দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে বাংলার মানুষ যখন পরাধীন দেশে ক্ষুধা ও দারিদ্রের সাথে যুদ্ধরত, মাটির ঘর ও ছনের চালাও যখন অনেকের মাথায় জুটত না তখনই এই বাংলার মাটিতে জন্ম নেন আকাশচুম্বি ভবনের জনক স্থপতি ড. এফ আর খান ।
ড. এফ আর খান এর কীর্তি ও দেশপ্রেমের কথা এখনো আমরা অনেকেই জানি না, কিন্তু বিংশ শতাব্দীতে বহির্বিশ্বের অনেকের কাছেই বাংলাদেশের পরিচয় বাহক ছিলেন তিনি।
তৎকালীন সময়ে বিশ্বের সর্বোচ্চ ভবন সিয়া্র্স টাওয়ারের (বর্তমান উইলস টাওয়ার) নকশা করে স্থাপত্যবিদ্যায় নতুন এক দিগন্তের সূচনা করেন তিনি। প্রায় ৩০ বছর ধরে এই ভবন ছিল বিশ্বের সর্বোচ্চ ভবন। তাঁর প্রদর্শিত টিউব্যুলার স্ট্রাকচারাল ফর্ম পরবর্তিতে স্থাপত্যবিদ্যায় বহুল ব্যবহৃত ও ব্যাপক প্রশংসিত হয়। অনেক ক্ষেত্রে বিংশ শতকের শ্রেষ্ঠ প্রকৌশলীও মনে করা হয় তাঁকে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধেও তাঁর অবদান ছিল অনস্বীকার্য।
আর্টিকেলে যা থাকছেঃ
ড. এফ আর খান এর পৈতৃকনিবাস মাদারীপুর জেলার শিবচর উপজেলার ভান্ডারিকান্দি গ্রামে, ১৯২৯ সালের ৩রা এপ্রিল। তাঁর পূর্ণনাম ফজলুর রহমান খান। তাঁর পিতা খ্যাতনামা শিক্ষাবিদ খান বাহাদুর রহমান খান আর মাতা বেগম খাদিজা খানম।
তিনি ঢাকার আরমানিটোলা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৪৪ খ্রিষ্টাব্দে ম্যাট্রিক পরীক্ষা এবং ১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
এরপর কলকাতার শিবপুর বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হন। পরবর্তীতে পঞ্চাশের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কারণে তিনি ঢাকায় ফিরে আসেন এবং তৎকালীন আহসানউলাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ (বর্তমান বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে বাকি পরীক্ষা সমাপ্ত করেন৷ স্নাতকে তিনি প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করেন।
অতঃপর নিজ প্রতিষ্ঠানেই লেকচারার হিসেবে নিযুক্ত হন। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ফুলব্রাইট বৃত্তি নিয়ে পিএইচডি সম্পন্ন করার উদ্দেশ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গমন করেন৷ সেখানে ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ইউনিভার্সিটি অব ইলিনয় অ্যাট আর্বানা-শ্যাম্পেইন থেকে স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিংএ স্বীকৃতি এবং ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দে তত্ত্বীয় ও ফলিত বলবিজ্ঞান ক্ষেত্রে স্নাতকোত্তর উপাধি লাভ করেন।
১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি শিকাগোর স্কিডমোর, ওউইং ও মেরিল নামের প্রকৌশল প্রতিষ্ঠানে প্রকল্প প্রকৌশলী হিসেবে যোগদান করেন কিন্তু তার স্বদেশের প্রতি টান তাকে আবার দেশে ফিরিয়ে আনে। ১৯৫৬ সালে আহসানুল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পুনরায় নিজের পূর্ব পদে যোগদান করেন।
কিন্তু তিনি নিজেকে শুধু অধ্যাপনায় নিয়োজিত রাখতে চাননি। তাঁর স্বপ্নই ছিল আকাশ ছোঁয়ার নকশা তৈরী করা ও তা বাস্তবায়ন করা। তাই ১৯৫৭ সালে তিনি করাচি ডেভেলপমেন্ট অথরিটিতে যোগদান করেন। কিন্তু সেখানে সরকারি আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় তার জ্ঞানকে তিনি কাজে লাগাতে পারছিলেন না।
অচিরেই তিনি বুঝতে পারেন তৎকালীন পাকিস্তানে তার এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা অসম্ভব। তাই এরপর তিনি পুনরায় আমেরিকা চলে যান এবং স্থাপত্য প্রতিষ্ঠান স্কিডমোর আমন্ত্রণে সেখানে শিকাগো অফিসের পরিচালক হিসেবে যোগ দেন।
স্থপতি ড. এফ আর খান সবথেকে বেশি পরিচিতি পেয়েছিলেন তাঁর নকশাকৃত পৃথিবীর উচ্চতম (১৯৭৩ সাল থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত) ইমারত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে অবস্থিত Sears Tower (বর্তমান Wills Tower) এর জন্য। কিন্তু তাঁর সৃজনশীলতার প্রমান আমরা প্রথম পাই সেতু ডিজাইনিং থেকে, ১৯৫৫ সালে।
এরপরই তার ওপর দায়িত্ব পড়ে উচু ভবন নির্মানের। তখনই তিনি তার “tubular form” বা নলাকৃতির বিন্যাস উদ্ভাবন করেন। পূ্র্বে প্রচলিত রীতি ছিল উঁচু ইমারতের কাঠামোর জন্য কংক্রিট বা ইস্পাতের দৃঢ় কাঠামো ব্যবহার করা। প্রায় ১৫ তলা পর্যন্ত ইমারতে এই পুরাতন পদ্ধতিতে কোনোরকম সমস্যা হতো না, কিন্তু এর থেকে বেশি উচ্চতার ভবন নির্মানের ক্ষেত্রে বাতাসের চাপ ও ভূকম্পনের জন্য যে অতিরিক্ত পীড়ন সৃষ্টি হয়, তার জন্য অতিরিক্ত অনেক কংক্রিট ও ইস্পাতের প্রয়োজন হয় আর এর জন্যই খরচ বহু গুন বেড়ে যায়।
কিন্তু এই নলাকৃ্তির কাঠামো বিন্যাসে স্কাইক্র্যাপার বিল্ডিং তৈ্রি করা সম্ভব অনেক কম খরচেই, কারন এতে ১৫ তলার ওপরেও (এমনকি ১০০তলা) কোনো অতিরিক্ত কংক্রিট ও ইস্পাতের দরকার হয় না। সাথে ভুমিকম্প বা অন্যান্য দুর্যোগেও এই নতুন ধারনা অনেক বেশি নিরাপদ।
ড. এফ আর খানের টিউবুলার বিন্যাস কিন্তু কোনো টিউব বা নল দিয়ে তৈরি নয় এই বিন্যাস গড়ে ওঠে প্রধানত কলাম ও বিমের সমন্বয়ে। এ ছাড়া দালানের ভেতরে সিঁড়ি ও লিফটের চারদিকে যে কংক্রিটের দেয়াল থাকে তাকেও টিউবের অংশ ধরে কাজ করা হয়। ইমারতের বাইরের দিকের কলামগুলো খুব কাছে কাছে বসিয়ে প্রতি তলায় বিম দিয়ে সংযুক্ত করলে এর প্রকৃতি টিউব বা ফাঁপা দন্ডের মতো হয়, যার ভূমিকম্প বা বায়ুচাপ থেকে সৃষ্ট পীড়ন বহনের ক্ষমতা তৎকালীন অন্য কাঠামোগুলির তুলনায় অনেক বেশি।
এ ছাড়া ভবনের ভেতরে অতিরিক্ত কলাম না থাকায় ভবন অপেক্ষাকৃ্ত বেশি খোলামেলাভাবে ডিজাইন করা সম্ভব। ১৯৬২ সালে শিকাগোর ৩৮ তলা ভবন ‘ব্রানসউইক বিল্ডিং’-এ তিনি ব্যবহার করেন “টিউব ইন টিউব সিস্টেম”।
১৯৬৪ সালে শিকাগোর ৪৩ তলা আবাসিক ভবন ‘চেস্টনাট ডিউইট অ্যাপার্টমেন্ট’এ তিনি ব্যবহার করেন “ফার্মড টিউব সিস্টেম”।
আরও পড়ুনঃ বিজ্ঞানের চেতনায় বাংলার ধ্র্রুবতারা জামাল নজরুল ইসলাম
১৯৬৫ সালে শিকাগোর ১০০ তলা বহুবিধ ব্যবহার-উপযোগী ভবন ‘জন হ্যানকক্ টাওয়ার” এ ব্যবহার করেন ব্রাকেড টিউব সিস্টেম। ১৯৭০ সালে নিউ অরলিয়েন্সে ৫২ তলা ‘ওয়ান-শেল স্কোয়ার” এ তিনি প্রথম ব্যবহার করেন “কম্পোজিট টিউব সিস্টেম”। ১৯৭৩ সালে শিকাগোর ১১০ তলা অফিস ভবন Sears Tower-এ ব্যবহার করেন “বান্ডেল টিউব সিস্টেম”।
এর প্রত্যেকটিরই বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো ইমারতের উচ্চতার জন্য কোনো অতিরিক্ত মূল্য খরচ প্রত্যেকটি পদ্ধতির বিশেষত্ব হলো তাঁর উদ্ভাবিত নতুন এই পদ্ধতিতে বিশেষ কঠিন কোনো তাত্ত্বিক গণিতশাস্ত্রের প্রয়োগ নেই, বস্তুগত ধারণার সহজ প্রয়োগের ওপরই এগুলোর গঠন, ফলে একজন ডিজাইনার সহজেই বুঝতে পারেন। তাঁর এই সকল তত্ত্বের ব্যাখ্যা বিশ্বের সব নামিদামি গবেষণাপত্রে প্রকাশিত হয়েছে।
শুধু এই নয় “Computer Aided Design” বা CAD এর প্রায় সূচনালগ্নে তিনি যথেষ্ঠ অবদান রাখেন, যখন কম্পিউটার বিজ্ঞানের সাথে স্থাপত্যবিদ্যার মেলবন্ধন ঘটানো ছিল এক চ্যালেঞ্জিং বিষয়।
‘ইঞ্জিনিয়ারিং নিউজ রেকর্ড’ থেকে এই অসীম প্রতিভাবান স্থপতিকে “Man of The Year” নির্বাচিত করা হয় ১৯৭২সালে। পাঁচবার স্থাপত্য শিল্পে সবচেয়ে বেশি অবদানকারী ব্যক্তিত্ব হিসেবে অভিহিত হবার গৌরব লাভ করেন তিনি (১৯৬৫, ১৯৬৮, ১৯৭০,১৯৭১, ১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দে) ৷
১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল একাডেমি অফ ইঞ্জিনিয়ারিং এর একজন সন্মানিত সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন এবং ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে আমেরিকার ‘নিউজ উইক’ ম্যাগাজিন শিল্প ও স্থাপত্যের উপর প্রচ্ছদ কাহিনীতে তাকে মার্কিন স্থাপত্যের শীর্ষে অবস্থানকারী ব্যক্তি হিসেবে সন্মানিত করে৷
১৯৯৮ সালে শিকাগো শহরের একটি ব্যস্ততম সংযোগ সড়কের নামকরণ করা হয় “ফজলুর আর. খান ওয়ে“। জেদ্দা বিমানবন্দরে দৃষ্টিনন্দন হজ টার্মিনাল ডিজাইনের জন্য তিনি আগা খান স্থাপত্য পুরস্কারে ভূষিত হন।
শিকাগোতে ড. এফ আর খান এর স্মৃতি স্মরণে নগরীর কেন্দ্রস্থলে ৮ ফুট উঁচু ও ১১ ফুট দীর্ঘ একটি ভাস্কর্য স্থাপিত হয়। এতে ডঃ এফ আর খান এর প্রতিকৃতি ছাড়াও পেছনে আছে তার ডিজাইন করা কিছু উঁচু ভবনসহ শিকাগোর স্কাইলাইন।
দীর্ঘদিন প্রবাসে থাকা সত্ত্বেও মাতৃভূমির জন্য তার অগাধ ভালোবাসা রয়েই গিয়েছিল। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের পক্ষে তিনি প্রত্যক্ষভাবে আর্থিক সহযোগিতা করেন। প্রবাসের বাঙালিদের নিয়ে তিনি মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য করার জন্য বাংলাদেশ ইমারজেন্সি ওয়েলফেয়ার আপিল নামে একটি ফান্ড গঠন করেন।
এফ আর খানই প্রথম বাঙালি, যিনি মার্কিন সিনেটে যান বাংলাদেশের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানের বর্বরতার বিরুদ্ধে বিশ্বজনমত গঠনের জন্য। বাংলাদেশ তার এই অবদানের স্মরণে ১৯৯৯ সালে তাকে মরোণোত্তর স্বাধীনতা পুরষ্কারে ভূষিত করেন। তাঁর সন্মানে বাংলাদেশ ডাকবিভাগ ৪টাকা মূল্যমানের ডাকটিকটও প্রকাশ করে।
১৯৮২ সালের ২৬ মার্চ সৌদি আরবের জেদ্দায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় এই অসাধারণ গুণী মানুষটির। ফজলুর রহমান খানকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয় শিকাগোর গ্র্যাসল্যান্ড কবরস্থানে। জীবনের শেষ কয়েক বছর তিনি কর্মরত ছিলেন জেদ্দায় বিমানবন্দর ও মক্কায় বাদশাহ আবদুল আজিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক পরিকল্পনায়।
ড. ফজলুর রহমান খান শুধু অতুলনীয় প্রতিভাবান একজন প্রকৌশলীই ছিলেন তা নয়, তাঁর অসধারন মানবীয় গুণাবলীর প্রমাণ পাওয়া যায় মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ দ্বারা। তিনি উদার সাংস্কৃতিমনাও ছিলেন। রবীন্দ্রসংগীতে তাঁর যথেষ্ট আগ্রহ ছিল। তিনি দেশের নিম্নবিত্ত মানুষের বাসস্থান উন্নয়নের দিকে মনোনিবেশ করতে চেয়েছিলেন।
তাঁর পরিকল্পনা ছিল কম খরচে ও দেশের পরিবেশ উপযোগী বাসস্থান নির্মান করা। কিন্তু তাঁর সেই পরিকল্পনা আর মৃত্যুর আগে বাস্তবায়িত করে যেতে পারেননি।
ড. এফ আর খান এর তাঁর অসাধারন মেধা ও সৃজনশীল কর্ম দ্বারা বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। ইউভার্সিটি অব ইলিনয় এর অধ্যাপক মীর এম আলী তার “আর্ট অব স্কাইস্ক্র্যাপার” বইটিতে এই অসামান্য প্রতিভাসম্পন্ন ব্যক্তির সম্পর্কে উল্লেখ করেন “আইনস্টাইন অব স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার”। প্রকৃতপক্ষেই তিনি বাংলাদেশের গর্ব আর পৃথিবীর বুকে তাঁর প্রতিভা এক অমূল্য সম্পদ।
মন্তব্য লিখুন