মাতা হারির আসল নাম মার্গারেট গিরট্রুইডা (গ্রিইৎজ) জেলে। মাতা হারি একজন পেশাদার নৃত্যশিল্পী এবং উপপত্নী ছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় একজন গুপ্তচর হয়ে কাজ করছিলেন এই নারী। ডাবল এজেন্ট হওয়ার আশঙ্কায় তাকে ১৯১৭ সালে মৃত্যু দন্ড দেয়া হয়েছিল। তার রহস্যে ঘেরা জীবন তাকে মাতা হারি নাম উপহার দেয়। এখনও তিনি অনেকের কাছে মহিলা ক্ষমতায়ন এবং এজেন্সির প্রতীক হিসেবে রয়ে গিয়েছেন।
আর্টিকেলে যা থাকছেঃ
মার্গারেটা জেলের জন্ম হয়েছিল ৭ আগষ্ট, ১৮৭৬, লিউয়ারডেন, নেদারল্যান্ড। তার পিতার নাম এডাম জেলে এবং মাতার নাম এন্টজে ভ্যান ডার মুলেন। তারা চার ভাইবোন ছিলেন এবং তিনি সবার বড় ছিলেন।
পিতা সম্পদশালী হওয়ায় মার্গারেটা ছোটবেলা থেকেই বিলাসবহুল জীবনযাপন এ অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন। ১৮৮৯ সালে ব্যবসায় মন্দার কারনে তার পিতা দেউলিয়া হয়ে যায়। এর মধ্যেই তার মা অসুস্থ হয়ে মারা যান।
তার মায়ের মৃত্যুর পর তার বাবা আবার পুনরায় বিবাহ করেন এবং মার্গারেটা তার দাদার কাছে থাকা শুরু করেন। সেখানে থাকাকালীন অবস্থাায় তিনি একজন স্কুলের প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জরিয়ে পরেন। কিছুদিন পরেই সেখান থেকে পালিয়ে তার চাচার বাসায় চলে যান।
ভাঙ্গা শৈশব নিয়েই চলছিল তার পথ চলা। তিনি ১৮ বছর বয়সে একটি সংবাদপত্রে পাত্রী চাই বিজ্ঞাপন এর জবাব দিয়েছিলেন। এটি ডাচ আর্মি ক্যাপ্টেন রুডলফ ম্যাকলেওড দিয়েছিলেন যিনি একজন সুন্দরী পাত্রী খুজছিলেন। রুডলফ ২০ বছরের বড় ছিল মার্গারেটার থেকে।
১৮৯৫ সালে তারা আমস্টারডামে বিয়ে করেছিলেন। বিয়ের পরপরই এই দম্পতি জাভাতে চলে আসেন। তাদের নরম্যান জন এবং লুই জেনি নামের দুই সন্তান ছিল। তাদের বৈবাহিক জীবন শান্তির ছিল না।
রুডলফ নানা রকমের অত্যাচার করতেন মার্গারেটার উপরে। আর্থিক এবং সম্মানের দিক থেকে শান্তিতে থাকলেও মার্গারেটা মনের দিক থেকে খুশি ছিলেন না। এদিকে তার দুই সন্তানই খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং লুই জেনি বেঁচে গেলেও দুই বছরের নরম্যান জন মারা যায়।
১৯০২ সালে এই দম্পতি পৃথক হবার সিদ্ধান্ত নেয় এবং লুই জেনি তার বাবা রুডলফের নিকট থেকে যায়।
পরে তিনি ফ্রান্সে চলে আসেন এবং সেখানে পিয়ানো এবং জার্মান শেখানোর মাধ্যমে অর্থ উপার্জনের চেষ্টা করছিলেন। তবে বিলাশবহুল জীবনযাপনে অভ্যস্ত মার্গারিটা এরকম সাধারন জীবনযাপনে সুখী ছিলেন না।
তিনি নিজেকে তার অভিনব নৃত্যশৈলীর মাধ্যমে সকলের কাছে উপস্থাপন করা শুরু করেন। বলা হয়ে থাকে স্ট্রিপটিজ নাচের হাতে খড়ি তাকে দিয়েই হয়েছিল।
তিনি নিজেকে সকলের কাছে জাভানীয় রাজকন্যা হিসেবে পরিচিত করেছিলেন। কিছুদিনের মধ্যেই তার নৃত্যশৈলী প্যারিসে তুমুল ঝড় তুলে ফেলেছিল। উপরস্থ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সকলের কাছেই তিনি আবেদনময়ী অপ্সরা হয়ে উঠেছিলেন।
ফ্রান্সে এসে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি এই আবেদনময়ীকে।তিনি তার নতুন নাম রেখেছিলেন মাতা হারি যার অর্থ ভোরের আলো। আর এই নামেই পরবর্তীতে সে সকলের কাছে পরিচিত হন।
মাতা হারি নিজের সৌন্দর্যের জালে ফেলে মিত্র বাহিনীর সেনা কর্মকর্তাদের কাছ থেকে নানা রকমের গোপন তথ্য আদায় করে প্রতিপক্ষের কাছে পাচার করতেন।
আরও পড়ুনঃ জোকার -“ দ্যা ক্লাউন প্রিন্স অফ ক্রাইম” কমিক জগতের জনপ্রিয় ভিলেন
সৌন্দর্যের আড়ালে যে তার এক ভয়ঙ্কর রুপ আছে সেটা কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। যুদ্ব চলাকালিন সময়ে জার্মান সামরিক কর্মকর্তা আরনল্ড ভন কাল্লের পাঠানো একটি টেলিগ্রাম এ H-২১ নামে একজন এজেন্টের কথা উল্লেখ ছিলো যা ফরাসি গোয়েন্দারা ধরে ফেলেছিলেন। আরো নানা রকমের তথ্যাদির মাধ্যমে স্পষ্ট হয়ে যায় যে এই গুপ্তচর আসলে মাতা হারি।
মাতা হারি ২১ বছর বয়সী রাশিয়ান পাইলট ভাদিম মাসলভ এর সাথে গভীর প্রেমে জড়িয়ে পড়েছিলেন। এই প্রথম তিনি তার জীবনে সত্যিকারের প্রেম উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। কিন্তু যুদ্ধ ক্ষেত্রে মাসলভ গুরুতর আহত হয়েছিলেন যার দরুন তার বাম চোখ নষ্ট হয়েছিল।
প্রেমিকের সাথে দেখা করার জন্য মাতা হারি ব্যকুল হয়ে উঠেন। তিনি ফ্রান্সের একজন অফিসারের সাথে দেখা করতে যায়। অফিসার তাকে ফ্রান্সের হয়ে গুপ্তচরবৃওির শর্তে মাসলফের সাথে দেখা করার অনুমতি দিয়েছিলেন।
মাতা হারির কারনে প্রথম বিশ্বযুদ্বের ফলাফলের উপরে অনেকাংশে প্রভাব পড়েছিল। তার চরবৃত্তির মাধ্যমে জার্মানি অনেক কিছু জানতে পেরেছিল এবং ৫০,০০০ ফরাসী সৈন্য হত্যার ঘটনায় তার হাত ছিল বলে অনেকেই মনে করেন। মাতা হারি চরবৃত্তি না করলে হয়তো বা প্রথম বিশ্বযুদ্বের ফলাফল অন্যকিছু হতে পারতো।
ডাবল এজেন্সির অপরাধে তাকে গ্রেফতার করা হয় এবং বিচারের আওতায় আনা হয়। এই সময় তার পাশে কেউ দাঁড়ায় নি এমনকি তার প্রেমিক মাসলফও নয়। নিজেকে নির্দোষ প্রমান করার কোন সুযোগই মাতাহারি কে দেয়া হয়নি।
আদালতে তাকে মৃত্যুদন্ড আদেশ দেয়া হয়। ত্রিকোনা চুপি আর নীল রঙের কোট পড়ে তিনি একজন মন্ত্রী ও দুইজন সন্ন্যাসিনী কে নিয়ে মনোনীত স্থানে এসে পৌঁছে ছিলেন।
তার চোখে কাপর বাঁধতে দেননি তিনি নিজেই। মৃত্যুকে সামনে থেকে দেখতে চেয়েছিলেন। সৈন্যদের জন্য একটি উড়ন্ত চুম্বন ছুড়ে মারলেন। কিছু সময়ের মধ্যেই বন্দুকের গুলি ছুড়া শুরু হয় এবং তার দেহটা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।
মৃত্যুদন্ড কার্যকরের পর তার দেহটি কেউ নিতে আসেনি। এজন্য প্যারিসে একটি মেডিকেল স্কুলে দেহটি দিয়ে দেয়া হয়েছিল যাতে সেটা ছাত্রদের কাটাছেঁড়ার কাজে লাগে।
মাতাহারি এই নামটি কোন কিংবদন্তির ন্যায় কম কিছু নয়। তার এই রহস্যময় কাহিনী এমন এক কিংবদন্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে যা এখনো কৌতুহলকে পর্যবসিত করে। তার ব্যবহৃত কিছু অলংকার প্রদর্শশালায় রাখা রয়েছে।
তাকে নিয়ে অসংখ্য জীবনী এবং সিনেমেটিক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে যার মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত গ্রেটা গার্বো এবং রমন নোভারো অভিনীত ১৯৩১ সালে মাতা হারি চলচ্চিত্র।
শতবর্ষ পরেও তাকে নিয়ে জল্পনা কল্পনার কোনো শেষ নেই। আসলেই কি তিনি জার্মানির স্পাই ছিলেন, নাকি ডাবল এজেন্ট ছিলেন? নাকি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ফ্রান্সের খারাপ ফলাফলের দায় ঢাকার জন্য জীবন বলি দিতে হয়েছিল এই রহস্যময়ী নারী মাতা হারিকে!
Wow…Nice! thanks for writing informative article 😍
Thank you apu onk kicu jante parlam