করা হয়েছে। এতে পিতল ও ১০ মি.মি. পুরো কাঁচের গ্লাস দিয়ে চারপাশ নির্মান করা। ভেতরের জালে সোনা চড়ানো হয়েছে। পবিত্র হাজরে আসওয়াদ থেকে মাকামে ইব্রাহিমের দূরত্ব হল ১৪.৫ মিটার।
আকারে এ পাথরটি বর্গাকার। রং সাদা, কালো আর হলুদের মাঝামাঝি। বর্তমানে পাথরটি পবিত্র কাবা শরীফের গেটের কাছে রয়েছে। কাবা শরিফের ১০-১১ মিটার পূর্বে। আর পাথরটির একটি অংশ সাফা ও মারওয়ার পর্বতের দিকে মুখ করা রয়েছে।
মাকামে ইব্রাহিমের স্বচ্ছ ছবি প্রকাশের আগে গত ৪ মে সৌদি আরব প্রথমবারের মতো পবিত্র হাজরে আসওয়াদ (কালো পাথর) এর একটি পূর্ণাঙ্গ স্পষ্ট ছবি প্রকাশ করেছিল [দেখুন..]। ফলে মুসলিম বিশ্ব ইসলামের অতি গুরুত্বপূর্ণ আল্লাহর দুই অলৌকিক পাথরের নতুন স্বচ্ছ ছবি দেখে সবাই মুগ্ধ হয়েছে। সুবহানাল্লাহ।