চলছে অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২১। করোনা পরিস্থিতির কারণে প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি মাসে আয়োজিত বাংলাদেশের জাতীয় বই মেলা এ বছর মার্চ মাসে অনুষ্ঠিত হয়েছে। ১৮ মার্চ থেকে ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত চলবে এবারের মেলা। বাংলাদেশের লেখক ও পাঠকদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি আয়োজন অমর একুশে গ্রন্থমেলা । বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশেও বই মেলা আয়োজন করা হয়ে থাকে। জেনে নেয়া যাক আলোচিত কিছু বই মেলা সম্পর্কে-
আর্টিকেলে যা থাকছেঃ
বাংলাদেশে আয়োজিত অমর একুশে গ্রন্থমেলা বা একুশে বই মেলার রয়েছে বেশ সুন্দর এবং গর্ব করার মত ইতিহাস। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষা বাংলায় কথা বলার দাবিতে পাকিস্তানি হানাদারদের হাতে প্রাণ হারায় বাংলার সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউর সহ নাম না জানা অনেকেই। ভাষার জন্য তাদের এ ত্যাগের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর উদ্দেশ্যে এই মেলাকে একুশে গ্রন্থমেলা হিসেবে নামকরণ করা হয়।
জানা যায়, স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি চিত্তরঞ্জন সাহা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বর্ধমান হাউজের বটতলায় কলকাতা থেকে আনা মাত্র ৩২টি বই নিয়ে এ মেলার সূচনা করেছিলেন।
১৯৭২-৭৬ সাল পর্যন্ত তিনি এই মেলা চালিয়ে যান । পরবর্তীতে ১৯৭৮ সালে বাংলা একাডেমীর তৎকালীন মহাপরিচালক আশরাফ সিদ্দিকী বাংলা একাডেমীর সাথে সরাসরি এ মেলাকে যুক্ত করেন। ১৯৭৯ সালে মেলার সাথে যুক্ত হয় বাংলাদেশ পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক সমিতি।
প্রথমবারের মত পরিপূর্ণ ভাবে একুশে বই মেলা আয়োজিত হয় বাংলা একাডেমীতে, ১৯৮৪ সালে। শুরুতে এই মেলা ফেব্রুয়ারির শুরু থেকে ২১ তারিখ পর্যন্ত হত। তবে এর জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকলে মেলার ব্যাপ্তি বাড়িয়ে পুরো ফেব্রুয়ারি মাসব্যাপী আয়োজন করা হয়।
বাংলা একাডেমীর বর্ধমান হাউজ প্রাঙ্গণে মেলা আয়োজিত হয়। তবে ২০১৪ সাল থেকে মেলাকে সম্প্রসারিত করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান পর্যন্ত বিস্তৃত করা হয়। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় মেলা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে ।
বাংলাদেশের প্রকাশনী ছাড়াও ভারত, জাপান এবং রাশিয়ান প্রকাশনীর বই মেলায় স্থান পায়। প্রকাশনীর স্টলগুলোকে বিভিন্ন এলাকায় যেমনঃ প্রকাশক এলাকা, প্রকাশক-বিক্রেতা এলাকা, শিশু কর্ণার, সরকারি-বেসরকারী প্রতিষ্ঠান, লিটল ম্যাগাজিন ইত্যাদি ভাগ করে দেয়া হয়।
এছাড়াও মেলা চত্বরকে ভাষা শহীদ সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউর এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, আব্দুল করিম প্রমুখের নামে চিহ্নিত করা হয় । মেলায় প্রবেশের জন্য কোনো ফি নির্ধারিত করা হয় না।
২০১০ সাল থেকে মেলার প্রবর্তক চিত্তরঞ্জন সাহার সম্মানে গুণগত মানের বিচারে প্রকাশকদের জন্য “চিত্তরঞ্জন সাহা স্মৃতি পুরস্কার” দেয়া হয়। এছাড়াও স্টল ও অঙ্গসজ্জার জন্য রয়েছে “সরদার জয়েনউদ্দীন স্মৃতি পুরস্কার” এবং সর্বোচ্চ সংখ্যক বই ক্রয় করা ক্রেতার জন্য রয়েছে “পলান পুরস্কার”।
কলকাতায় প্রতিবছর আয়োজিত হয় আন্তর্জাতিক পুস্তকমেলা যাকে সাধারণত কলকাতা বই মেলা বলা হয়। এটি বিশ্বের বৃহত্তর অবাণিজ্যিক মেলা। অর্থাৎ বাংলাদেশের একুশে গ্রন্থ মেলার মতই সাধারণ পাঠকদের জন্য আয়োজন করা হয় এ মেলার।
১৯৭৬ সালের ৫ মার্চ কলকাতা বই মেলার সূচনা হয়। ১৯৮৪ সালে এটি আন্তর্জাতিক বই মেলার স্বীকৃতি লাভ করে। বর্তমানে প্রতিবছর জানুয়ারি মাসের শেষ বুধবার ১২ দিন ব্যাপী এ মেলার উদ্বোধন করা হয়। মেলাটির আয়োজন স্থান বর্তমানে পূর্ব কলকাতার মিলন মেলা প্রাঙ্গণ।
আন্তর্জাতিক মেলা হলেও এখানকার সিংহভাগ বইই বাংলা ভাষার। কলকাতার অত্যন্ত জনপ্রিয় এ মেলায় বাংলাদেশী লেখকদের বইও সমাদৃত । কলকাতা বই মেলাকে বলা হয় “বাঙালির চতুর্দশ পার্বণ”।
বিশ্বের বৃহত্তর বাণিজ্যিক বই মেলা আয়োজিত হয় জার্মানীর ফ্রাঙ্কফুর্ট শহরে। আন্তর্জাতিক পুস্তক ও প্রকাশনা সংক্রান্ত এ মেলাকে সাধারণত ফ্রাঙ্কফুর্ট পুস্তক মেলা বলা হয়। বাণিজ্যিক ধারার এ মেলায় সাধারণ ক্রেতা-বিক্রেতারা থাকে না। বরং এই মেলা মূলত বিভিন্ন দেশের লেখক, প্রকাশক এবং পুস্তক বিপণনকারীদের জন্য আয়োজিত হয়।
২০০৬ সালে শ্রাবণ প্রকাশনীর অংশগ্রহণের মাধ্যমে ফ্রাঙ্কফুর্ট পুস্তক মেলায় বাংলাদেশের পদার্পণ হয়। বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এ মেলা আয়োজিত হয় অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি সময়ে, ৫ দিনের জন্য।
প্রথম তিন দিন কেবল লেখক ও প্রকাশকদের জন্য মেলা উন্মুক্ত থাকে। তবে ছুটির দিনে সাধারণ পাঠকরাও যেতে পারে। প্রতিবছর ফ্রাঙ্কফুর্ট পুস্তক মেলায় বিভিন্ন দেশের হাজার হাজার লেখক প্রকাশকরা আসেন তাদের বইয়ের প্রচারের জন্য।
বিখ্যাত এ বই মেলার রয়েছে ৫০০ বছরের ইতিহাস। যখন হাতে লেখা বইয়ের প্রচলন ছিলো তখন থেকে এ মেলা আয়োজিত হয়ে আসছে।
লন্ডন বই মেলাও একটি বৃহৎ গ্রন্থ প্রকাশন সংক্রান্ত বাণিজ্যিক বই মেলা। ফ্রাঙ্কফুর্ট পুস্তক মেলার মত বৃহৎ পরিসরে না হলেও গুরুত্বের বিচারে ফ্রাঙ্কফুর্টের পরেই এর অবস্থান। এ মেলা সাধারণত এপ্রিল মাসে অনুষ্ঠিত হয়।
বর্তমানে ১০০টিরও বেশি দেশের প্রায় ২৩,০০০ প্রকাশক, গ্রন্থ বিক্রেতা, লিটারারি এজেন্ট, গ্রন্থাগারিক, গণমাধ্যম ও শিল্প সরবরাহকারী মেলায় অংশ নিয়ে থাকে। প্রকাশনীগুলো নিজেদের নতুন বইয়ের প্রচার এবং অন্যান্য প্রকাশনীর বই পরিবেশন এবং অনুবাদের সত্ত্ব কিনে থাকে এ মেলায়।
আমেরিকার বাণিজ্যিক এ বই মেলা প্রতি বছর মে মাসের শেষের দিকে অথবা জুন মাসের প্রথম দিকে ৪ দিনের জন্য অনুষ্ঠিত হয়। বুক এক্সপো একেক বছর একেক শহরে আয়োজিত হয়ে থাকে।
১৯৪৭ সালে American Booksellers Association Convention and Trade Show নামে এ মেলার যাত্রা শুরু হয়। ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত এই নামেই মেলাটি আয়োজিত হয়েছে। ১৯৯৫ সাল থেকে বর্তমান নাম অর্থাৎ বুকএক্সপো আমেরিকা নামে পরিচিত এই মেলা।
সূচনালগ্ন থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত মেলাটি ওয়াশিংটন ডিসিতে অনুষ্ঠিত হত। পরের বছরগুলো ভিন্ন ভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ শহরে মেলাটি আয়োজন করা হয়। আমেরিকার গুরুত্বপূর্ণ এ বাণিজ্যিক বই মেলায় সেখানকার প্রায় সকল প্রকাশনী এবং অন্যান্য অনেক দেশের প্রকাশনী অংশ নিয়ে থাকে।
জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে বইমেলার গুরুত্ব ও জনপ্রিয়তা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। একটি দেশের সাহিত্য-শিল্প-সাংস্কৃতির সাথে পরিচিত হওয়ার জন্য বই মেলা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
মন্তব্য লিখুন