জন মিলটন এর কথা বললেই আমাদের মনে পরবে “On his blindness” তার বিখ্যাত কবিতার কথা। “একজন মহৎ কবি হবার জন্য অবশ্যই তোমাকে একজন মহৎ মানুষ হতে হবে” সমালোচক টেনির এই উক্তি সম্ভবত একটি মানুষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। তিনি হলেন আমাদের সকলের অতি পরিচিত মুখ ইংল্যান্ডের বিখ্যাত কবি জন মিলটন।
আর্টিকেলে যা থাকছেঃ
৯ই ডিসেম্বর, ১৬০৮ সালে লন্ডনের ব্রন্ড স্ট্রীটেরি একটি বাড়িতে জন্ম গ্রহন করে জন মিলটন। তার বাড়ির পাশেই ছিল গীর্জা। জন্ম থেকে গীর্জার ঘন্টা ধ্বনির ছন্দ শুনতে শুনতে তার মনে জেগে উঠেছিল কবিতার ছন্দ।
জন মিলটনের যখন জন্ম হয়, সমগ্র লন্ডন তখন শেক্সপীয়ারের সৃষ্টির বর্ণচ্ছটায় উজ্জল হয়ে আছে। শোনা যায় জন মিলটন এর সাথে একবার শেক্সপীয়ারের সাক্ষাৎ হয় তখন মিলটন সাত বছরের বালক।পিতা-মাতার ছয় সন্তানের মধ্যে মিলটন ছিলেন তৃতীয়।বাড়ির পরিবেশ ছিল মুক্ত স্বাধীন।
মিলটনের শৈশব কাল আর পাঁচটা সাধারণ ছেলের মতো ছিল না। যেকোনো পাঠের মধ্যে গভীরভাবে ডুব দিয়ে সেখান থেকে কিছু আয়ত্ব করার চেষ্টা করতেন তিনি। তাকে দেখা যেতো গভীর রাত জেগে পড়াশোনা করতে।
অর্থাৎ এক কথায় মিলটন ছিলেন পড়াপাগল ছেলে ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন গম্ভীর প্রকৃতির আর চিন্তাশীল। পড়াশোনার দিকে ছিল তার প্রবল আসক্তি।জন মিলটনের পূর্বপুরুষরা ছিলেন রোমান ক্যাথলিক।
বাবা জন মিলটন সিনিয়র কিন্তু প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মমত গ্রহণ করে পরিবার থেকে আলাদা হয়ে যান।
শৈশব কালে মিলটনকে লন্ডনের বিখ্যাত সেইন্ট পল স্কুলে ভর্তি করা হয়। কিন্তু তার স্কুলের থেকে বাড়ির পরিবেশ ছিল শিক্ষার অনুকুল। জন মিলটন তার স্কুল থেকে গ্রীক ও ল্যাটিন ভাষায় দক্ষতা অর্জন করে।ষোল বছর বয়সে কেম্ব্রিজের ক্রাইস্ট কলেজে ভর্তি হন মিলটন।
সেখানের পরিবেশ ও তার পছন্দ হত না। এক দিন কোনো এক কারনে তার এক শিক্ষক এর সাথে বিতর্কে জরিয়ে পরে এবং তার শিক্ষক এর সাথে হাতাহাতি হয়, এই অভিযোগে তাকে কলেজ থেকে সাময়িক সময়ের জন্য বিতাড়িত করা হয়।
আবার কিছু দিন পর কলেজে ভর্তি হলেন।কলেজের গন্ডি শেষ করার পর ২৪ বছর বয়সে কেম্ব্রিজ ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়। ১৬২৯ সালে কেম্ব্রিজ থেকে স্নাতক লাভ করেন তিনি। সে বছর কেম্ব্রিজের ২৪ জন স্নাতকের মধ্যে তিনি ছিলেন চতুর্থ।
১৬৩২ সালে স্নাতকোত্তর লাভ করার পর মিলটনকে কেম্ব্রিজ ইউনিভার্সিটির ইন্সট্রাক্টর হিসেবে কর্মভার গ্রহণের অনুরোধ জানানো হয়। কিন্তু মিলটন সে প্রস্তাব গ্রহণ না করে হর্টনে পিতার কাছে চলে যান। উদ্দেশ্য ছিল চার্চের পাদ্রী হওয়ার।
এরপর তিনি সাহিত্যের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় এবং সেখান থেকে সাহিত্যের উপর ডিগ্রী লাভ করে এবং আটটি ভাষার উপর দক্ষতা অর্জন করে।
পড়ালেখা শেষে জন মিলটন পুরোপুরি ভাবে সাহিত্য জগতে মননিবেশ করে।এই সময় মিলটন অনেক কবিতা রচনা করেছেন। যৌবনের স্বপ্নীল আবেশে ডুবে দু’চোখ ভরে দেখেছেন লন্ডনের পার্কে নতুন গজিয়ে ওঠা কুঁড়ির মতো তরুণী-তন্বীদের, দেখেছেন নববর্ষের প্রারম্ভে সূর্যালোকে ভরা ফসলকে, দেখেছেন মাটি আর মানুষকে।
সুদর্শন মিলটন চাইলে তরুণীদের সাথে ফুর্তি করে, মদের পেয়ালায় রঙিন ক্ষণগুলোকে আরও রঙিনতর করে উপভোগ করতে পারতেন। কিন্তু তার চরিত্রের মন্দিরে কাম-কলুষতার অপদেবতার কোনো স্থান ছিল না। কাম-প্রবৃত্তিতে সিক্ত মানবজীবন তার কাছে কলুষিত মনে হতো।
তাই তার রচনার মধ্যেও সস্তা প্রেমের অতিরঞ্জিত উচ্ছ্বাসের কোনো স্থান নেই। গুরু-গম্ভীর বিষয় নির্বাচন করে, মানবজীবনের গভীরতর সত্য অন্বেষায় তিনি ব্রতী হয়েছেন। এর পর তিনি আরও সাহিত্য চর্চার জন্য লন্ডন শহর থেকে সতেরো মাইল দূরে হর্টন গ্রামে চলে যায়।
সেখানে তার বাবার একটি বাড়ি ছিল। সেই বাড়িতে তার মা থাকতেন। সেখানে পাঁচ বছর ধরে চলল সাহিত্য, দর্শন, ভাষাতত্ত্ব, সঙ্গীত প্রতিটি বিষয়ের গভীর অধ্যায়ন। মিলটন লিখেছেন, “এই পাঁচ বছর ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে সুখের সময়। বাবার ব্যবসা আমাকে সমস্ত আর্থিক দুঃচিন্তা থেকে মুক্ত রেখেছিল”।
পাঁচ বছরের অজ্ঞাতবাস শেষে তিনি স্থির করলেন মানুষ সমাজে ফিরে আসবে।তখন দেশ ভ্রমণের মধ্যে দিয়ে অর্জিত জ্ঞানকে পরিণত রুপদানের রেওয়াজ ছিল। মিলটনের মনে আকাঙ্খা ছিল স্বপ্নের দেশ রোম পরিভ্রমণের।
১৬৩৭ সালে মায়ের মৃত্যুর পর তার সাংসারিক বন্ধন আরও শিথিল হয়ে এলো। পিতার অনুমতি নিয়ে তাই বেরিয়ে পড়লেন দেশ ভ্রমণে। দেখলেন প্যারিস, জেনোয়া আর ফ্লোরেন্স। বহু খ্যাতনামা কবি ও সাহিত্যিকের সংস্পর্শে তিনি এলেন আর নিত্য নতুন জ্ঞানসুধা পান করতে থাকলেন।
ফ্লোরেন্স থেকে মিলটন গেলেন রোমে। ল্যাটিন ভাষা ভালোভাবেই আয়ত্ব ছিল তার। রোমে প্রবাসী জীবনের বেশিরভাগ সময় তার কাটে ভ্যাটিকান লাইব্রেরিতে বসে। ক্ল্যাসিক প্রীতি তার চেতনার জগৎকে উদ্ভাসিত করে রেখেছিল।
রোমের অতীত সভ্যতা নিয়ে পড়াশোনা করতে গিয়ে আরও বেশি করে ক্ল্যাসিক সাহিত্যের প্রেমে পড়ে যান তিনি। মিলটন দেখা করেন গ্যালিলিওর সাথে। এই মহান বিজ্ঞানী প্রচলিত ধ্যান-ধারণার ঊর্ধ্বে উঠে মানুষকে শুনিয়েছিলেন সত্যের বাণী, আর তাই হয়েছিলেন শাসক শ্রেণীর হাতে কারাবন্দী ও বিচার নামক প্রহসনের শিকার।
Image: John Milton & Galileo, source: Britannica
মিলটনের পরবর্তী জীবনে এই মহতী বিজ্ঞানীর প্রভাব ছিল অপরিসীম। তার বিভিন্ন লেখায় তিনি বারবার গ্যালিলিওর প্রসঙ্গ টেনেছেন। ‘প্যারাডাইস লস্ট’-এ গ্যালিলিওর টেলিস্কোপের উপমা টেনেছেন মিলটন। এর পর ইংল্যান্ড থেকে খবর এল দেশে যুদ্ধের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
তার দেশ ভ্রমন স্থগিত হল। তিনি ইংল্যান্ডে ফিরে এল এবং নিজেকে ঘোষনা করলো এই যুদ্ধের সৈনিক হিসেবে কিন্তু তার অস্ত্র বন্দুক না,কলম। ১৬৪০ থেকে ১৬৬০ সাল পর্যন্ত, ২০ বছর মিলটন সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করে একজন কট্টর বিপ্লবীর ভূমিকা পালন করেন।
তার শক্তিশালী লেখনী এবং ধর্মীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়ে তার মতামত সেদিন বিপ্লবের শক্তি যুগিয়েছিল। বিপ্লবের প্রচন্ডতায় শেষমেষ রাজশক্তি হার মানলো। রাজা চার্লসের জনসমক্ষে শিরচ্ছেদ করা হলো।
১৬৪৯ সালে রাষ্ট্রীয় প্রজাতন্ত্র সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে মিলটন ল্যাটিন সেক্রেটারি হিসেবে নিযুক্ত হলেন।
পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে জন মিলটন বিয়ে করলেন মেরি পাওয়েলকে।তখন মেরির বয়স সতেরো। কিন্তু এই বিয়ে সুখের হয়নি কারন তারা দু’জন সম্পূর্ন ভিন্ন মানসিকতার মানুষ ছিল মেরি মানিয়ে নিতে চাইছিল কিন্তু পারলো না তাই এক সময় তার স্বামীর ঘর ছেড়ে বাবার কাছে চলে গেলো।
এই সময় জন মিলটন লিখলেন তার বিখ্যাত ইস্তাহার “The Doctrine and Discipline of Divorce to the good iof both sex” তার কিছু দিন পর মেরি চলে এল তার কাছে। এরপর তিনি মেয়ে সন্তানের পিতা হয়। কিন্তু সন্তান জন্ম দেওয়ার সময় তার স্ত্রী মেরি মারা যায়।
তখন তার জীবনে নেমে আসে আরও অন্ধকার।আর সে অবস্থায় তার কাজের চাপ আরও বেড়ে যায় এবং চোখের দৃষ্টি শক্তি কমতে থাকে। বিভিন্ন ডাক্তা দেখায় কিন্তু কোনো কাজ হয় না তিনি দৃষ্টি শক্তি হারিয়ে ফেলে।এই বিপর্যয়ের মধ্যেও মানসিক শক্তি হারায় নি মিলটন।
তিনি লিখেছেন “যদি আমার এই ব্যাধি দূরারোগ্য হয় তবে আমি তার সাথে মানিয়ে নিবো।তাছাড়া এর জন্য আমার কোনো দুঃখ নেই। দেশের সেবার জন্যই আমি চোখের আলো হারিয়েছি”।সৃষ্টি দিয়ে ধ্বংসের বুকে মাথা তুলে দাঁড়াবার সাহস তার ছিল।
তাই অন্ধ অবস্থাতেই এক পর্ণকুটিরে বসে রচনা করলেন দুই কালজয়ী মহাকাব্য ‘প্যারাডাইস লস্ট’ আর ‘প্যারাডাইস রিগেইন্ড’। বৃদ্ধ, অন্ধ মিলটন মুখে বলে যেতেন, আর তার হয়ে লিপিবদ্ধ করতো তার কন্যা দিবোরা। তার অপর দুটি কন্যার অসহযোগিতা ও বিরুপ মনোভাব কবিকে ব্যাথিত করেছিল।
১৬৬৩ সালে ‘প্যারাডাইস লস্ট’ সমাপ্ত করলেন তিনি। ১৬৬৭ সালে প্রকাশিত হয়েই ইংল্যান্ড জুড়ে বিপুলভাবে সমাদৃত হলো এই মহাকাব্য আর আদৃত হলেন মিলটন নিজে। মহাকালের বিস্তৃত বক্ষপটে চিরকালের জন্য নিজের নাম লিখে দিলেন মিলটন।
On Shakespeare, On Arriving at the age of Twenty-three, On education, Arcedis, Lycidas, The Tenure of Kings and Magistrate, The Agreement of the People, The Doctrine and Discipline of Divorce, The judgement of Martin Bucer, Concerning divorce
১৬৭৪ সালের ৮ নভেম্বর মৃত্যুঞ্জয়ী কবি জন মিলটন পৃথিবী ছেড়ে চলে যায়। লন্ডনেই তাকে সমাহিত করা হয়। বহু বছর পরে তার স্মৃতি রক্ষার্থে ওয়েস্টমিনিস্টারে একটি স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপিত হয়। তার মৃত্যুতে ইংরেজী সাহিত্য জগতে শোকের ছায়া নেমে আসে।
দীর্ঘ সংগ্রামী জীবনে ভালো-খারাপ দুই রকম সময়ই কাটিয়েছেন জন মিলটন। কিন্তু কখনো সময়ের সাথে আপোষ করেননি। তার জীবন তিনি পুরোটা বেঁচেছেন, অবিকৃত ও দ্বিধাহীনভাবে। তার রচিত মহাকাব্যের প্রতিপাদন করে নিজ জীবনকে এক মহাকাব্যিক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন তিনি।
ছবিঃ সংগৃহীত
তথ্য সূত্রঃ উইকিপিডিয়া ও অনলাইন পোর্টাল
মন্তব্য লিখুন