অলিম্পাস মন্স এখন পর্যন্ত আবিষ্কার হওয়া সৌরজগতের সবচেয়ে বৃহৎ আঁকারের আগ্নেয়গিরি। আমাদের পৃথিবীতেই যে শুধু আগ্নেয়গিরির অস্তিত্ব আছে তা কিন্তু নয়। পৃথিবীতে অবস্থানরত সবচেয়ে সুউচ্চ পাহাড়ের থেকেও বড় আঁকারের পাহাড়ের অস্তিত্ব আছে আমাদের এই সৌরজগতের বিভিন্ন গ্রহে।
গ্রহের মধ্যবর্তি অবস্থিত ম্যাগমার জন্যই এইসব বড় বড় পাহাড়ের সৃষ্টি । আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত একমাত্র পৃথিবীতেই সীমাবদ্ধ নয়। পৃথিবীর থেকেও ঢের গুনে বড় আঁকারের অগ্ন্যুৎপাত দেখা গিয়েছে বুধ , শুক্র , মঙ্গলের মতো গ্রহে।
আমাদের আলোচিত অলিম্পাস মন্স সৌরজগতের যেকোনো প্ল্যানেটের পাহাড়গুলোকে হার মানায়। বৃহৎ আঁকারের এই দানবটি মঙ্গলে অবস্থিত। শুরু করার আগে চলুন মঙ্গল গ্রহ সম্পর্কে জেনে নেয়া যাক।
মঙ্গল (Mars) হলো আমাদের সৌরজগতের চতুর্থ গ্রহ। পৃথিবীর পাশেই এর অবস্থান। ২৪.৬ ঘন্টায় এর একদিন অতিবাহিত হয়। লোহার মরিচার মতো মাটির রং হওয়ায় মঙ্গলকে রেড প্ল্যানেট নামে ডাকা হয়। মঙ্গলের আঁকার পৃথিবীর আঁকারের প্রায় অর্ধেক।
লাল রঙের এই গ্রহটি অনেক আগেই তার অগ্ন্যুৎপাতজনিত সক্রিয়তা হারিয়েছে। এক সময় মঙ্গল গ্রহ পৃথিবীর মতই আগ্নেয়গিরিতে সক্রিয় ছিল। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় এর অগ্ন্যুৎপাত নিঃশেষ হয়ে যায় এবং শীতল হয়ে পড়ে। মঙ্গলের গড় তাপমাত্রা প্রায়-৬২ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
চিত্রঃ লাল রঙের গ্রহ মঙ্গল; সোর্স: নাসা
মঙ্গল খুবই উপভোগ্য স্থান হতো যদি এর প্রান ফুরিয়ে না যেতো। এক সময় মঙ্গলে বয়ে চলতো অসংখ্য নদীর ধারা সাথে সাথে বয়ে চলতো উত্তপ্ত লাভার স্রোত। বিশ শতকের শুরুর দিকে বিজ্ঞানীরা তো মনেই করতেন মঙ্গলে প্রাণের অস্তিত্ব আছে। এনিয়ে তৈরি হয়েছে বিভিন্ন চলচিত্র ও।
নাসার বিজ্ঞানীরা মার্চে বিভিন্ন নভোযান পাঠিয়ে পানি প্রবাহের অনেক চিহ্ন পেয়েছেন। একসময় মার্চের মাটিতে বয়ে চলতো পানির ধারা। মার্চের বয়ে চলা এই পানি প্রবাহ প্রমাণ করে যে হয়তো এই লাল রঙের গ্রহে প্রাণের অস্তিত্ব ছিলো।
কারন পানি জীবনের জন্য অপরিহার্য। মঙ্গলগ্রহ গিরিখাত, আগ্নেয়গিরি এবং বিশাল বিশাল গর্তে পরিপূর্ণ। লাল রঙের ধূলো সারা মঙ্গলকে পরিবেষ্টিত করে রেখেছে। মাঝে মাঝে লাল রঙের ধুলো জমা এই গ্রহে ধূলিঝড় দেখা যায়।
যদিও এখন মঙ্গলে আগ্নেওগিরির সক্রিয়তা নেই কিন্তু এক সময় যে এই রেড প্ল্যানেটটি আগ্নেয়গিরিতে সক্রিয় ছিলো তার প্রমাণ পাওয়া যায়। বিশাল বিশাল পাহাড়ের সৃষ্টিই এর কারন। অলিম্পাস মন্স এই রকমই একটি বিশাল আগ্নেয় বিস্ফোরণের কারন।
আগ্নেয়গিরি থেকে সৃষ্ট এই বিশাল পাহাড় ১৬ মাইল (২৪ কিলোমিটার) উঁচু। এই বিশাল উচ্চতা পৃথিবীর মাউন্ট এভারেস্টের থেকেও তিন গুন লম্বা। মন্স শব্দের অর্থ হলে দানব। অলিম্পাস মন্সের এই দানবীয় উচ্চতা সোলার সিস্টেমের সবচেয়ে বৃহৎ আগ্নেয়গিরি হিসেবে মঙ্গলে আত্মপ্রকাশ করেছে।
চিত্রঃ থারসিস মন্টেস এবং অলিম্পাস মন্স। Source: NASA/ESA
অলিম্পাস মন্স যে শুধু উচ্চতায় এগিয়ে আছে তা কিন্তু নয়। উচ্চতার সাথে সাথে এর দখল করা জায়গাও সুদূর প্রসারিত। উচ্চতার তুলনায় অলিম্পাস মন্স ২০ গুন প্রশস্ত। এর ব্যাস ছড়িয়ে রয়েছে ৬০০ কিলোমিটার জুড়ে।
যদি অলিম্পাস মন্স আমেরিকা ওপর ফেলানো হতো তাহলে এটি পুরো অ্যারিজোনা দখল করে ফেলত। এবং একে যদি ইউরোপে ফেলানো হতো তাহলে পুরো ফ্রান্সকেই দখল করে ফেলত এই বৃহৎ আকৃতির মনস্টারটি।
২০১১ সালের এক গবেষণা বলে এই আগ্নেওগিরির মধ্যে যে পরিমান উপাদান রয়েছে তা পৃথিবীর যেকোনো আগ্নেয়গিরির আয়তনের থেকে একশো গুন বেশী। অলিম্পাস মন্স, একই স্ফিত অংশ থারসিস মন্টেস যেখানে তিন আগ্নেয়গিরি অ্যাসক্রয়েস, পাভোনিস এবং আরসিয়া অবস্থিত তার পাশেই অবস্থান করছে।
অনেকেই মনে করছেন এই চারটি বৃহৎ আঁকারের পাশাপাশি অবস্থিত আগ্নেয়গিরির ওজন মঙ্গলের পৃষ্ঠতলের বহন করার ক্ষমতার থেকেও বেশী। যদিও এই বৃহৎ আগ্নেয়গিরিগুলো উপর থেকে মঙ্গলের পৃষ্ঠতল অপেক্ষা অনেকটাই ছোট দেখায়।
প্রায় ৩ বিলিয়ন (৩০০ কোটি) বছর আগে মঙ্গলের মেরু অঞ্চলের ওজন এতটাই বেশী হয়েছিলো যে মেরু অঞ্চলের ভূপৃষ্ঠ তার ওজনের ভারে পিছলিয়ে বিষুব অঞ্চলে চলে এসেছিল। এর ফলে মঙ্গলে অনেক পরিবর্তন হয়েছিল। নতুন নতুন নদী সৃষ্টি থেকে শুরু করে দেখা দিয়েছিল জলবায়ুর পরিবর্তন।
বৃহৎ আকৃতির অলিম্পাস মন্স একটি শিল্ড ভল্কানো। শিল্ড ভল্কানোর চরিত্র হলো এরা অনেক বছর ধরে সক্রিয় থাকে এবং প্রতিনিয়ত এদের মুখ থেকে লাভা বের হয়ে এর আশেপাশে জমা হয়।
ফলে বছরের পর বছর লাভা জমা হতে হতে বৃহৎ আঁকার ধারন করে। আমাদের পৃথিবীতে অধিকাংশই এই রকম চরিত্রের আগ্নেয়গিরি।
চিত্রঃ টেকটনিক প্লেটের চলন। Source: www.internetgeography.net
কিন্তু মঙ্গলগ্রহ পৃথিবীর থেকে আঁকারে অর্ধেক হলেও কিভাবে পৃথিবীর থেকেও বড় দানব তৈরি করলো? আসলে এর উত্তর খুবই সুন্দর ভাবে দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। যেহেতু আমাদের পৃথিবী আঁকারে বড় তাই এর টেকটনিক প্লেটগুলো পৃথক পৃথক হয়ে থাকে।
ফলে পৃথিবীর মধ্যে অবস্থিত ম্যাগমা পৃথক হয়ে থাকা টেকটনিক প্লেটের ফাঁকা স্থান থেকে বের হয়ে আসতে পারে। তাই পৃথিবীর আগ্নেয়গিরি থেকে অপেক্ষাকৃত কম লাভা বের হয়ে জমা হয়।
অন্যদিকে মঙ্গলগ্রহ তুলনামূলক ছোট হওয়ায় এর টেকটনিক প্লেট থাকে না। ফলে সমস্ত লাভা বের হয়ে আসে আগ্নেয়গিরির মুখ থেকে। মঙ্গলের অভিকর্ষ টান পৃথিবীর থেকে কম হওয়ার কারনে লাভা ধিরে ধিরে প্রবাহিত হতে পারতো। তাই খুব সহজেই লাভা জমে এদের আঁকার হতো বিশাল।
পৃথিবীর টেকটনিক প্লেটের নড়াচড়ার কারনে যেখানে আগ্নেয়গিরি সক্রিয় থাকতো সে স্থান পরিবর্তিত হতো। মানে আগ্নেয়গিরির হট স্পটের অবস্থান একই থাকলেও পৃথিবীর উপরের সারফেস তার জায়গা পরিবর্তন করতো ধিরে ধিরে।
ফলে একই স্থানে বেশী ম্যাগমা জমে বৃহৎ আকৃতির আগ্নেয়গিরি তৈরি হতো না। কিন্তু মঙ্গলের টেকটনিক সক্রিয়তা নেই বলেই একই জায়গায় সব ম্যাগমা জমা হতো।
অলিম্পাস মন্স ৩.৫ বিলিয়ন (৩৫০ কোটি) বছর বয়স্ক। মানে দাঁড়ায় অনেক বছর ধরে জমা হয়েছে এর ম্যাগমা এবং অনেক আগেই এই আগ্নেয়গিরির সৃষ্টি। বিজ্ঞানীদের ধারনা অলিম্পাস মন্স আরও ১০০ মিলিয়ন (১০০০ লক্ষ্য) বছর ধরে সক্রিয় থাকতে পারতো।
যদি এরকমটা হতো তবে চিন্তা করুন এই আগ্নেয়গিরি আরও বিশাল আঁকার ধারন করতে পারতো। ১০০ মিলিয়ন বছর বয়স্ক কোন আগ্নেয়গিরিই আমাদের পৃথিবীতে খুঁজে পাওয়া যাবে না।
থারসিস মন্টেস স্ফীত এলাকাটি এতটাই বিশাল যে মঙ্গলের ধুলি ঝড়ের মধ্যেও উপর থেকে দেখা যায়। ইতালিয়ান বিজ্ঞানি জিওভান্নি শিয়াপ্রেলি ১৯ শতকে মাত্র আট ইঞ্চি টেলিস্কোপ ব্যাবহার করেই পৃথিবী থেকেই মঙ্গলের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করেন।
১৯৭১ সালে নাসার মেরিনার নয় যখন মঙ্গলে আসলো তখন শুধুমাত্র উপর থেকেই আগ্নেয়গিরির চুড়া পর্যবেক্ষণ করতে পেরেছিল। ধুলি ঝড়ের কারনে এর বেশি কিছু করা সম্ভব হয় নি।
কিন্তু তারপরেও বিজ্ঞানীরা থেমে থাকেনি। নানাভাবে চেষ্টা চালাতে থাকে অলিম্পাস মন্সে ওঠার জন্য। এবিষয়ে মাইকেল চালমার ডান বলেন “ আমি ব্যক্তিগতভাবে আহবান করবো আমাদের এই মঙ্গলের অলিম্পাস মন্সের চূড়ায় ওঠার প্রচেষ্টায় সবাইকে যুক্ত হবার জন্য”।
তবে সশরীরে এই বিশাল আগ্নেয়গিরিতে ওঠার চেয়ে ওপর থেকে ছবি বিশ্লেষণ সহজ ছিল। এর পরবর্তীতে ইউরোপিয়ান মার্চ এক্সপ্রেস অরবিটারে হাই রেজুলেসন ক্যামেরা লাগানো হয়। যাতে করে মঙ্গলের ভূখণ্ডের আগ্নেয়গিরির একটি মডেল তৈরি করা যায়।
এভাবে ত্রিমাতিক ছবি তৈরির মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা জানতে পারেন এই দানবটি সম্পর্কে। পরিশেষে লাল আঁকারের এই গ্রহটিতে সুবিশাল আগ্নেয়গিরি আবিষ্কৃত হলেও অনেক বিষয়ই বিজ্ঞানীদের কাছে অজানা।
বিজ্ঞানীরা খুঁজে বেড়াচ্ছেন এককালে মঙ্গলের বুকে পানি প্রবাহিত হলেও এখন কেনো এই গ্রহটি নিষ্ক্রিয়। মৃত প্রায় এই গ্রহটিতে প্রাণের অস্তিত্ব প্রমানের আশায় বুক ভাসাচ্ছেন অনেক বিজ্ঞানীই। অনেকে ধারনা করছেন পৃথিবীর শেষ পরিনতি এইরকম মঙ্গলের মতই হবে।
তথ্য সহায়তাঃ নাসা, ডিসকভার ম্যাগাজিন
মন্তব্য লিখুন