সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড বাংলাদেশের বঙ্গোপসাগরের একটি মেরিন সংরক্ষিত এলাকা। এটি প্রতিষ্ঠিত ২৭ অক্টোবর ২০১৪ সালে। আয়তনে এটি প্রায় আর একটি বাংলাদেশর সমান। সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড মানে যার কোনো তল নেই। ১৭৩৮০০ হেক্টর এলাকা নিয়ে এই সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড বরাবর ই এক অজানা রহস্য কৌতূহল প্রিয় মানষের কাছে। এটি প্রশান্ত মহাসাগরের মারিয়ানা টেঞ্চ এর মতোই অতলাস্পর্শী ও নানা রহস্যে পরিপূর্ণ। তাছাড়া এটি বিভিন্ন প্রানীর নিরাপদ আশ্রয়স্থল ও প্রজানন কেন্দ্র।
স্থানীয় জেলেদের ভাষায় এ স্থানকে বলা হয় ‘নাই বাম বা না বাম”। কারণ স্থানীয় জেলেরা সমুদ্রের পানির গভীরতা মাপেন ফুট বা মিটার দিয়ে নয়, মাপেন বাম দিয়ে। বাম মানে বাশঁ দিয়ে পানি গভীরতা মাপা।এখনে জেলেরা কোনো তলদেশ না পাওয়ায় এর এমন নামকরণ করা হয়।
এছাড়া ও কথিত আছে যে,১৮৬৩ সালে গ্যাডফ্লাই নামে ২১২ টন ওজন বিশিষ্ট একটি জাহাজ ভারত থেকে ইংল্যান্ড যাওয়ায় পথে ঝড়ের কবলে পড়ে ডুবে যায়।এরপর ইংল্যান্ডের অনুসন্ধানকারীদল জাহাজ অনুসন্ধানে আসেন এবং সাথে একদল জরিপকারী নিয়ে আসেন। তারা কোনো খোঁজ না পেয়ে এবং কোন তলদেশ না পেয়ে এর নাম দেন সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড।
স্থল যেখানে শেষ ,সমুদ্রে যাত্রা সেখানেই শুরু। সুন্দরবন থেকে ১৮৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই জীববৈচিত্র্যের আঁধার । সুন্দরবনের দুবলার চর থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত বিস্তর্ণ নীল জলরাশির স্থানটির নাম সোযাচ অব নো গ্রাউন্ড। বাংলায় এর অর্থ যার কোনো তল নেই বা অতলস্পর্শী। ১ হাজার ৭৩৮ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুরে রয়ছে তিমি,কচ্ছপ এবং ডলফিনের প্রজাননক্ষেত্র।
এটিকে পৃথিবীর ১১ তম গভীর খাদ বলা হয়। যা সৃষ্টি হয়েছিল ২৫ হাজার বছর আগে। সোয়ায অব নো গ্রাউন্ডকে গঙ্গা খাদ ও বলে। কারণ গঙ্গা ও বক্ষ্মপুত্রের পশ্চিমের অবস্থিত বঙ্গোপসাগরে এটি একটি গভীর খাদের জায়গা।এর গড় গভীরতা ১২০০ মিটার। এই উপত্যাকায় রের্কড পরিমাণ গভীরতা ১৩৪০ মিটার।এখানে অবস্থিত বিশ্বের বৃহত্তম ডুবো গিরিখাত,যা বঙ্গীয় উপ ব-দ্বীপের অংশ।
সমুদ্রবিজ্ঞানীরা মনে করেন যে, সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড হলো সামুদ্রিক অভয়ারণ্য ও প্রজাননক্ষেত্র।যা কিনা বিশাল তিমি, ডলফিন ও কচ্ছপ এর প্রজনন ক্ষেত্র। এটি বঙ্গোপসাগরের অন্যতম একটি মৎস্য ভাণ্ডার। এখানে পাওয়া যায় ডলফিন, বিশাল তিমি, কচ্ছপ, হাঙ্গর, হ্যমারহেড শার্ক এবং বিভিন্ন প্রজাতির মাছসহ বিভিন্ন প্রকার বিরল প্রজাতির কিছু জলজপ্রণী ও উদ্ভিদ। সোয়াচ অফ নো গ্রাউন্ড বিপুল জীববৈচিত্র্যতে সমৃদ্ধ একটি সংরক্ষিত এলাকা।
এই অঞ্চল যেখানে শুরু হয়েছে সেখানে হঠাৎ করেই পানির গভীরতা বেড়ে গেছে।এই অতল পানির গভীরে রয়েছে ডলফিন, ইন্দো-প্যাসিফিক ডলফিন, ইরাবতী ডলফিন, পাখনাহীন ইম্পাইস ডলফিনসহ নানা প্রনীর এক অপার জীববৈচিত্র্য। বিজ্ঞানীদের মতে এটি এমন একটি অভায়ারণ্য যেখানে তিন প্রজাতির স্থান্যপায়ী একসঙ্গে দেখা যায়। সমুদ্রের অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে এই সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড এর পানির গভীরতা অনেক বেশি বলে এটি বিপুল প্রনীর নিরাপদ আশ্রয়। এছাড়া ও এটি অনেক প্রাণীর প্রজাননক্ষেত্র হিসেবে সংরক্ষিত তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ডলফিন, হাঙ্গর,পাপস, তিমি, ইরাবতী ডলফিন, গোলাপি পিঠের কুঁজো ইন্দো প্যাসিফিক ডলফিন, পাখনাহীন ইমপ্লাইস ডলফিন এবং ডলফিন পারপাস ইত্যাদি।
তাছাড়া এটি অনেক বিপুপ্তপ্রায় প্রানীর অভায়ারণ্য এবং আশ্রয়স্থল।মেরিন ভ্যালি বা সাগরতলের গভীর উপত্যকার রং পরিবর্তন হয়ে নীল রং হয়েছে।সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড এক বিশাল জীববৈচিত্র্য এর আঁধার।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সমুদ্রসীমা বিজয়ের ফলে এই বিশাল সাম্রাজ্য এখন বাংলাদেশের। যা বাংলাদেশের ব্লু- ইকোনোমিতে বিশাল ভূমিকা রাখবে।
সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড বিশাল বাস্তুসংস্থানে সমৃদ্ধ। সোয়াচ বিশ্বের অন্যান্য এলাকার চেয়ে জিওলজিকালি, ইকোলজিকালি, হাইড্রলজিকালি এবং আন্তর্জাতিক বায়োডাইভারসিটির হটস্পটেও পরিপূর্ণ। সোয়াচের পানি খুবই স্বচ্ছ ও পরিষ্কার। এই অঞ্চলের পানি ভারত, শ্রীলঙ্কা, মায়ানমার এবং মালদ্বীপের পানির চেয়ে গুণগতমানে অনেক বেশি উন্নত। তাই এই অঞ্চলটি ইকোকজিকাল ফিল্টার হিসেবেও কাজ করে।
১৯১৪ সালের ২৭ অক্টোবর মেরিন এই সোয়াচকে সংরক্ষতি হিসেবে ঘোষণা করা হয়।তখন প্রাথমিকভাবে এখানে ডলফিন,তিমি এবং হাঙ্গর দেখে এটি ঘোষণা করা হয়েছিল।
এছাড়াও পানির নিচের জীববৈচিত্র্য হিসেবে সাপ, সি- উড, শামুক, ঝিনুকসহ আরও নানা প্রকার প্রানী ও প্রবাল রয়েছে।
ডুবুরিরা পানির নিচের অনেক ছবি ধারণ করেছেন।এবংএতে জেলি ফিস, সুইমিং ক্র্যাবসহ নানা উদ্ভিদ এর ছবি ধারণ করা হয়েছে।এছাড়াও সোযাচের পানির নিচের ভিজিবিলিটি ও খুব স্বচ্ছ।
সোয়াচের অনেক অজানা তথ্য রয়েছে যা এখনও রহস্য ও অজানা। কিন্তু এখন বিভিন্ন সংস্থা ও সরকারী প্রতিষ্ঠান তাদের অনুসন্ধান ও গবেষণা কাজ পরিচালনা করছে।
ইসাবেলা ফাউন্ডেশন নামে একটি জরীপসংস্থা ও মেরিন জাহাজের যৌথ উদ্যোগে একটি অনুসন্ধান কাজ পরিচলিত হয়েছে। সোয়াচের আরও অজানা তথ্য জানতে অভিযান চালানোর পরিকল্পনা করা আছে ইসবেলা ফাউন্ডেশনের। ধীরে ধীরে আমরা এর অপার জীববৈচিত্র্য ও প্রাণভান্ডার সম্পর্কে অবহিত হচ্ছি।
এছাড়াও এটি প্রস্তাবিত ব্লু-ইকোনোমিতে বিশাল ভূমিকা রাখবে।তাই এখানে এমনভাবে গবেষণা করতে হবে যেন কোনো প্রানীর আশ্রয়স্থল ক্ষতিগ্রস্থ না হয় এবংএর জীববৈচিত্র্যের কোনো পরিবর্তন না হয়। তাহলেই এটি হয়ে উঠবে এর প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধশালী ও বিভিন্ন প্রানীর নিরাপদ অভায়ারণ্য।
ছবিঃ সংগৃহীত
তথ্যসূত্রঃ উইকিপিডিয়া ও অনলাইন মিডিয়া
মন্তব্য লিখুন