ইসলামে কারাগারের ইতিহাস সম্পর্কে আমরা অনেকেই হয়তো ভালো করে অবহিত নই৷ তবে বাংলায় কারাগার বা বন্দিশালা অথবা জেলখানা শব্দটির সাথে আমরা সকলেই পরিচিত৷ কারাগার শব্দ শুনলেই আমরা বুঝতে পারি, অপরাধীকে শাস্তি দেওয়া ও বন্দি করে রাখার স্থান। কিন্তু কারাগারের উদ্দেশ্য কি শুধু শাস্তি দেওয়া ও বন্দি করে রাখা? আজ আমরা ইসলামে কারাগারের ইতিহাস বা ইসলামি সভ্যতায় কারাগার এর ইতিহাস এবং নিয়ম শৃঙ্খলা নিয়ে সংক্ষিপ্ত কিছু উপস্থাপন করার চেষ্টা করবো, ইনশাআল্লাহ।
আর্টিকেলে যা থাকছেঃ
পবিত্র কোরআনে সূরা ইউসুফের ঘটনা আমরা হয়তো সকলেই জানি। ঘটনার তাফসিরে পাওয়া যায়, নবী ইউসূফ (আ.) প্রায় ৭ বছর মতান্তরে ১০ বছর কারাগারে বন্দি ছিলেন। মিশরের তৎকালীন শাসক তাঁদের নিজেদের পাপ গোপন করার জন্য অন্যায়ভাবে হযরত ইউসূফ (আ.) কে এই দীর্ঘসময় করাগার এ বন্দী করে রাখে।
যেমন পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ তায়ালা নবী ইউসূফের বানী উল্লেখ করে বলেন, “হে আমার প্রতিপালক! তাদের আহৃত কাজ থেকে কারাগার আমার কাছে অনেক প্রিয়।” (সুরা ইউসুফ: ৩৩)
পবিত্র কোরআনে ইউসূফ (আ.)-এর ঘটনা ছাড়াও হযরত মূসা (আ.) এর ঘটনা উল্লেখ করেন৷ সেই ঘটনায় উল্লেখ করা হয়, মিশরের তৎকালীন শাসন ফেরাউন হযরত মূসা (আ.) কে কারাগারের ভয় দেখিয়ে বলেছিল, “তুমি আমাকে ছাড়া অন্য কোনো উপাসক গ্রহণ করলে আমি তোমাকে কারাবন্দিদের অন্তর্ভুক্ত করব।”(সুরা শুআরাঃ২৯)
ইসলামে কারাগারের ইতিহাস অনুযায়ী উক্ত ঘটনার আলোকে ঐতিহাসিকরা ধারনা করেন প্রাচীন মিশরেই প্রথম কারাগার এর উদ্ভব হয় বা সূচনা হয়৷
ইসলাম-পূর্ব জাহেলি যুগের সময় আরব জাতির মাঝে কারাগারের প্রচলন লক্ষ করা যায়। তখনকার হিরার শাসকগণ মুনাজিরাদের সময় ইরাকে শহরে বেশ কিছু কারাগার তৈরি করেন। তবে তখনকার কারাগার এর জাহিলিয়াতের কথা বর্ননা করার ভাষা নেই, তাই ইতিহাস থেকে জেনে নিতে পারেন।
পরবর্তীতে যখন আরব সমাজে ইসলামের আগমন হয়৷ তখন পবিত্র কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে অপরাধের শাস্তির বিধান করা হয়৷
ইবনে তাইমিয়া (রহ.) ফাতোয়া অনুসারে -কিছু অপরাধ রয়েছে যা পবিত্র কোরআন ও সুন্নাহে সুস্পষ্ট নয়। এরকম অপরাধের শাস্তিকে ‘তাজির’ বলা হয়। যা বিচারকগণ কোরআন সুন্নাহর গবেষণার আলোকে অপরাধের মাত্রা অনুসারে প্রদান করে থাকেন। ইসলামি শাস্তির বিধান মতে, কারাগার শুধু অপমান, লাঞ্ছিত বা অপদস্থ করার জন্য তৈরি করা হয় না৷ বরং কারাগার হলো ব্যক্তির অপরাধমূলক নিজস্ব কার্যকলাপে বাধা সৃষ্টির করার একটি মাধ্যম মাত্র। এটি মসজিদ প্রাঙ্গণে বা ঘরের মধ্যে রেখেও করা যেতে পারে।
একটি কথা বলে নেই, রাসূল (সা.) এর যুগে প্রচলিত অর্থে যে কারাগার ব্যবহার করা হয়। এমন কোনো জেল ছিল না। বরং বিভিন্ন শাস্তি দেওয়ার প্রয়োজনে নিদিষ্ট কোনো স্থানে বন্দি করে রাখা হতো।
যেরকমটি হাদিসে লক্ষ করা যায়, “সুমামা বিন উসাল (রা.)-কে তিন দিন মসজিদের খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়। সেখানে তিনি সাহাবিদের প্রত্যাহিক কার্যকলাপ প্রত্যক্ষ করে ইসলাম গ্রহণ করেন। মসজিদে বন্দি করায় মুসলিমদের কারনে বহু অমুসলিম ইসলাম গ্রহণ করেছেন।” (সহিহ বুখারি)
অর্থাৎ তখন অপরাধের শাস্তির ব্যবস্থা বেশি ভাগ মসজিদের প্রাঙ্গনে করা হতো এবং সেখানেই বেঁধে রাখা হতো।
ইসলামে কারাগারের ইতিহাস অনুসারে রাসূল (সা.) এর ওফাতের পর হযরত ওমর (রা.) এর শাষনামলে ইসলামি সাম্রাজ্য ব্যাপক বিস্তৃতি লাভ করে। তাই অপরাধ ধমনের জন্য কারাগার তৈরি করার প্রয়োজন দেখা দেয়৷ ফলে হযরত ওমর (রা.) মক্কায় অবস্থিত সফওয়ান বিন উমাইয়ার ঘর ৪ হাজার দিরহামে ক্রয় করেন। আর এই ঘরটিকেই কারাগারে রূপান্তর করেন। ইসলামি ইতিহাসে এটি ছিল সর্বপ্রথম কারাগার। তাই ওমর (রা.) কে ইসলামি ইতিহাসে কারাগারের প্রতিষ্ঠাতাও বলা হয়ে থাকে।
হযরত ওমর (রা.) ওফাতের পর ইসলামের চতুর্থ খলিফা হযরত আলী (রা.) কারাগারটির অবকাঠামোকে আরো দীর্ঘ ও প্রাতিষ্ঠানিকরূপ প্রদান করেন। তাই সামগ্রিকভাবে ইসলামের ইতিহাসে আলী (রা.) কেও কারাগার এর সূচনাকারী হিসেবে পরিচিত করা হয়৷
উমাইয়া শাসনামলে কারাগারের পরিধী ব্যাপক বিস্তৃতি লাভ করে। হযরত মুয়াবিয়া (রা.)-এর শাষণে দামেস্কের ‘আদ দারুল খাজরা’ নামক একটি প্রাসাদ প্রশাসনিক সব কাজের জন্য ব্যবহার কারা হতো। আর এই প্রাসাদের অভ্যন্তরে একটি কারাগারও স্থাপন করা হয়েছিল। রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলাবিরোধী কোন কাজ কেউ করলে তাকে এখানে বন্দি করা হতো৷ (আত তানবিহ ওয়াল ইশরাফ, মাসউদি)
আব্বাসীয় শাষনামলের যুগে কারাগার এর ব্যবস্থাপনা আরো আধুনিক করা হয়। এই খেলাফতের সময় রাজধানীতে ‘মুতবিক‘ একটি কেন্দ্রীয় কারাগার বা জেল স্থাপন করা হয়।
মদিনার গভর্নরের নির্দেশে মদিনাতেও এমন একটি কারাগার স্থাপন করা হয়। তবে কুফার কারাগারটি তখনকার সময়ে ছিল সবচেয়ে বেশি বিস্তৃত ও সুরক্ষিত। ইরাকের শাসনকর্তা হাজ্জাজ বিন ইউসুফের সময়ে আরো অনেক কারাগার স্থাপন করা হয়। তখনকার সময়ে ওয়াসেত নগরীর দিময়াসে অবস্থিত কেন্দ্রীয় কারাগারটি ছিল সবচেয়ে ভয়ানক কারাগার। (আল মুনতাজাম )
ইসলামে কারাগারের ইতিহাসে এখান থেকেই অধুনিক কারাগারের সূচনা শুরু হওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়।
কারাগারের ব্যবস্থাপনা ও সার্বিক পরিস্থিতি সুবিন্যস্ত করার জন্য ওমর বিন আবদুল আজিজ (রহ.) কারা বন্দিদের নাম ও অবস্থা নথিপত্রে লেখার ব্যবস্থা শুরু করেন। তাই তিনি হানাফি মাঝহাবের প্রসিদ্ধ ইমাম আবু ইউসুফ (রহ.) কে এ দায়িত্ব দেন এবং তিনি ওমর বিন আবদুল আজিজ (রহ.)-এর নির্দেশনাগুলো বাস্তবায়নে সচেষ্ট হন।
উমাইয়া শাসনামলে শেষের দিকে কারাবন্দিদের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। যা আব্বাসী যুগের শুরুতেও অব্যাহত থাকে। তাই খলিফা হারুনুর রশিদ কারা বন্দিদের আচরনবিধি নিয়ে একটি নীতিমালা প্রনয়ণ করার জন্য তৎকালীন প্রধান বিচারপতি ইমাম আবু ইউসুফ (রহ.) কেই দায়িত্ব দেন। যা পরবর্তীতে তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘আল খারাজ’ উল্লেখ করা হয়েছে।
ইমাম আবু ইউসুফ (রহ.) তাঁর ‘আল খারাজ’ গ্রন্থে কারাবন্দিদের অধিকার বিষয়ে ওমর বিন আবদুল আজিজ (রহ.)-এর নির্দেশনার কথা উল্লেখ করে বলেনঃ-
“কারাবন্দিদের প্রতি সদয় হও, যেন তাদের জীবনাবসান না হয়। তাদের জন্য পর্যাপ্ত খাবারের ব্যবস্থা করো। তিনি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নির্দেশ দিয়ে বলেন, কারাবন্দিদের মধ্যে নিরপরাধ কেউ যেন না থাকে। অপরাধ নিশ্চিত না হয়ে কাউকে বন্দি করবে না। কারো ব্যাপারে সন্দিহান হলে আমাকে জানাবে। আর অশ্লীল কাজে লিপ্ত লোকদেরও বন্দি করার আগে নিশ্চিত হও। শাস্তি প্রয়োগের সময় বাড়াবাড়ি করবে না।
বন্দিদের কেউ অসুস্থ হলে তার দেখাশোনা করো। ঋণ পরিশোধে অপারগ বন্দিদের ব্যভিচারকারী বন্দিদের সঙ্গে রাখবে না। বন্দিশালায় নারীদের জন্য পৃথক কক্ষের ব্যবস্থা করবে। বন্দিদের দেখাশোনার দায়িত্বে তোমার আস্থাবান ও উৎকাচ গ্রহণ করে না এমন নীতিবান ব্যক্তিকে নিযুক্ত করো। উৎকাচ গ্রহণকারী যেকোনো অন্যায় কাজে লিপ্ত হতে পারে।”(ইমাম আবু ইউসুফ, আল খারাজ)
ইসলামে কারাগারের ইতিহাস এ কারাবন্দিদের ব্যয়ভার সম্পর্কে ‘আল খারাজ’ গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছেঃ-
“প্রত্যেকের ব্যয়ভার বাইতুল মাল থেকে বহন করাই আমার কাছে অধিক উপযুক্ত মনে হয়। মুশরিক তথা অমুসলিম বন্দিদের সঙ্গে সদাচার করা হবে এবং কারাগার থেকে খাবারের ব্যবস্থা করা হবে। মুসলিম অপরাধী বন্দির ক্ষুধার কারণে মারা যাওয়া কল্পনাতীত ব্যাপার।”
ইমাম আবু ইউসুফ (রহ.) খলিফা হারুনুর রশিদকে অনুরোধ করেন বলেনঃ-
“যেন বন্দিদের কাছে সরাসরি অর্থকড়ি দেওয়া হয়; নতুবা জেলারের কাছে দেওয়া হলে তা বন্দির কাছে পৌঁছাবে না। হারুনুর রশিদকে তিনি বলেন, এ কাজে আপনি একজন নীতিবান ব্যক্তিকে নিয়োগ দেবেন। প্রতি মাসের অর্থপ্রাপ্তদের নামে নথি থাকবে তার কাছে।”
বর্তমানে আমরা যেসব কারাগারে এসব নিয়ম দেখতে পাচ্ছি তার সূচনা ইসলামি সাম্রাজ্যের সময়ই নির্ধারণ করা হয়েছিল। অথচ আমরা এসব বিষয়ে ভালো করে আগে জানতেই পারি নাই।
ইসলামে কারাগারের ইতিহাসে প্রত্যেক খলিফায়ে রাশেদা এবং ইমামদের মতানুসারে কারাগার এ বন্দিদের তাদের পরিবারের সাথে সাক্ষাৎ করতে দিতে হবে। এমন কি দীর্ঘ দিন স্বামী-স্ত্রী আলাদা থাকার ফলে যেন একে অপরের হক নষ্ট না হয়। সে জন্য তাদের মিলিত হওয়ার ব্যবস্থার কথাও বলা হয়েছে। হযরত ওমর (রা.), সাহাবী যুগ (রা.), মুসলিম সব খেলাফতের সময় সহ বর্তমানে বহু মুসলিম দেশে এই ব্যবস্থা করা হয়।
আপনি যদি তুরস্ক সহ পৃথিবীর বিভিন্ন কারগারের দিকে লক্ষ করেন তবে সেখানে কয়েদীদের আচারনে ভালো দিক পরিলক্ষিত হলে তাদের জন্য এ সুযোগ দেওয়া হয়।
এ ছাড়া ইমাম মুহাম্মাদ (রহ.) বলেছেন, “পরিবার-পরিজন ও আত্মীয়দের বন্দির সঙ্গে দেখা করতে না দেওয়া কোনোভাবেই উচিত নয়। বন্দিদের শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করা ইসলামী আইনজ্ঞদের মতে অন্যায়। নির্যাতনের কারণে কোনো বন্দির মৃত্যু হলে তা ইচ্ছাকৃত হত্যা বলে গণ্য হবে এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকেও ‘কিসাস’-এর ভিত্তিতে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে। “
নানা কারণে অনেক নারীরাও বন্দি হয়েছে। তাই ইসলামে কারাগারের ইতিহাস এর সূচনাকাল থেকেই কারাগারে নারীদের জন্য পৃথক থাকার ব্যবস্থা ছিল। নারীদের পৃথক ব্যবস্থার প্রতি মুসলিম আইনবিদরা বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছেন। নারী বন্দিদের দায়িত্বেও একজন নারী দায়িত্বশীল নিয়োগের নির্দেশনা দিয়েছেন তাঁরা।
ইসলামে করাগারের ইতিহাসে বন্দি সকলের সাথে সদয় আচারনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যদিও অপরাধের ভিত্তিতে তাকে বিভিন্ন শাস্তি ভোগ করতে হতে পারে৷ কিন্তু বিচারের বহির্ভূত কোনো আত্যাচার তাদের উপর করা নিষেধ। মানুষ হিসেবে প্রত্যেকের থাকতে হবে সম্মানবোধ। সে ব্যক্তি স্বাধীন হোক কিংবা বন্দিহোক। প্রত্যেক মুসলিমের মানবিক দৃষ্টিকোন থেকে প্রত্যেকের প্রতি অনুগ্রহ- অনুকম্পা থাকা জরুরি। স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা মানুষের প্রতি সদয় আচারনের নির্দেশ দিয়েছেন।
মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, “আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমি আদমের সন্তানদের সম্মান দান করেছি, স্থলে ও সমুদ্রে তাদের চলাচলের বাহন দিয়েছি, তাদের উত্তম রিজিক দিয়েছি, আমার অনেক সৃষ্টির ওপর তাদের শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি।”(সুরা বনি ইসরাঈল: ৭০)
বদর যুদ্ধে অনেক কাফের যখন মুসলিম বাহিনীদের হাতে বন্দি হয়। তখন বন্দিদের জন্য সাহাবিদের উদ্দেশে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন-“তোমরা বন্দিদের সঙ্গে উত্তম ব্যবহার কোরো।“(আল মাগাজি)
ইসলামে কারাগারের ইতিহাস এ আরো দেখা যায় কারাগার এ কোনো বন্দি অসুস্থ হলে তার প্রতি সদয় ও যত্ন নেওয়া আবশ্যক। তাকে চিকিৎসা- সেবা দিয়ে সুস্থ করা কারা কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব।
ইমরান বিন হুসাইন (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, “জুহাইনা গোত্রের এক গর্ভবতী নারী তাঁর কাছে এসে বলে, হে আল্লাহর রাসুল, আমি ‘হদ’-এর উপযুক্ত। আমার ওপর তা প্রয়োগ করুন। রাসুল (সা.) তার আত্মীয়কে ডেকে বলেন, ‘এই নারীর প্রতি সদাচার করবে। সন্তান প্রসব করলে তাকে আমার কাছে নিয়ে আসবে।”( সহিহ মুসলিম)
ইমাম আবু ইউসুফ (রহ.) কারাগার এ প্রত্যেক অসুস্থ বন্দির প্রয়োজনীয় চিকিৎসার ব্যবস্থা করার নির্দেশ দিয়েছেন। খলিফা মুকতাদির বিল্লাহর শাষনামলের সময়ে কারাবন্দিদের জন্য নির্ধারিত চিকিৎসক ছিল। তারা প্রতিদিন বন্দি রোগীদের চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধ নিয়ে আসতেন।
কারা বন্দিদের জন্য উত্তম খাবারের ব্যবস্থা করা ইসলামের নির্দেশনা। তাতে কারাবন্দি যেই হোক না কেন তাকে ক্ষুধার কষ্ট দেওয়া যাবে না।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, “তারা খাবারের প্রতি আসক্তি সত্ত্বেও অভাবগ্রস্ত, এতিম ও বন্দিদের আহার করায়।” (সুরা দাহর : ৮)
রাসূল (সা.) এর সময় সুমামা বিন উসাল নামক ব্যক্তি কে মসজিদে তিন দিন বন্দি করে রাখা হয়। তখন রাসুল (সা.) তার সাহাবিদের বলেন, “তোমরা তার সঙ্গে সদাচার কোরো। তোমাদের খাবার একত্র করে তার কাছে পাঠাও। সাহাবারা রাসুল (সা.)-এর উটের দুধও তার কাছে পাঠাত।”(সহিহ বুখারি)
ইসলামে কারাগারের ইতিহাসে বদর যুদ্ধের একটি ঘটনা, প্রখ্যাত সাহাবি মুসআব বিন উমাইর (রা.)-এর ভাই আবু আজিজ বিন উমাইর (রা.) বদর যুদ্ধে বন্দি হয়েছিলেন। তিনি বর্ণনা করেন, “আমি বদর যুদ্ধে বন্দি ছিলাম। রাসূলু্ল্লাহ (সা.) বলেন,‘তোমরা বন্দিদের প্রতি সদাচার করো।’ আমি আনসারিদের একটি দলে বদর প্রান্তর থেকে ফিরছিলাম। তারা সকাল-বিকাল খেজুর খেত। আর রাসুলের নির্দেশের কারণে আমাকে বিশেষভাবে রুটি দিত। তাদের কারো হাতে রুটির টুকরা থাকত না। ফলে আমার খেতে লজ্জা লাগত। আর কাউকে দিতে চাইলেও সে নিত না।” (মাজমাউজ জাওয়ায়িদ )
কারাগার এ বন্দিদের জন্য কাপড়ের ব্যবস্থা করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যখন বন্দিদের কাপড়ের সংকট দেখা দিবে তখন তাদের কাপড়ের ব্যবস্থা করা আবশ্যক। হাদিস শরীফে পাওয়া যায় রাসূল (সা.) বদর যুদ্ধের পর বন্দিদের যাদের কাপড়ে সংকট ছিল তাদের কাপড়ের ব্যবস্থা করে দেন।
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সময়ে অনেক কারাবন্দি ছিল যারা তাঁর আদর্শ ও সাহাবাদের আচার- আচারন দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে ইসলাম গ্রহন করেছিল৷ যখন অনেক বন্দিদের মদিনায় আনা হতো তখন তারা রাসূল (সা.) সহচরদের আদর্শ দেখে ইসলাম গ্রহণ করে নিত৷
ইসলামে কারাগারের ইতিহাস অনুযায়ী কারাগার স্থাপনের পর আলী (রা.) প্রায়ই বন্দিদের দেখতে যেতেন এবং তাদের সম্পর্কে খোজ খবর নিতেন। হযরত ওমর (রা.) প্রতি সপ্তাহে একবার করে কারাগার এ বন্দিদের দেখতে যেতেন। তাদেরকে বিভিন্ন বিষয়ে নসিহত ও দিকনির্দেশনা দিতেন।
গাজী সুলতান সালাহউদ্দিন (রহ.) মিশরের শাসকের দায়িত্ব নেওয়ার পর সপ্তাহে অন্তত দুই দিন তিনি সবার অভিযোগের কথা শুনতেন। একটি কারাগার এর দুরবস্থার কথা তিনি জানতে পারেন। অবশেষে তিনি তা ভেঙে ফেলে সেখানে একটি মাদরাসা স্থাপন করেন। (আল মুকাদ্দিমা)
কারাগার শুধু অপরাধীদের বন্দি করে রাখার জায়গা নয়। কারাগার মূলত অপরাধীদের সংশোধন করার একটি জায়গা। অপরাধীদের বন্দি করে রাখলাম। অমনি অপরাধ ধমন হয়ে যাবে ইসলাম এ কথা কখনোই বলে না৷ বরং অপরাধীকে যথা সম্ভব সংশোধনের চেষ্টা করাও জেলখানার একটি রীতি।
আমাদের সামাজে যে সকল অপরাধের জন্ম হয়৷ তার অধিকাংশই হয় আর্থসামাজিক দূর্বলতার কারনে৷ চুরি-ডাকাতি, লুটপাত ও ছিনতাই এসবের মধ্যে অন্যতম। অপরাধী কে কারাগার এ বন্দি করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব এবং তাকে সংশোধনের চেষ্টা করাও রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব। তবেই তো সমাজে আদর্শ মানুষের জন্ম হবে। কিন্তু ইসলামে কারাগারের ইতিহাস সম্পর্কে আমাদের ভালো করে ধারনাটি পর্যন্তও নেই।
মহান আল্লাহ তাআলা বলেন, “আমি কোনো জনপদ ধ্বংসের ইচ্ছা করলে এর বিত্তবানদের সৎকাজের নির্দেশ দিই, তারা পাপাচারে লিপ্ত হয়, ফলে এর ওপর শাস্তির আদেশ অবধারিত হয়, আমি তা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করি।” (বনি ইসরাঈল:১৬)
অর্থাৎ আমরা এখান থেকে বুঝতে পারি আল্লাহ ইচ্ছে করলেই আমাদের অপরাধের জন্য শাস্তি দিয়ে ধংস করে দিতে পারেন। কিন্তু তিনি তা না করে আমাদের সংশোধন সুযোগ করে দেন৷ সবশেষে তিনি শাস্তি নির্ধারণ করে থাকেন৷
অপরাধ থেকে মানুষকে ফেরাতে হলে আল্লাহ প্রতি দৃঢ় ইমান অর্জনের সুযোগ করে দিতে হবে৷ তাই কারাগার বন্দিদের আল্লাহর ভয় ও বানী শোনার ব্যবস্থা করা উচিত। বিশেষ আলেম ও শিক্ষকের ব্যবস্থার করাও অতিপ্রয়োজন। রাসূল (সা.) এর যুগে ও ইসলামি শাসনামলে এর বিস্তর নজির আমরা ইতিহাস পর্যালোচনা করলেই দেখতে পবো৷
মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, “মুমিন পুরুষ ও নারী যে সৎকর্ম করবে আমি তাকে উত্তম জীবন দেব এবং তাদের কৃতকর্মের চেয়েও সর্বোত্তম বিনিময় দেব।” (সুরা নাহলঃ ৯৭)
তাই কারাগারে বিভিন্ন রকমের সৎকর্মের ব্যবস্থা করা উচিত। তাহলে অপরাধীদের মাঝে আল্লাহর জন্য ইমান ও আখলাকের অনেক উন্নতি লাভ করবে।
জ্ঞানার্জন ইসলামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকের একটি। জ্ঞান মানুষকে আলোরদিশা পেতে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করে। রাসূলুল্লাহ (সা.)সব সময় সাহাবাদের ইলম অর্জনের প্রতি বেশি উৎসাহ প্রদান করেছেন। প্রত্যেক মুসলিমের উপর মহান আল্লাহ তায়ালা জ্ঞান অর্জন করা ফরজ করে দিয়েছেন।
কারাগারের বেশির ভাগ বন্দিরা ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞতায় থাকার কারণেই বিভিন্ন অপরাধে সম্পৃক্ত হয়ে পরে। তাই কারাবন্দীদের সংশোধনের জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা করা অতি আবশ্যক। ইসলামে কারাগারের ইতিহাস এ প্রত্যেক খুলাফায়ে রাশেদা ও পরবর্তী যুগের প্রায় সকল খলিফারা প্রত্যেক কারাগারের বন্দিদের ইলম শেখার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন৷
আল্লাহর নবী ইউসুফ (আ.) কারাবন্দি থাকার ঘটনা হয়তো আমরা সকলেই জানি। তিনি কারাগারে বসেও আল্লাহর বানী প্রচার করেছিলেন।
আল্লাহ তাআলা ইউসুফ (আ.)-এর কথা বর্ণনা করে বলেন, “হে আমার কারাসঙ্গীদ্বয়, ভিন্ন ভিন্ন বহু প্রতিপালক উত্তম, নাকি পরাক্রমশালী এক আল্লাহ? তোমরা তাঁকে ছেড়ে শুধু কিছু নামের ইবাদত করছ, যা তোমাদের পূর্বপুরুষ ও তোমরা রেখেছ, এগুলোর কোনো প্রমাণ আল্লাহ অবতীর্ণ করেননি, বিধান দেওয়ার অধিকার শুধু আল্লাহর, তিনি আদেশ করেছেন একমাত্র তাঁরই ইবাদত করতে, এটাই শাশ্বত দ্বীন, কিন্তু বেশির ভাগ মানুষ তা অবগত নয়।” (সুরা ইউসুফ: ৩৯-৪০)
হযরত ইউসূফ (আ.) কে যেই কারাগারে বন্দি করা হয়েছিল। প্রাচীন মিশরে সেটি ছিল অন্যতম ভয়ংকর একটি কারাগার। মারাক্তক ও ভয়ংকর সব অপরাধীদের সেখানে বন্দি করে রাখা হয়েছিল। তবে কিছু নিরপরাধ ব্যক্তিরাও সেখানে বন্দি ছিল৷
কিন্তু কারাগারে ইউসুফ (আ.)-এর আদর্শ প্রত্যেক অপরাধীকে নতুন জীবনে ফিরে পেতে সাহায্য করেছিল। করাগারে বসেই তিনি যখন তাদের আল্লাহর পথে দাওয়াত দিতে লাগলো, তখন তারা আল্লাহর বানী শুনে প্রশান্তি লাভ করতো। অবশেষে তারাই হযরত ইউসূফ (আ.) এর সবচেয়ে বিশ্বস্থ ও মিশরের সবচেয়ে আদর্শ মানুষে পরিনত হয়েছিল।
সুতরাং কারাগার শুধু অপরাধীদের বন্দিরে রাখা বা শাস্তি দেওয়ার জায়গা নয়। এটি একটি সংশোধনের উত্তম মাধ্যমও বটে৷ ইসলামে কারাগারের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা সবাই কারাগার কেমন হওয়া উচিত তার একটি বাস্তব প্রমান দেখতে পাবো৷ যেখানে অগনিত অপরাধীরা সত্যের দিশা পেয়ে আদর্শ মানুষে পরিনত হয়েছিল।
কিন্তু দুর্ভাগ্য বসত আমরা ইসলামে কারাগারের ইতিহাস এর নিয়মরীতি ভুলে গেছি৷ তাই আমাদের সমাজে বর্তমানে যে প্রক্রিয়ায় কারাগার পরিচালনা করা হয়। সেখানে চোর হিসেবে যে কারাগারে প্রেরন হয়। পরবর্তীতে সে তার চেয়ে বড় অপরাধে জড়িয়ে পরে। যার বাস্তবতা আমরা হয়তো সকলেই প্রতক্ষ্য করছি।
মহান আল্লাহ আমাদের ইসলামের সহিহ বুঝ দান করুক৷ জীবনের সকল ক্ষেত্রে ইসলামের সঠিক ব্যবহার ও নিয়মরীতি বাস্তবায়নে সক্ষমতা দান করুক। আমিন।
ছবিঃ সংগৃহীত
[তথ্যসুত্রঃ পবিত্র কোরআন, সহিহ হাদিস এবং ইসলামি ইতিহাস ]
মন্তব্য লিখুন