মানবসভ্যতার ইতিহাসে বিভিন্ন সময় অনেক গুলো বিপর্যয় বা দুর্ঘটনা ঘটে গেছে যা পুরো বিশ্বকে স্তম্ভিত করে দিয়েছে। এই দুর্ঘটনা গুলোর কিছু সংগঠিত হয়েছে প্রাকৃতিক কারণে আবার কিছু সংগঠিত হয়েছে মানুষের ভুলের জন্য বা তাদের হিংসা ও রাজনৈতিক কারণে হয়েছে। এমনই একটি দুর্ঘটনা হলো চেরনোবিল দুর্ঘটনা যা ঘটেছিলো চেরনোবিল পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে, পারমাণবিক বিস্ফোরণের ফলে। পারমাণবিক বিস্ফোরণ সবসময় সাধারণ বিস্ফোরণের চেয়ে বেশি ক্ষতি করে।
এখানেও হয়েছিল যা থমকে দিয়েছিলো প্রায় সম্পুর্ণ সোভিয়েত ইউনিয়নকে। চলুন তাহলে চেরনোবিল পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দুর্ঘটনা সম্পর্কে ও সেই পারমানবিক বিস্ফোরণের ভয়াভহতার কিছু তথ্য জেনে নেওয়া যাক।
২৬শে এপ্রিল ১৯৮৬ সালে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের অধিনস্ত বর্তমান ইউক্রেন শহরের চেরনোবিল পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে সংগঠিত ভয়াবহ পারমাণবিক দুর্ঘটনা টি চেরনোবিল পারমাণবিক বিপর্যয় বা চেরোনোবিল দুর্ঘটনা হিসেবে পরিচিত। এটি মানবসভ্যতার ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহতম পারমাণবিক দুর্ঘটনা।
১৯৭৭ সালে প্রথম চেরনোবিল পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি স্থাপিত হয়। এর চুল্লী সংখ্যা ছিল ৪টি।যদিও চুল্লী ৪ টি একইসাথে স্থাপিত হয়নি। প্রথম চুল্লীটি স্থাপিত হয় ১৯৭৭সালে, দ্বিতীয়টি ১৯৭৮সালে, তৃতীয়টি ১৯৮১ এবং চতুর্থটি ১৯৮৩ সালে। প্রতিটি পারমাণবিক চুল্লীর বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ছিল প্রায় ১০০ মেগাওয়াট।
অবস্থানঃ চেরনোবিল পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির অবস্থান ছিল ইউক্রেন ও বেলারুশ এর সীমান্তশহর পৃপিয়ার্তে।
তারিখঃ ২৬শে এপ্রিল ১৯৮৬। সময়ঃ রাত ০১ঃ২৩ (স্থানীয় সময় অনুযায়ী)
পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাজ হলো সামান্য পরিমাণ তেজস্ক্রিয় পদার্থ ব্যাবহার করে সস্তায় বিপুল পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করা। একাজে চেরনোবিল পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি ইউরেনিয়াম ২৪৫ ব্যাবহার করতো।
তবে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু রাখার জন্য অন্য কোনো উৎস থেকে বিদ্যুৎ সংযোগ দিতে হয়। কিন্তু হঠাৎ করে যদি এই বৈদ্যুতিক সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তাহলে কি ঘটবে, সেরকমই এক নিরাপত্তা জনিত পরীক্ষা চালানোর সময় চেরনোবিল পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ৪র্থ চুল্লীটিতে এই বিপর্যয় ঘটে।
চেরনোবিল দুর্ঘটনার জন্য কারণ হিসেবে কর্মরত কর্মীদের ভুলকেই দায়ী করা হয়। যদিও বিষয়টি এতটাও সহজ নয়, কারণ ১৯৮৬ সালের ২৬ এপ্রিল রাতে যে পরীক্ষাটি করা হচ্ছিলো তা পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের শুরুতেই করা উচিত ছিলো। যা করা হয় নি।
সাধারণত পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নিউক্লিয়ার চুল্লীর তেজস্ক্রিয়তা কমানোর জন্য পানি ব্যবহার করা হয়। এটি একটি কার্যকর ব্যাবস্থা। কিন্তু ১৯৮৬ সালের ২৬শ এপ্রিল রাতে ৪র্থ চুল্লী তে পরীক্ষার সময় কর্মীরা চুল্লীটির টার্বাইনে প্রয়োজনের অধিক শীতল জল প্রবাহিত করে।
এতে করে বাষ্প কম উৎপাদিত হয়, যার ফলে চুল্লী টি ধীরে ধীরে উত্তপ্ত হতে থাকে এবং এক পর্যায়ে প্রচন্ড বিস্ফোরণ ঘটে। পরপর প্রায় একই সঙ্গে দুটি বিস্ফোরণে ৪র্থ চুল্লীটির উপরের প্রায় এক হাজার টন ওজনের কংক্রিটের ছাদটি ভেঙে পরে বলে এক বিরাট ফাঁকা জায়গার সৃষ্টি হয়।
যার ফলে বাইরের বাতাস ভেতরে প্রবেশ করে এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই চুল্লীর দাহ্য পদার্থের সংস্পর্শে এসে অগ্নিকান্ডের সূত্রপাত হয়। এ আগুন ১০ দিন পর্যন্ত স্থায়ী ছিলো। এর ফলে পারমাণবিক বিক্রিয়ায় তৈরি তেজস্ক্রিয় পদার্থ বাতাসে ছড়িয়ে পরে।
১৯৮৬সালে সংগঠিত এই চেরনোবিল পারমাণবিক দুর্ঘটনায় সরাসরি মৃত্যুর সংখ্যা কম হলেও এর সার্বিক ক্ষতির পরিমাণ ছিলো ব্যাপক। দু্র্ঘটনার সাথে সাথে ৪ জন কর্মী সেই স্থানেই মারা যান। এবং ১ম তিন মাসে সরাসরি ৩১ জন মারা যায়, যাদের মধ্যে অধিকাংশই ছিলেন উদ্ধারকর্মী।
১৯৮৬ সালের এই চেরনোবিল দুর্ঘটনায় পরিবেশে যে পরিমাণ তেজস্ক্রিয় পদার্থ নির্গত হয় তা ১৯৪৫ সালে জাপানে নিক্ষিপ্ত পারমাণবিক বোমার চেয়ে প্রায় পাঁচশ গুন বেশি ছিলো।
এই দুর্ঘটনায় উদ্ভুত পারমানবিক পদার্থের মেঘটি ইউক্রেন, বেলোরাশিয়া, রাশিয়া ও পুর্ব ইউরোপের উপর দিয়ে গিয়ে গ্রেট ব্রিটেন এমনকি আমেরিকার আকাশেও ছড়িয়ে পরে। পৃপিয়াত শহরটি একেবারে বিধ্বস্ত হয়ে যায় এই পারমাণবিক বিস্ফোরণের ফলে।
অনেক গবাদিপশু ও বন্য এলাকার ক্ষতি হয় এই দুর্ঘটনার জন্য। সরকারি তথ্য অনুযায়ী এ দুর্ঘটনায় প্রায় ৫০ লক্ষ মানুষ আক্রান্ত হয়, যার মধ্যে প্রায় ৬ লক্ষ শিশু। এ দুর্ঘটনায় ২০০ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ ক্ষতি হয়।
১৯৮৬ সালের ঐ দুর্ঘটনার পরও কয়েক বছর পর্যন্ত পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি চালু ছিলো পরে এক এক করে সবগুলো চুল্লী বন্ধ করে দেওয়া হয়। বর্তমানে চেরনোবিল শহরটি পরিত্যক্ত এবং পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির প্রায় ৫০ মাইল এলাকা জুড়ে কেউ বাস করে না।
পারমাণবিক দূষণ থেকে পরিবেশকে বাঁচাতে কংক্রিটের তৈরি একটি বিশাল খোলসের মধ্যে চেরনোবিল পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ৪র্থ চুল্লীটির সকল ধ্বংসাবশেষ সম্পূর্ণভাবে ঢেকে দেওয়া হয়। তবে বাতাসে যে পরিমাণ তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়েছে তা হাজার বছরেও দূর হবে না।
সভ্যতার ক্রমবিকাশে অনেক নতুন নতুন আবিস্কার মানুষের জীবনকে সহজ ও সুন্দর করে দিয়েছে। কিন্তু এই আবিষ্কার গুলো অনেক কিছু কেড়েও নিয়েছে। এর একটি বাস্তব উদাহরণ হলো চেরনোবিল পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র।
দুর্ঘটনা ঘটতেই পারে তাই বলেতো আর উন্নয়ন থামিয়ে রাখা যাবে না কিন্তু যদি একটু সচেতন থাকা যায় এবং সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় তাহলে এই দুর্ঘটনার সংখ্যা বা ক্ষতির পরিমাণ অনেকটা কমিয়ে ফেলা সম্ভব।
ছবিঃ সংগৃহীত
তথ্য সূত্রঃ উইকিপিডিয়া ও ইউটিউব
মন্তব্য লিখুন