মোগল শাসনামলে যতজন সম্রাট এসেছিলেন তাদের মধ্যে সম্রাট আওরঙ্গজেব ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ শাসক। ইসলামি সংস্কৃতি প্রচারে যিনি তার প্রায় সমস্ত সময় অতিবাহিত করেছেন৷ আসুন জেনে নেই কেমন ছিল সম্রাট আওরঙ্গজেব এর ইসলামি চিন্তাভাবনা ও শাসনামল!
আওরঙ্গজেব যিনি আবুল মুযাফফর মহিউদ্দীন মুহাম্মদ আলমগীর বা জগত-বিজয়ী নামে খ্যাত ছিলেন। তিনি ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশ ও এর আশপাশের অবস্থানরত রাজ্যের সম্রাট। তবে তিনি বিখ্যাত অত্যাচারী মোগল রাজা হিসেবে পরিচিত তৈমুর লংয়ের অধঃস্তন সন্তান ছিলেন । তার জন্ম ১৫ জিলহজ ১০২৪ হিজরী সাল মােতাবেক ইংরেজি ২৪ অক্টোবর ১৬১৯ খ্রিস্টাব্দে । ফার্সিতে আওরঙ্গজেবের অর্থ আরশের সৌন্দর্য, আওরঙ্গ অর্থ “আরশ” আর জেব অর্থ “সৌন্দর্য“। আর ফারসী আলমগীর অর্থ “জগদ্বিজয়ী“।
আলমগীর ভারতীয় মুসলিম মোগল সাম্রাজ্যের অন্যতম সেরা সম্রাট শাহজাহানের ছেলে। যিনি (শাহজাহান) প্রিয়তমা স্ত্রীর সমাধিস্থল হিসেবে ৭ম আশ্চর্যের অন্যতম তাজমহল নির্মাণ করেছিলেন। যেখানে সমাধিস্থ করা হয় মমতাজ নামে খ্যাত আবুল মুযাফফরের জননীকে।
সম্রাট শাহজাহান তার ভালোবাসায় খুব বেশি আসক্ত ছিলেন। এমনকি এ জন্য তিনি রাজা হিসেবে থাকার অযােগ্য হয়ে পড়েন। ফলে নিজ জীবদ্দশায় ভাইদের সঙ্গে একাধিক যুদ্ধের পর নিজ পুত্র সুলতান আবুল মুযাফফরকে রাজ্যভার অর্পণ করেন।
আওরঙ্গজেব অন্য মােগল সম্রাটদের মতাে ছিলেন না। বরং তার জীবন-কথায় তিনি আলেম, ইবাদতগুর, দুনিয়াবিমুখ, মুত্তাকী ও কবি হিসেবে সুপরিচিত। তিনি শাখাগত বিষয়াদিতে ছিলেন হানাফী মাযহাবপন্থী। তাই তিনি অন্য কোনো মােগল সম্রাটদের মতাে ছিলেন না, ছিলেন তাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ।
[০১] তিনি আওরঙ্গজেব বিদ’আত ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। নিজে গান-বাজনায় দক্ষ হওয়া সত্ত্বেও তা শােনা ত্যাগ করেন। পৌত্তলিক ও বিদ’আতী বিভিন্ন উৎসবাদী তিনি বাতিল করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন । রহিত করেন শির নত করা এবং মাটিতে চুমু খাওয়ার মতো স্পষ্ট বিদআত সমূহ। যা পূর্বতন রাজাদের জন্য করা হত।
বিপরীতে তিনি ইসলামী সম্ভাষণ-বাক্য তথা ‘আসসালামু ‘আলাইকুম’-এর মাধ্যমে অভিবাদন জানানাের নির্দেশ দিয়েছিলেন। সম্ভবত এ কারণে ইসলামের প্রতি বিদ্বেষ পােষণকারী কিছু লেখক তাকে গোঁড়া হিসেবে অপবাদ দিয়েছিল।
অবশ্য এসব বিষয়ে আওরঙ্গজেব সন্দেহাতীতভাবে সালাফী ছিলেন। যদিও তিনি ছিলেন হানাফী মাযহাবপন্থী। আর এই দেশগুলােতে তখন হানাফীরা আকীদার ক্ষেত্রে মাতুরীদীয়্যা ছিলাে।
তাই অনেক জীবনীকার তাকে সূফী হিসেবেও উল্লেখ করেছেন। বস্তুত সবকিছু আল্লাহই ভালাে জানেন তার অবস্থা ও বিশ্বাস সম্পর্কে।
[০২] তার জীবনালেখ্য তার কর্ম ও কীর্তিই বেশি প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। যেমন তার ইবাদতমুখিতা, দুনিয়াবিমুখতা ও ধার্মিকতা। এসব বিষয়ে জীবনীকারগণ তার সম্পর্কে প্রশংসনীয় অনেক কিছু লিখেছেন। তার প্রশংসিত কাজগুলাের মধ্যে উল্লেখযােগ্য হলাে- কুসংস্কার ও বিদ’আতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, রাফেযী-শিয়া রাজ্যগুলাে নির্মূল এবং বিদ’আতী ও পৌত্তলিক উৎসবাদি নিষিদ্ধ করার মত কাজ ।
এসব কাজের জন্য, তিনি সম্মান, মর্যাদা, নেক দু’আ পাওয়ার উপযুক্ত। আর এটিই আওরঙ্গজেবের শাসনকার্য পরিচালনায় সালাফ তথা পূর্বসুরীদের কর্মপন্থার বাস্তব প্রয়ােগ।
তার এসব কর্মের জন্য আরব সাহিত্যিক শাইখ আলী তানতাবী রহ. আওরঙ্গজেব ক্ষেত্রে খুলাফায়ে রাশিদীনের ‘অবশিষ্টাংশ’ উপাধি প্রয়ােগের দাবী করেছেন।
তাঁর রচিত ‘রিজালুম মিনাত-তারীখ’ (ইতিহাসের মনীষীরা) গ্রন্থে তিনি তার অমূল্য জীবনী সংযুক্ত করেছেন। আওরঙ্গজেবের জীবনী শেষ করেছেন তিনি এ কথা বলে, ‘সম্রাট এমন দু’টি বিষয় করতে সক্ষম হয়েছিলেন যা পূর্ববর্তী কোনাে মুসলিম শাসক সক্ষম হন নি।
প্রথম: তিনি পাঠদান কর্ম সম্পাদন বা কিছু সংকলন ইত্যাদি কাজের দাবী করা ছাড়া কোনাে আলেম বা পণ্ডিতকে উপঢৌকন বা সম্মানি দিতেন না। এমন যাতে না হয় যে তারা সম্পদ পেলেন আর অলস হয়ে গেলেন। এতে করে দুটি মন্দ কাজের সন্নিবেশ হবে- অধিকার ব্যতীত সম্পদ গ্রহণ এবং জ্ঞান গােপন করা।
দ্বিতীয়ঃ তিনি প্রথম ব্যক্তি যিনি শরী’আতের বিধি-বিধানগুলাে এক কিতাবে লিপিবদ্ধ করেন, যাকে আইন হিসেবে গ্রহণ করা হয়। তাঁরই নির্দেশ, তত্ত্বাবধান ও সুনজরে ফাতওয়া সংকলনগ্রন্থ প্রণীত হয়। যা সম্রাটের নামে নাম দেওয়া হয় ‘ফাতাওয়া আলমগীরী’। এটি ফাতাওয়া হিন্দিয়া’ নামে সুবিখ্যাত। ফিকহে ইসলামীতে বিধি-বিধান সংক্রান্ত সবচেয়ে বিখ্যাত ও বিন্যাসের দিক থেকে সবচেয়ে অনবদ্য গ্রন্থ।” (রিজালুম মিনাত তারীখ, পৃ. ২৩৬)
আওরঙ্গজেব এর নিকটতম সময়ে যিনি তাঁর জীবনী রচনা করেছেন, তিনি হলেন আবুল ফযল মুহাম্মদ খলীল ইবন আলী আল-মুরাদী রহ. (মৃত্যু : ১২০৬ হি.)।
তিনি আওরঙ্গজেবকে সূফী-সাধক হিসেবে বিশেষিত করে তার জীবনীতে লিখেছেন, (সম্রাট আওরঙ্গজেব) আমাদের যুগে হিন্দুস্থানের সম্রাট, আমিরুল মুমিনীন ও ইমাম তথা মুমিনদের নেতা ও আমীর, মুসলিমদের এবং রাষ্ট্রব্যবস্থার স্তম্ভ, আল্লাহর পথের মুজাহিদ, বিশিষ্ট আলেম ও আল্লামা, আরেফবিল্লাহ বা আল্লাহর পরিচয় লাভকারী সূফী এবং দীনের সাহায্যে অটল বাদশাহ।
নিজ দেশে আওরঙ্গজেব কাফিরদের নির্মূল করেন। তাদের সবাইকে করেন পরাস্ত। তাদের গির্জাগুলাে তিনি খুঁড়িয়ে দেন। তাদের অংশীদারদের দুর্বল প্রমান করেন । ইসলামকে সাহায্য করেন এবং হিন্দুস্থানে সম্রাট ইসলামের মিনার উঁচু করেন।
আল্লাহর কালামকে করেন একমাত্র বুলন্দ। হিন্দুস্থানের কাফিরদের থেকে তিনি জিযয়া গ্রহণ করেন। শক্তি ও সংখ্যাধিক্য হেতু যা ইতােপূর্বে কোনাে বাদশাহ গ্রহণ করতে সক্ষম হন নি।
অব্যাহতভাবে তিনি সুবিশাল সব রাজ্য বিজয় করে যান। যখনই তিনি কোনাে শহর বিজয় করার ইচ্ছে পোষন করতেন , তা করেই ছাড়তেন। এমনকি আল্লাহ তাকে সম্মানের জগতে স্থানান্তর অব্দি তিনি ছিলেন জিহাদের ময়দানে । যাবতীয় সময় ব্যয় করেছেন দ্বীনের কল্যাণ ও মহান পালনকর্তার খেদমতে।
সম্রাট আলমগীর (আওরঙ্গজেব) নিজের সময়গুলাে ভাগ করে নিতেন। নির্দিষ্ট সময় ছিল ইবাদত, পাঠদান, সামরিক দফতর, ফরিয়াদকারী, দিনে-রাতে আগত রাজ্যের সংবাদ ও চিঠি পাঠ করতেন প্রত্যেক কাজের জন্য। একটি কাজের সঙ্গে অন্য কাজের সময় কখনাে একাকার হতে দিতেন না । এককথায় তিনি ছিলেন সময়ের সৌন্দর্য-তিলক, সাম্রাজ্য পরিচালনায় তুলনারহিত ব্যক্তি।
তাঁর সাম্রাজ্য ও উত্তম জীবনী নিয়ে ফারসীতে অনেক দীর্ঘ বই সংকলিত হয়েছে। আগ্রহী ব্যক্তিগণ চাইলে সেসব পড়ে দেখতে পারেন “সিলকুদ-দুরার ফী আ’ইয়ানিল কারনিছ-ছানী ‘আশার; ৪/১১৩”
গ্রন্থকার উপরােক্ত বক্তব্যের পর আরও লিখেন, “তিনি ১০৬৮ সাল থেকে রাজ্য পরিচালনায় নিযুক্ত হন। হিন্দুস্থানবাসীদের জন্য আল্লাহ কল্যাণের ইচ্ছা করেছিলেন । আওরঙ্গজেব জুলুম ও অত্যাচার দেশ থেকে উঠিয়ে দেন। তাই হিন্দুস্তানের দিগন্তে তাঁর উষা উদিত হয়েছি । তৈমূরের গম্বুজে পূর্ণিমার চাঁদ উদ্ভাসিত হয়। তার মর্যাদার নক্ষত্র ঘূর্ণায়মান। তার সৌভাগ্যের পথ সুপ্রসারিত হয় । তিনি অধিকাংশ প্রসিদ্ধ হিন্দু রাজাকে বন্দী করেছিলেন। ফলপ তাদের রাজ্যগুলাে তাঁর আনুগত্যের অধীনে আসে। তাঁর কাছে সম্পদরাশি তূপীকৃত হতে থাকে। বিভিন্ন দেশ ও প্রজারা তার আনুগত্য করেছিল । তিনি সর্বদা জিহাদে সচেষ্ট থাকার চেষ্টা করতেন।”
রাজ্য ও রাজত্ব থেকে (জিহাদের উদ্দেশ্যে) বের হওয়া পর আপন নিবাসে আর ফিরে যাননি। একটি দেশ বিজয়ের পরই আরেকটি বিজয়ের জন্য প্রস্তুতি তিনি নিয়েছেন । অধীক সংখক তাঁর সৈন্য থাকায় তা ছিল গণনাতীত। তার মহত্ত্ব ও শক্তি ছিল বর্ণনাতীত। রাজত্ব বানিয়েছেন তিনি একমাত্র মহান আল্লাহর জন্যই। তিনি হিন্দুস্থানে ইলম-জ্ঞানের রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আলেম ও জ্ঞানীদের সম্মান এতােটা বৃদ্ধি করেন যে বিভিন্ন দেশ থেকে তাদের সমাবেশ ঘটতে শুরু করে।
সচ্চরিত্র, আল্লাহভীতি ও ইবাদত নিষ্ঠায় তাঁর যুগে মুসলিম সম্রাটদের কোন উপমা আর ছিল না। তিনি বিভিন্ন রাজ্যের হানাফী আলেমদের তার নামে এমন ফাতওয়া-গ্রন্থ সংকলনের নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে শরী’আতের প্রয়োজনীয় বিধি-বিধান সম্পর্কিত তাদের মাযহাবের প্রায় সবই সন্নিবেশিত থাকে ।
নির্দেশ মাফিক বহু খণ্ডে তা রচিত হয় এবং এর নামকরণ করা হয় ‘ফাতাওয়া আলমগীরী‘। এটি প্রসিদ্ধি লাভ করে হিজায, মিসর, শাম ও রামেক দেশগুলােয়। এর উপকারিতা ব্যাপকতর রূপ নেয় এবং এটি মুফতীদের উদ্ধৃতিগ্রন্থ হিসেবে সুপরিচিত হয়ে ওঠে।
আওরঙ্গজেব ১১১৮ ঈসাব্দে যিলকদ মাসে হারাম শরীফের রুকনে ইয়ামানীতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর মরদেহ বাপ-দাদার এই উপমহাদেশে স্থানান্তর করা হয়। তিনি মােট ৫০ বছর রাজত্ব পরিচালনা করেন। আল্লাহ তাঁর ওপর রহমত বর্ষণ করুন তাঁর ভুলগুলো ক্ষমা করুন, তাকে জান্নাতের সুৃমহান আসনের সদস্য করে নিন৷ (আমিন)
প্রিয় পাঠকগণ, তার সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানতে উস্তায আব্দুল মুন’ইম নামির রচিত ‘তারিখুল ইসলাম ফিল হিন্দ’ গ্রন্থের ২৮৬ নং পৃষ্ঠা দেখুন।
[তথ্যসুত্রঃ ইসলাম কিউএ]
মন্তব্য লিখুন