আমাদের পৃথিবীতে আমরা সবাই সৌন্দর্যের পূজারী। আর নারীদের ক্ষেত্রে এই কথা চিরন্তন সত্য। নিজেকে সুন্দর করে উপস্থাপন, সবসময় পরিপাটি করে রাখা সব নারীরাই করে। তবে এমন নারীর কথা কি শুনেছেন? যিনি সৌন্দর্য, যৌবন ধরে রাখার জন্য কুমারী মেয়ের রক্ত পান করতেন ও সেই রক্ত দিয়ে গোসল করতেন। এমন নৃশংস, বর্বর ঘটনা রয়েছে পৃথিবীতে। আজ জানবো ইতিহাসের এক নৃশংস সিরিয়াল কিলার এলিজাবেথ বাথোরি সম্পর্কে।
যুগে যুগে অনেক সিরিয়াল কিলারের নাম শোনা যায়, এদের কেউই সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ ছিল না। এরা সবাই বিকৃত মস্তিষ্কের মানুষ। তবে পৃথিবীর ইতিহাসে যত সিলিয়াল কিলারের নাম শোনা যায় তাদের সবাই পুরুষ কিন্তু এলিজাবেথ বাথোরি একজন নারী হয়েও নৃশংস সিরিয়াল কিলারের তালিকায় রয়েছেন।
ষোড়শ শতকে হাঙ্গেরির নাইরবাটর এলাকায় বাথোরি নামক এক অভিজাত কাউন পরিবারে ১৫৬০ সালে ৭ অগস্ট জন্ম নেয় এলিজাবেথ বাথোরি।তার অপর নাম “ব্লাড কাউন্টেস” বা “কাউন্টেস ড্রাকুলা” কারণ প্রচলিত তথ্য মতে সে কুমারী মেয়েদের হত্যা করে ভ্যাম্পায়ার দের মত তাদের রক্ত পান করতো।
শিশু অবস্থায়ই এলিজাবেথ এর মৃগী রোগ ধরা পরে। ঘন ঘন অজ্ঞান হয়ে যেতেন তিনি।চিকিৎসায় সুস্থ হয়েও এলিজাবেথের মধ্যে দেখা দেয় ভয়ঙ্কর ক্রোধ। তুচ্ছ কারণের সেই ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটতো। যা সামাল দিতে পরিবারকে হিমশিম খেতে হত।
এলিজাবেথের বাবা জর্জ বাথোরি ছিলেন ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুর মানুষ। তিনি তার কাউনটিতে বসবাসরত কৃষকদের উপর নির্মম অত্যাচার করতেন।সেসব দেখতে দেখতে বড় হচ্ছিলেন এলিজাবেথ বাথোরি।
একবার জর্জ বাথোরি নিরোপরাধ কৃষককে গুপ্তচর ভেবে ভয়ঙ্কর শাস্তি দিয়ে জীবন্ত মানুষক জীবন্ত ঘোড়ার পাকস্তলিতে ঢুকিয়ে সেলাই করে কবর দেন, সেই পুরোটা সময় এলিজাবেথ বাথোরি সেইখানে ছিলেন। মেয়ের এমন সাহস দেখে বাবা সেদিন প্রশংসা করেছিলেন।
মাত্র ১২ বছর বয়সে এলিজাবেথ বাথোরির বিয়ে হয়ে গিয়েছিলো ফেরেন্স নাডাসডির সঙ্গে। ফেরেন্স নাডাসডির পরিবারও ছিল কাউন। কিন্তু তারা খুব বেশি দিন একসাথে থাকতে পারেনি। বিয়ের কয়েক বছর পর জর্জ বাথোরির বাবা মারা যান। স্বামী ফেরেন্সও কাজের জন্য বেশিরভাগ সময় বাইরে থাকতেন। সেই সময় এলিজাবেথের মধ্যে জেগে ওঠে সুপ্ত পিসাচ।
তিনজন কর্মী সেনাসহ, ভিগো ও জো -কে নিয়ে শুরু করেছিলেন কাউনটির এক নারকীয় অধ্যায়। বলা হয়ে থাকে যে মেয়েকে রানী একবার ঘরে ডেকে নিয়ে যেতেন তাকে আর কখনও বের হতে দেখা যায় নি। গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড -এ এই নারীকে সবচেয়ে ধুর্ত ও বর্বর নারী হিসেবে আখ্যা দিয়েছে।
জানা যায় রানী সবচেয়ে দুর্বলতা ছিলো কুমারী মেয়েদের উপর। কুমারী মেয়েদের উপর বর্বর অত্যাচার চালিয়ে,গায়ে মদ ঢেলে দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে দিতেন, লোহার সিক গরম করে লাল হয়ে গেলে তা শর্পাঙ্গে ঢুকিয়ে দিতেন, তীব্র অত্যাচার করে গায়ে মধু মেখে বিষাক্ত পিঁপড়া ছেড়ে দিতেন, দিনের পর দিন অনাহারে রাখা, নগ্ন দেহে বরফের উপর শুয়িয়ে রাখা, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কুপিয়ে কাটা, মুখ, বাহু কামড়ানো, পানিতে ডুবিয়ে রাখা। এমন কোনো অত্যাচার নেই যা তিনি করতেন না। যত রকম পৈশাচিক ও মানসিক অত্যাচার আছে তা তিনি করতেন।
১৬১০ সালে এক গোপন সূত্রে এলিজাবেথের ভাই কাউন জর্জ থার্জো জানতে পারেন, এই নৃশংস অত্যাচারের কথা। একবছর গোপন অভিযান চালিয়ে ১৬১১ সালে সৈন্যসামন্ত নিয়ে হানা দিয়েছিলেন এলিজাবেথের জেদ দুর্গে।
দুর্গের অন্ধকারের ভিতর থেকে বেরিয়ে এসেছিলো অন্ধকার ইতিহাসের এক জীবন্ত নারকীয় দলিল। দুর্গের ভিতর থাকা অন্ধাকার কুয়ায় পাওয়া গিয়েছিল অসংখ্য যুবতীর পঁচতে থাকা দেহ ও কঙ্কাল।
দুর্গের বিভিন্ন গোপন কক্ষে পাওয়া গিয়েছিল অগনিত অত্যাচারীত কঙ্কালসার মৃত্যু অপেক্ষারত বালিকা। দুর্গে এক বালিকার উপর পাশবিক অত্যাচার করার সময় হাতেনাতে ধরা পড়ে এলিজাবেথ বাথোরি ও তার তিন সঙ্গী।
এরপরই তাদের বিচার কার্য শুরু হয়। আজও সেই বিচারের কাগজ পত্র হাঙ্গেরির সরকারি আর্কাইভে সংরক্ষিত আছে। বিচার চলাকালে এক সাক্ষি জানিয়ে ছিলেন ১৫৭৫ থেকে ১৬০৯ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ৩৫ বছরে এলিজাবেথ ও তার তিন সঙ্গী হত্যা করছিলেন প্রায় ৬০০ নিরীহ বালিকা ও কুমারী মেয়ে। এসব হত্যাকান্ডের সাক্ষীদের মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়েছিল এবং মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়েছিল জন সম্মুখে।
বিচারকালে জানা যায় এলিজাবেথ গোসলের সময় বাথটবে যুবতী মেয়েদের তাজা রক্ত ঢেলে গোসল করতেন। তাকে বয়সের তুলনায় তরুণ দেখাবে তাই। পৈশাচিক অত্যাচার করে তিনি যৌন আনন্দ পেতেন। কিন্তু এমন বর্বর পৈশাচিক সিরিয়াল কিলারের বিচার আদালত করতে পারে নি। কারণ তিনি ছিলেন কাউন্টেজ।
কিন্তু তাতে ছাড় পায়নি এলিজাবেথ। তাকে ভয়ঙ্কর শাস্তি দিয়েছিলেন তার ভাই কাউন জর্জ থার্জো।এলিজাবেথের জেদ দুর্গের এক গোপন কক্ষে তাকে রেখে দিয়ে এক দেলায় গেঁথে দিয়েছিলেন। দুটি ইটের সমান একটু ফাঁকা গর্ত রাখা হয়েছিলো। যা দিয়ে আলো ও বাতাস ঢুকতো। সেই গর্ত দিয়েই খাবার ও পানীয় দেওয়া হত। আর সেইটুকু জায়গাতেই সে মলমূত্র ত্যাগ করতো। নিজের আবিষ্কার করা সেই নারকীয় কষ্ট সেই প্রথম অনুভব করেছিল এলিজাবেথ।
প্রায় চার বছর বদ্ধ কুঠুরিতে নরক যন্ত্রণা ভোগ করে এক সকালে তার লাশ ঘরের মেঝেতে পরে থাকতে দেখা যায় ১৬১৪ সালে। এলিজাবেথের পচনধরা শরীর কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিল তখন পীঁপড়ার দল। এলিজাবেথ বাথোরিকে ইতিহাসে নৃশংসতম, বর্বর খুনি বলা হয়।
এলিজাবেথ বাথোরি নিজের গড়া সেই নরক যন্ত্রণাতে নিজেই তীলে তীলে শেষ হয়ে গেছেন। কেউ তাকে রক্ষা করতে পারেন নি। নিজের কর্মফল নিজেকে ভোগ করতে হয়। এলিজাবেথ বাথোরিও রক্ষা পায় নি।
মন্তব্য লিখুন