স্লিপ সাইকেল আমাদের ঘুমে একটি পর্যায়বৃত্ত ধর্ম। এই প্রক্রিয়াকে কেন্দ্র করেই আমরা আমাদের রাতের ঘুমের চক্র শেষ করি। বিজ্ঞানীরা মনে করতেন যে মানুষ ঘুমের সময় শারীরিক এবং মানসিক ভাবে নিস্ক্রিয় থাকে। দেহে তেমন কোন জৈবিক কার্যক্রম সংগঠিত হয় না।
কিন্তু পরবর্তীতে গবেষণায় দেখা যায় যে আমাদের শারীরিক কার্যক্রম পর্যায়ক্রমিক ভাবে পরিবর্তিত হতে থাকে। ঘুমের মধ্যেও আমাদের মস্তিস্ক এবং শরীর গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে থাকে যা আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপরকারি।
পুরো সাইকেলে আমাদের বুজে থাকা চোখের নড়াচড়া, স্বপ্ন দেখা, শ্বাস নেয়া, শরীরের তাপমাত্রার পরিবর্তন ইত্যাদি নানান কার্যকালাপ সংগঠিত হয়।
আর্টিকেলে যা থাকছেঃ
Sleep Cycle বা স্লিপ সাইকেল হল আমাদের ঘুমানোর সময় শারীরিক এবং মানসিক পরিবর্তন যা পর্যায়ক্রমিক ভাবে সংগঠিত হয়। ঘুমানোর সময় আমাদের শরীর সম্পূর্ণরূপে মন্থন হয়ে যায় না। বরং পর্যায় ক্রমে কিছু শারীরিক এবং মানসিক পরিবর্তন দেখা যায়। একেই স্লিপ সাইকেল বলে। স্লিপ সাইকেল কে দুই ভাগে ভাগ করা হয়।
(১) NON-REM পর্যায় ( Non Rapid Eye Movement)
(২) REM পর্যায় ( Rapid Eye Movement)
REM এর পূর্ণরূপ হল Rapid Eye Movement । নন আরইএম বলতে বুঝায় এই পর্যায়ে বন্ধ থাকা চোখের কোন র্যাপিড নড়াচড়া হয় না। এটাই আমাদের স্লিপ সাইকেল এর ঘুমানোর প্রথম এবং দীর্ঘতম পর্যায়। এই স্টেজ কে আবার তিন ভাগে ভাগ করা হয়, যথা N1, N2 এবং N3।
এন ওয়ান স্টেজ থেকে পর্যায়ক্রমে আস্তে আস্তে এন থ্রি স্টেজ পর্যন্ত পৌছায়। এ সময় আপনি আশেপাশের জগত থেকে আস্তে আস্তে বিছিন্ন হতে শুরু করেন। আপনার মস্তিষ্ক এবং শরীর আস্তে আস্তে নিস্তেজ হতে শুরু করে।
ধিরে ধিরে আপনার শ্বাসপ্রশ্বাস, রক্ত চলাচল এবং শরীর মন্থর হতে শুরু করে এবং যতই সময় অতিবাহিত হয় ততোই আপনি গভীর ঘুমে চলে যেতে থাকেন। আপনি পুরো রাতের অর্ধেক সময়ই এন টু পর্যায়ে অতিবাহিত করেন। একবার এই পর্যায়ে চলে গেলে আপনাকে ঘুম থেকে জাগানো কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়।
পূর্বেই বলেছি আরইএম (REM) এর পূর্ণরূপ সম্পর্কে। NON-REM পর্যায়ের পরেই শুরু হয় REM পর্যায়। স্লিপ সাইকেল এর এই পর্যায়ে বন্ধ হয়ে থাকা চোখের অনবরত নড়াচড়া শুরু হয়। চোখ পাতার নিচে এদিক ওদিক ক্রমেই নাড়াচাড়া করতে থাকে। এই সময়ই আপনি মূলত স্বপ্ন দেখতে থাকেন।
তখন আপনার শরীর দিনের মতোই কার্যকরী ও একটিভ হয়ে ওঠে। আপনার হার্ড বিড, বডি টেম্পারেচার, রক্ত চাপ এবং শ্বাসপ্রশ্বাস বেড়ে যেতে থাকে। আমরা হয়তো সবাই প্রতিবর্তি ক্রিয়া বা বডি রিফ্লেক্স অনুভব করেছি।
হটাৎ কোন কিছু হাত থেকে পড়ে গেলে আমাদের শরীর একা একাই সক্রিয় হয়ে ওঠে হাত থেকে পড়ে যাওয়া রোধ করতে। এটা আমাদের ইচ্ছা থাকুক বা না থাকুক আপনা আপনিই ঘটে। আমার যখন স্লিপ সাইকেল এর এই পর্যায়ে আসি তখন স্বপ্ন দেখা শুরু করি।
সাথে সাথে মস্তিষ্ক আমাদের বডি রিফ্লেক্স কে সক্রিয় করে তুলে। ফলে দুঃস্বপ্ন দেখলে আমাদের হাত পা এবং মুখ কথা বলে সাথে সাথে প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে।
স্লিপ সাইকেল পর্যায় আঁকারে পরিবর্তিত হয়। আরইএম (REM) এবং নন আরইএম (NON-REM) সাইকেল পর্যায়ক্রমে পরিবর্তিত হতেই থাকে। একই রাতে নন আরইএম, আরইএম এবং আবার নন আরইএম এরকম করে একই ভাবে তিন থেকে পাঁচ বার পরিবর্তিত হতে পারে।
প্রথম আরইএম পর্যায় সাইকেলে কয়েক মিনিট স্থায়ী হতে পারে। মানে দাঁড়ায় আমাদের প্রথম সাইকেলে স্বপ্ন দেখা কয়েক মিনিট স্থায়ী হয়। স্বপ্ন দেখার সময় আমাদের মস্তিষ্ক খুবই কার্যকর থাকে।
এতটাই কার্যকর থাকে যে আমরা মাত্র কয়েক মিনিটে অনেক লম্বা ঘটনা ঘটে যেতে দেখতে পারি। স্লিপ সাইকেল এর আরইএম পর্যায় প্রতিটি সাইকেলে আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে। এরকম বাড়তে বাড়তে সর্বোচ্চ আধা ঘণ্টা পর্যন্ত বাড়তে পারে।
অন্য দিকে এন থ্রি স্টেজ প্রতিটি সাইকেলে আস্তে আস্তে কমতে থাকে। এমনকি যদি আরইএম পর্যায় বাঁধা প্রাপ্ত হয় তাহলে এটি পরবর্তী রাতে মেক আপ করে নেয়। কেন এমনটা হয় তা বিজ্ঞানীরা এখনো জানতে পারেন নি।
ঘুমানোর সময় শরীরের তাপমাত্রা হ্রাস পায়। স্বাভাবিক তাপমাত্রা থেকে কয়েক ডিগ্রি পর্যন্ত হ্রাস পেতে পারে। তাবে ঘুম থেকে জেগে ওঠার দুই ঘণ্টা আগে শরীরের তাপমাত্রা সবচেয়ে কম থাকে। র্যাপিড আই মুভমেন্টের সময় একটু ঠাণ্ডা কিংবা গরমের তারতম্যের কারনে সহজেই ঘুম ভেঙে যায়।
যদিও ঠাণ্ডা তাপমাত্রায় ঘুম তুলনামুলুক ভালো হয়। ঘুম থেকে ওঠার পর হাল্কা ব্যয়াম, পুস আপ, ঘুমানোর কারনে কমে যাওয়া তাপমাত্রাকে বাড়াতে সাহায্য করে। তাই ঘুম থেকে ওঠার পর হালকা ব্যয়াম করা উচিত।
ঘুমিয়ে যাওয়ার প্রথম পর্যায়ে আস্তে আস্তে শ্বাসপ্রশ্বাস ধিরে ও মন্থর হতে শুরু করে। এই সময় শ্বাসপ্রশ্বাস আরও পর্যায়বৃত্ত আঁকারে চলতে থাকে। কিন্তু র্যাপিড আই মুভমেন্টে শ্বাসপ্রশ্বাস আরও বাড়তে থাকে এবং পর্যায়বৃও ধর্ম তুলনামূলক কমে যায়। শ্বাসপ্রশ্বাসের মতো রক্তচাপ একই ভাবে পরিবর্তিত হয়।
নন আরইএম পর্যায়ে হৃদস্পন্দন কমে যায় বলে রক্তচাপ কমে যায়। কিন্তু আরইএম পর্যায়ে তা আবার বাড়তে থাকে।
নন আরইএম পর্যায়ে ব্রেন রিলাক্স পর্যায়ে চলে যায়। ব্রেনের সেল গুলো তখন কম অ্যাক্টিভ থাকে। কিন্তু আরইএম পর্যায়ে ব্রেন জেগে থাকার মতোই সক্রিয় হয়ে ওঠে। কারন এই সময় মানুষ স্বপ্ন দেখে তাই ব্রেনের সক্রিয়তা প্রয়োজনীয়। স্বপ্ন দেখার সময় আমরা প্রায় রিয়েল এক্সপ্রেরিয়েন্স পেয়ে থাকি ।
আমাদের আবেগ, হাফভাব এমন হয় যেন সেটা সত্যিই ঘটছে। দুঃস্বপ্ন থেকে জেগে উঠলে এটা আসলেই ঘটেনি বলে আমরা হাফ ছেড়ে বাঁচি। আমরা কেন স্বপ্ন দেখি এবং কোন কাজে লাগে তা এখনো একটা রহস্য।
বিজ্ঞানীরা এখনো এর সুস্পষ্ট কোনো কারন বের করতে পারেন নি। আমরা সাধারনত আরইএম পর্যায়ে স্বপ্ন দেখি। কিন্তু এটা অন্য পর্যায়ে ও ঘটতে পারে। অনেক সময় ঘুমের মধ্যে মানুষ জেগে ওঠে এবং ভয়ে কেঁদে ওঠে। এটা গভীর ঘুমের সময় ঘটে থাকে।
মস্তিষ্কের ব্রেইনস্টেম শরীরের পেশিগুলকে সিগন্যাল পাঠায় যাতে করে গভীর ঘুমে স্বপ্ন দেখার সময় হাত পা পেশী চলাচল না ঘটে। এছাড়া স্লিপ সাইকেল এ বিভিন্ন হরমোন উৎপাদিত হয় যা আমাদের বেড়ে উঠতে সাহায্য করে।
ঘুমানোর সময় পেশী, অরগান এবং বিভিন্ন সেল রিপেয়ার হয়। তাই হাতপা কেটে গেলে বা জ্বর হলে ঘুমের সময় অধিকাংশ সেরে ওঠে। যে কেমিকেল গুলো আমাদের ইমিওন সিস্টেম কে দৃঢ় করতে সাহায্য করে সেগুলো ঘুমের সময় রক্তে প্রবাহিত হওয়া শুরু করে।
ফলে ঘুমের মধ্যেই আমাদের বেশিরভাগ রোগ প্রতিরোধ হয়। তাই জ্বর বা থান্ডা লাগলে পর্যাপ্ত ঘুমান উচিত। এতে করে দেহের ইমিওন সিস্টেম বেশী কার্যকরী হবে।
তুলনামূলক কম বয়স্ক এবং হেলদি মানুষের ঘুম গভীর হয়। কিন্তু বয়স বাড়ার সাথে সাথে মানুষের গভীর ঘুমের হার কমে যেতে থাকে। এটি সাধারণত ৬৫ বছর পর থেকে শুরু হয়। গভীর ঘুমের সময় ব্রেন তার অতিরিক্ত অদরকারি ইনফরমেশন গুলোকে মুছে দেয়।
ফলে ঘুম থেকে ওঠার পর মস্তিষ্ক অনেক কার্যকারী থাকে। দেখা গেছে কম ঘুমানো ব্যক্তির থেকে পর্যাপ্ত ঘুমানো ব্যক্তির ব্রেন আরও দ্রুত কাজ করে। তারা খুব সহজেই জটিল সমাধানে সক্ষম হন।
তাই পরীক্ষার আগের রাতে রাত জেগে পড়াশুনা করা উচিত নয়। এতে মস্তিস্কের কার্যকারিতা কমে যায়। কোন কিছু মনে করতে সময় বেশী লাগে। আমাদেরকে সঠিক নিয়মে সময় মত ঘুমাতে যাওয়া উচিত।
ছবিঃ সংগৃহীত
তথ্যসূত্রঃ onhealth.com
মন্তব্য লিখুন