মানবজীবনের অবশ্যম্ভাবী বাস্তবতার নাম মৃত্যু। যার জন্ম হয়েছে তার মৃত্যু অবধারিত। মৃত্যুকে এড়ানোর কোনো উপায় মানুষের এখনো জানা নেই। পৃথিবীর রণে-বনে, জলে-জঙ্গলে মানুষের আধিপত্য বিরাজ করলেও, বিশাল এই পৃথিবীর সব মানুষের আচার-আচরণ, প্রথা-বিশ্বাস কিন্তু এক নয়।
ধর্মীয় বিশ্বাসের বিভিন্নতা যেমন মানুষের দৈনন্দিন আচার-অনুষ্ঠানে ভিন্নতা এনেছে তেমনি স্থান এবং সংস্কৃতির পার্থক্যের জন্যেও সামাজিক রীতি-নীতিতে ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। অন্যান্য প্রাণী তাদের স্বজাতির মৃত্যুর পরে তেমন বিশেষ কোনো নিয়ম পালন না করলেও মানুষেরা করে থাকেন। এসব রীতি আর আচারে বিধিবদ্ধ আনুষ্ঠানিকতা থাকে।
বিভিন্ন দেশ এবং ধর্মীয় বিশ্বাসের পার্থক্যের কারণে সৎকারের আচারে ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। বাংলাদেশের মানুষেরা সৎকার বলতে সাধারণত কবর দেওয়া এবং দাহ করাকেই বুঝে থাকেন। কিন্তু পৃথিবীতে মৃতদেহ সৎকার এবং এরসাথে সংশ্লিষ্ট এমন কিছু আচার-অনুষ্ঠান রয়েছে যা আপাত দৃষ্টিতে আমাদের কাছে অদ্ভুত মনে হবে। চলুন- সেসবের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি সম্পর্কে জানা যাক:
আর্টিকেলে যা থাকছেঃ
শুনতে গা-ঘিনঘিনে এবং অস্বাভাবিক মনে হলেও পৃথিবীতে মৃতদেহ সৎকার এর এমন আচারও রয়েছে যেখানে মৃতদেহকে স্বজাতির লোকেরা স্যুপ আকারে পান করে থাকেন। এই অদ্ভুতুড়ে সৎকারের প্রচলন রয়েছে ভেনেজুয়েলার ঘন বনাঞ্চলে বাস করা ইয়ানোমামি গোত্রের লোকেদের মধ্যে।
এখানে কেউ মারা গেলে তার দেহটিকে গ্রাম থেকে বেশ দূরের কোনো জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে নিয়ে দেহটিকে প্রথমে চিতায় পোড়ানো হয়। এরপর মৃতের হাড়-ছাইগুলো একত্রিত করে গ্রামে নিয়ে আসেন তারা। এরপরই শুরু হয় মৃতদেহ সৎকারের এই অদ্ভুত আনুষ্ঠানিকতা। প্রথমে একে একে সংগ্রহ করে আনা মৃতের হাড়গুলো চূর্ণ করা হয়। এরপর একটি পাত্রে কলা নিয়ে তা সিদ্ধ করা হয়। সিদ্ধ করা কলার মাঝেই এরপর মিশিয়ে দেয়া হয় সেই হাড়চূর্ণ ও ছাই। মৃতের আত্মীয়েরা এরপর বিশেষ এক ধরনের পাত্রে করে হাড়চূর্ণের স্যুপ পান করেন। এই আচারকে তারা মৃতের প্রতি তাদের ভালোবাসা প্রকাশের উপায় হিসেবে দেখেন।
ছবিঃ মৃতদেহের হাঁড়চূর্ণের স্যুপ পান করছে ভেনিজুয়েলার ইয়ানোমামি গোত্রের লোক
অবিবাহিত ছেলের অকাল মৃত্যুর ঘটনা আমাদের সমাজেও একটু বেশি শোকের। কিন্তু চীনের শাৎসি গ্রামবাসীরা শোক করেই এবিষয়ের ইতি টানেন না। তাদের বিশ্বাস, যে বাড়ির ছেলে অবিবাহিত অবস্থায় মারা গেছে সে বাড়ি অভিশপ্ত বাড়িতে পরিণত হয়।
এ বাড়িতে মঙ্গলজনক কিছু হয় না এবং এভাবে মারা গেলে মৃতের আত্মাও কোনো শান্তি পায় না। তাদের ধারণা এই ছেলের বিয়ে না হলে এই পরিবারেও কোনো শান্তি আসবে না। তাই মৃত ছেলের বিয়ে দিতে তখন তৎপর হয়ে ওঠে পরিবার। মৃত ছেলেকে নিশ্চই কোনো জীবিত মেয়ে বিয়ে করবে না। তাই খোঁজ করা হয় সেই মেয়ের যে অবিবাহিত থেকেই মারা গেছেন।
এই গ্রামের বেশিরভাগ লোকজন খনিতে কাজ করেন বিধায় অল্প বয়সে মারা যাওয়াটা স্বাভাবিক। তবে অনেক সময় মৃত ছেলের জন্য মৃত অবিবাহিত পাত্রী পাওয়া কঠিন হয়ে যায়। তাৎক্ষণিকভাবে না পেলে মৃত ছেলেকে সমাধিস্থ করা হয়। তবে পরবর্তীতে যখনই পাত্রীর খোঁজ পাওয়া যায় তখনই কবর থেকে মৃতদেহ তুলে মহাসমারোহে তাদের বিয়ে দেয়া হয়।
ছবিঃ মৃতদেহকে এভাবে অনেকদিন সাথে রেখে দেয় ইন্দোনেশিয়ার সুলাওয়েসি দ্বীপের টোরাজা উপজাতির লোকেরা।
শুনতে অন্য রকম মনে হলেও এটাই সত্য যে, আমরা মৃতদেহের যতো দ্রুত সৎকার করা যায় সেই প্রচেষ্টা করে থাকি। আমরা মৃতের দেহকে বাড়িতে বেশি সময় রাখতে চাই না। তাই কেউ বছরের পর বছর মৃতদেহ নিয়ে বসবাস করছে এটা আমাদের কাছে একটি অদ্ভুত বিষয়ই। কিন্তু ইন্দোনেশিয়ার সুলাওয়েসি দ্বীপের টোরাজা উপজাতির মানুষের কাছে এটাই স্বাভাবিক ঘটনা।
প্রিয় মানুষটাকে মৃত্যুর পরও তাদের ছাড়তে ইচ্ছে হয় না। তারা মৃতদেহকে সৎকার না করে বাড়িতেই রেখে দেয় বছরের পর বছর। মৃতদেহ রাখার জন্য তারা আলাদা ঘরের ব্যবস্থা করেন। সেই ঘরে থাকে জীবিত মানুষের মতোনই প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র, বিছানা, জামা-কাপড়। শুধু তাই নয়, প্রতিদিন সেই ঘরে খাবারও দেওয়া হয়।
এইভাবে ততোদিন চলতে থাকে, যতো দিন না তার শ্রাদ্ধ শান্তির জন্য জমকালো অনুষ্ঠান করার মতো অর্থ জোগাড় করা যায়। এরপর বিদায়ের দিন মহাআয়োজন করা হয়। বলি দেওয়া হয় মহিষ। তাদের বিশ্বাস মহিষ মৃত ব্যক্তির আত্মা স্বর্গে পৌঁছে দেবে। এখানেই কিন্তু শেষ নয়।
এস্থানে প্রতিবছর মানেনে নামক এক বিশেষ উৎসবের আয়োজন করা হয়। এই উৎসবে মৃতদেহগুলোকে কফিন থেকে বের করে, নতুন জামা-কাপড় পরিয়ে সাজিয়ে ঘোরানো হয় পুরো গ্রাম। মৃত্যু-পরবর্তী এই ঘোরাঘুরি থেকে বাদ যায় না শিশু থেকে শুরু করে অনেক বছরের পুরনো মৃতদেহগুলোও।
মৃতদেহ সৎকার এর জঘন্য আর নৃশংস এক প্রথা ছিলো ভাইকিংদের মধ্যে। ভাইকিং হলো স্ক্যান্ডিনেভীয় সমুদ্রচারী, যোদ্ধা ও জলদস্যুদের একটি দল। ভারতবর্ষে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ভিতর প্রচলিত সতীদাহ প্রথার সাথে এর আংশিক মিল রয়েছে। তবে তুলনামূলক বিবেচনায় এটা আরো বেশি নির্মম।
ভাইকিংদের কোনো গোষ্ঠীপতি মারা গেলে প্রথম পর্বে তার মৃতদেহটি দশদিনের জন্য এক অস্থায়ী কবরে রাখা হতো। এটা খুবই স্বাভাবিক সৎকারের প্রথা। কিন্তু নিষ্ঠুরতার পর্বটি রয়েছে এর দ্বিতীয় অংশে। এই দশদিনের মাঝে সেই মৃতের জন্য নতুন কাপড় বানানো হতো। একইসাথে কোনো ক্রীতদাসীকে তার সাথে যোগ দেয়ার জন্য প্রস্তুত করার আনুষ্ঠানিকতা চলতো। তারা এই মৃতগোষ্ঠীপতির মৃত্যু-পরবর্তী জীবনকেও আরো সুখময় এবং বিলাসবহুল করে তোলার নানা আয়োজনের সাথে কোনো মেয়েও তার সাথে দিতে চাইতো।
এজন্য তারা একজন ক্রীতদাসীকে নির্বাচন করতেন। এই ক’দিন তাকে রাত-দিন পাহারার মাঝে রাখা হতো এবং প্রচুর পরিমাণে উত্তেজক পানীয় পান করানো হতো। এরপর যখন সৎকারের দ্বিতীয় ধাপের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হতো, তখন দুর্ভাগা সেই মেয়েটিকে একের পর এক গ্রামের সব তাবুতেই যেতে বাধ্য করা হতো।
সেসব তাবুর পুরুষেরা তার সাথে দৈহিক সম্পর্কে মিলিত হতো আর বলতো, “তোমার মনিবকে বলো যে, এটা তার প্রতি আমার ভালোবাসা থেকেই করলাম”! সবগুলো তাবু ঘোরা শেষে মেয়েটিকে নিয়ে যাওয়া হতো আরেকটি তাবুতে যেখানে তার জন্য অপেক্ষা করতো ছয়জন ভাইকিং পুরুষ।
তারাও তার সাথে দৈহিক মিলন সম্পন্ন করতো। এরপরই তারা দড়ি দিয়ে শ্বাসরুদ্ধ করে দুর্ভাগা সেই মেয়েটিকে মেরে ফেলতো। মৃত্যু নিশ্চিত করতে সেই গোত্রেরই মহিলা প্রধান তাকে ছুরি দিয়েও আঘাত করতেন। এরপর সেই দুর্ভাগা মেয়েটি আর তার মনিবের মৃতদেহ একটি কাঠের নৌকায় তুলে আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হতো। এটি করা হতো যাতে পরকালে গিয়ে মনিব একা না হয়ে যায়। মেয়েটিও সাথে গিয়ে যাতে করে তার মনিবের ঠিকঠাক সেবা-যত্ন করতে পারেন এই বিশ্বাস থেকে।
ছবিঃ ভাইকিং গোষ্ঠীপতির শেষকৃত্য
নামের মতোন এই মৃতদেহ সৎকার পদ্ধতিও আরেকটি অদ্ভুত আচার। সৎকারের এই পদ্ধতি তিব্বতিদের মধ্যে প্রচলিত। মৃতদেহ সৎকারের এই আকাশ সৎকার পদ্ধতিটি শুরু হয়েছিল দ্বাদশ শতকের কাছাকাছি সময়ে। শেষকৃত্যের এই রীতি তিব্বতিদের একটি ঐতিহ্য যার উদ্ভবের পেছনে বৌদ্ধ ধর্মের একটি মতের প্রভাব রয়েছে।
আত্মা এবং জন্মাতরবাদে বিশ্বাসী এই ধর্মানুসারে মৃতদেহকে খালি জাহাজ মনে করা হয় যা সংরক্ষণের কোনো দরকার নেই। কিন্তু শুধুনাত্র এই বিশ্বাস থেকেই এই অদ্ভুত সৎকার পদ্ধতির সৃষ্টি হয় নাই, রয়েছে অন্য কারণও। যেজন্য তিব্বতের বাইরের বৌদ্ধদের মধ্যে এর প্রচলনও নেই।
মূলত তিব্বতের কঠিন জলবায়ু ও পাথুরে জমিতে মৃতব্যক্তি সমাহিত করা খুবই কষ্টসাধ্য একটি বিষয়। বৌতিব্বতি ভাষায় এ প্রথাটির নাম ‘ঝাটর’, যার অর্থ পাখিদের খাদ্য দেয়া। এ প্রথানুযায়ী কারো মৃত্যু হলে দুই তিনদিন মৃতদেহ ঘরে রেখে দেয়া হয়। এই সময়ে সাধুরা নেচে-গেয়ে মৃত ব্যক্তির আত্মার শান্তি কামনা করেন। এরপর সাদা কাপড়ে মুড়িয়ে মৃতদেহটি পাহাড়ের উপরে দেহ সৎকারের স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়।
বলে রাখি, তিব্বতে রয়েছে অসংখ্য মালভূমি। এই মালভূমির গড় উচ্চতা ১৬,০০০ ফুট। তাই এ অঞ্চলকে পৃথিবীর ছাদও বলা হয়। তো সেই নির্ধারিত স্থানে মৃতদেহ নিয়ে যাবার পর সাথে থাকা সাধুরা কাপড় সরিয়ে কুড়াল দিয়ে দেহটিকে টুকরো টুকরো করে ফেলেন। কেউ কেউ অবশ্য অক্ষত মৃতদেহও রেখে আসেন।
এই মৃতদের দান করা হয় শকুনের মতো মাংসাশী শিকারী পাখিদের। শকুনেরা শুধু মাংস খেয়েই চলে যায়। এতেই এই সৎকার শেষ হয়ে যায় না। তারপর মৃতের হাড়গুলোকে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে গুড়া করে ময়দার সাথে মিশিয়ে ছোট পাখিদের খাওয়ানো হয়। আকাশ থেকে উড়ে আসা পাখিদের সাহায্যে এই সৎকারের কাজ করা হয় বলে একে আকাশ সৎকার বলা হয়।
ছবিঃ পাখিদের খাদ্য হিসেবে মৃতদেহ প্রদান করেন তিব্বতিরা।
মৃতদেহকে নদীতে ভাসিয়ে দেবার রীতি আমাদের এখানেও ছিলো। সাধারণত সাপের কামড়ে মৃত্যুবরণকারীদের ক্ষেত্রে কিছু অঞ্চলে এই পদ্ধতি অনুসরণ করা হতো। তবে যুদ্ধবিগ্রহ কিংবা প্রাকৃতিক কারণে যারা সমুদ্রের বুকে মৃত্যুবরণ করেন, তাদের মৃতদেহ সমুদ্রে ভাসিয়ে দেওয়াটা একটি সাধারণ ঘটনা এবং তা করাও হতো।
তবে স্থলভূমিতে মারা গিয়েও প্রবালের মাঝে নিজেকে মিশিয়ে সমুদ্রের তলদেশে চিরনিদ্রায় শায়িত হতে চাওয়ার বিচিত্র এ শখের জন্ম গত শতকের শেষদিকে। সমুদ্র সৎকারের প্রথম ধাপে মৃত ব্যক্তিকে দাহ করা হয়। তারপর থেকে যাওয়া ছাইকে কনক্রিটের সঙ্গে মিশিয়ে প্রবালের বল বানানো হয়। এরপর সেই বলকে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ দিকে সমুদ্র উপকূলের নির্দিষ্ট জায়গায় মৃত ব্যক্তি বা তার প্রিয়জনদের পছন্দের জায়গায় চিরদিনের জন্য ডুবিয়ে দেওয়া হয়।
ছবিঃ সমুদ্র সমাধি
সমাধিস্থ করার এই পদ্ধতি প্রাচীন চীনের কয়েকটি বংশের মধ্যে দেখা যেতো। এই সৎকারে মৃতদেহকে কফিনে রেখে উঁচু পাহাড়ের গায়ে অবস্থিত শিলার উপর ঝুলিয়ে রেখে দেওয়া হতো। তারা মনে করতেন মৃতদেহ আকাশের কাছাকাছি রাখা উচিত যাতে করে তা বন্যপ্রাণীদের নাগালের বাইরে এবং সৃষ্টিকর্তার কাছাকাছি থাকতে পারেন।
মানুষের এতো সব অদ্ভুত ইচ্ছে রয়েছে যে মৃত্যুতেও তার সব ইচ্ছের ইতি টানতে পারে না। মৃতদেহ নিয়ে কী করা হবে তাও অনেকে বলে যায়। সমুদ্র-সৎকারের মতো কেউ কেউ আতশবাজিকে এতটাই পছন্দ করেন যে, এতেই তার শেষ দেখতে চান। এক্ষেত্রে মৃতদেহের কিছু অংশকে প্রথমে আতশবাজির দাহ্য পদার্থগুলোর সাথে মিশিয়ে তারপর বাজি ফাটানো হয়। ধারণা করা হয়, আকাশে বিস্ফোরিত হয়ে মৃতের আত্মা আকাশে-বাতাসে ভেসে বেড়াবে।
সাধারণত মৃত্যু মানসিক বেদনার কারণ। প্রিয়জন হারানোর শোকে মানসিকভাবে আমরা ভেঙে পড়ি। তবে পাপুয়া নিউগিনির ‘দানি’ উপজাতির মহিলাদের কাছে পরিবারের কারো মৃত্যু শুধু মানসিক যন্ত্রণার নয়, শারীরিক যন্ত্রণারও বটে। পরিবারের কেউ মারা গেলে শোকের তীব্রতা বোঝাতে তারা শারীরিক বেদনাকেও বরণ করে নেন। শোকের প্রকাশ হিসেবে মহিলারা স্বেচ্ছায় আঙুল কেটে ফেলেন। এরপর কাঁদা ও ছাই মুখে মেখে মৃতব্যক্তির জন্য শোক পালন করেন। মনে করা হয়, যে যতো বেশি আঙুল কাটেন তার শোকও ততো গভীর। এই জন্য কে কয়টি আঙুল কাটবে তার নির্দিষ্ট কোনো সংখ্যা নেই। আঙুলগুলোকে কাটার আগে অসাড় করার জন্য শক্ত দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা হয় অনেকক্ষণ। কাটা হয়ে গেলে আঙুলের অংশগুলোকে পুড়িয়ে ফেলা হয়।
ছবিঃ দানি উপজাতির আঙুলকেটে শোকপ্রকাশ
মাদাগাস্কারের ‘মালাগাসী’ জাতির মধ্যে এটি একটি প্রাচীন ঐতিহ্য। প্রতি পাঁচ থেকে সাত বছর পরপর এটি পালন করা হয়। মালাগাসীরা তাদের আত্মীয়ের মৃতদেহকে তুলে নতুন কাপড় পরিয়ে সমাধিস্থলের কাছাকাছি সংগীত সহযোগে নাচ করে থাকেন। পারিবারিক ভোজে মৃতদেহকে বসিয়ে রাখা হয়। মালাগাসী জাতি মনে করেন এইভাবে মৃতব্যক্তি পারিবারিক পুর্নমিলন উৎসবে যোগ দিতে পারছেন। এই অনুষ্ঠান ‘হাড়ের বাঁক’ বা ‘মৃতের সঙ্গে নাচ’ এই নামেও পরিচিত।
অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীরা মৃতদেহ সৎকারের বেলায় প্রচলিত প্রায় সব বিষয়ই সম্পন্ন করেন। কবর দেয়া, আগুনে পোড়ানো, মমিতে পরিণত করা, এমনকি মৃতদেহ খেয়ে ফেলার প্রথাও আছে তাদের মাঝে। তবে দেশটির উত্তরাঞ্চলে আদিবাসী আছে যারা সৎকারের বেলায় অন্যদের চেয়ে আলাদা। তারা প্রথমে মৃতদেহটিকে কোনো উঁচু খোলা জায়গায় রেখে আসেন।
মৃতদেহটিকে গাছের শাখা-প্রশাখা দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। দেহটির সব মাংস পচে গেলে কয়েক মাস পর তারা সেখানে গিয়ে হাড়গুলো নিয়ে আসেন এবং সেগুলোকে লাল রঙ দিয়ে সাজান। তারপর সেই লালরঙা হাড়গুলো কোনো গুহায় কিংবা গাছের ফাঁপা গুঁড়িতে রেখে আসা হয়। আবার অনেক সময় মৃতের আত্মীয়রা সেই হাড়গুলো প্রায় এক বছর সময় ধরে নিজেদের সাথেই নিয়ে ঘুরে বেড়ান। কখনো হাতছাড়া করতে চান না।
ছবিঃ সৎকার অনুষ্ঠানে অস্ট্রেলিয়ার উপজাতি সম্প্রদায়
কেউ মৃত্যু বরণ করলে আমরা যতোদ্রুত সম্ভব তার সৎকার সম্পন্ন করি। হয়তো কবরস্থানে কবর দেওয়া হয় বা শ্মশানে নিয়ে গিয়ে ভস্ম করা হয়। বাড়িতে ফিরে আমরা তার অনুপস্থিতি অনুভব করি। দীর্ঘদিন যাবৎ আমাদের বিভিন্ন আলাপে সেই মৃতের স্মৃতিচারণ চলে। কিন্তু ফিলিপাইনের ইফুগাও অঞ্চলের মানুষেরা ভুলেও এসবের ধার ধারেন না। কেউ মারা গেলেও তাকে তারা বাড়ির বাইরে রেখে আসায় বিশ্বাসী নয়।
বরং কেউ মারা গেলে তারা মৃতদেহটিকে তার বাড়ির সামনে সুন্দর করে চেয়ারে বসিয়ে রাখেন। হাত-পা-মাথা এমনভাবে বেঁধে রাখা হয় যাতে সদ্য মৃত সেই ব্যক্তি পড়ে না যান। ঠিক যেনো বাড়ির উঠোনে লোকেরা কাজ করছে, আর চেয়ারে বসে থেকে কেউ সেই কাজগুলোর তদারক করছে। এভাবে দেহটি রেখে দেয়া হয় আট দিন পর্যন্ত। এই আট দিনে তার আত্মীয়-স্বজনেরা মৃতদেহকে ঘিরে নানা আচার-অনুষ্ঠান পালন করেন। শোক প্রকাশ, হাসি-ঠাট্টা, পার্টি, অ্যালকোহল পানে মেতে ওঠা হয় মৃতদেহটিকে পাশে বসিয়েই।
ছবিঃ বাড়ির সামনে বসিয়ে রাখা ইফুগাও অঞ্চলের একটি মৃতদেহ
References:
মন্তব্য লিখুন