সম্প্রতি সময়ে বিশ্ববাসীর মুখে একটাই কথা “কবে আসছে করোনার ভ্যাকসিন?” কেন এই ভ্যাকসিনের জন্য দীর্ঘ প্রতিক্ষা? কারণ আমরা সবাই জানি ভ্যাকসিন আসলেই, এই মহামারী থেকে রক্ষা পাবে পৃথিবীর মানুষ। মোটকথা, ভ্যাকসিন হল এই মুহূর্তে পৃথিবীর ত্রাতা।
করোনা শুরু হওয়ার পর বিভিন্ন ওয়েবসাইটে দেখতে পাচ্ছি, প্রায় ১০০ বছর পর পর পূর্বে পৃথিবীতে কয়েকটি মহামারী রোগ বিস্তার করেছিল।
পূর্বের মহামারী রোগ গুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য যক্ষ্মা, কলেরা, গুটিবসন্ত, প্লেগ। প্রাণ হারিয়েছে কোটি কোটি মানুষ। কিন্তু এখন এই ব্যাধিগুলো আর মরণব্যাধি নয়। উল্লেখ্য রোগের ভ্যাকসিন আবিষ্কার হওয়ার এখন এই রোগগুলো সহজেই প্রতিরোধ্য।
যে ভ্যাকসিন আমাদের জীবন বাচায়, সেই ভ্যাকসিন কীভাবে আবিষ্কার হয়, কাদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে আমরা এই সুবিধা উপভোগ করেছি জেনে নেই সেই সম্পর্কে কিছু কথা।
সবাই জানে ভ্যাকসিনের আবিষ্কারক লুই পাস্তুর। কিন্তু ভ্যাকসিনের ধারণা মানুষের মনে অনেক আগে থেকেই কাজ করছিল।
সম্ভবত সর্বপ্রথম পেলেপনেশিয়ান যুদ্ধের বিখ্যাত ইতিহাসবেত্তা থুসাইডিডস মানুষের শরীরে রোগ -প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পর্কে উল্লেখ করেন।
খ্রীস্টপূর্ব ৪৩০ সালে প্লেগ রোগের বর্ননায় তিনি লিখেন যে, “যে সকল সেবিকা প্লেগ রোগ থেকে সুস্থ হয়ে উঠেছেন শুধুমাত্র তারাই আক্রান্ত রোগীদের সেবা দিতে পারবেন”। কারণ তারা দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হবে না। তথাপি বলা যায় প্রাচীন সমাজ ভ্যাকসিন আবিষ্কারের প্রায় দুই হাজার বছর আগে ভ্যাকসিন নিয়ে প্রাথমিক ধারণা করেছিল।
পঞ্চদশ শতাব্দীতে এই ধারণা কিছুটা উন্নতি হয়। বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায়, তখন গুটিবসন্তের থেকে নিস্তার পাওয়ার জন্য এই রোগে আক্রান্ত রোগীদের গুটি শুকানোর পর গুটির উপরের শুকনো শক্ত আবরণ নাসারন্ধ্র অথবা চামড়া ছোট করে কেটে চামড়ার মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হত। এই প্রক্রিয়াকে ভ্যারিওলেশন (Variolation) বলা হয়।
১৭১৮ সালে, লেডি মেরী রর্টলি মন্টেগু ব্রিটিশ এ্যাম্বাসিডারের স্ত্রী প্রথম ভ্যারিওলেশনের সুফল লক্ষ্য করেন এবং নিজের সন্তানদের উপর এই কৌশল প্রয়োগ করেন। ইংরেজ চিকিৎসক এ্যাডওয়ার্ড জেনার ১৭৯৮ সালে ভ্যারিওলেশনের উন্নতি সাধন করেন।
জেনার লক্ষ্য করেন, এক গোয়ালিনী যে গোবসন্ত দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিল তার আর গুটিবসন্ত হয় নি। এই ঘটনা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে জেনার আট বছরের এক বালককে পরীক্ষামূলকভাবে গুটির মধ্যকার তরল পদার্থ বালকের শরীরে প্রবেশ করান এবং পরে তাকে গুটিবসন্তের জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত করা হয়।
পূর্বের ধারণামত,ছেলেটির গুটিবসন্ত রোগ দেখা যায় নি। এই পদ্ধতি ধীরে ধীরে ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে এবং সঠিক জ্ঞানের অভাবে প্রায় একশো বছর অনান্য রোগে ও এই প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হত।
সর্বশেষে লুইস পাস্তুর গবেষণাগারে কলেরা সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া কালচার করতে সক্ষম হন এবং কিছু মুরগীকে কলেরার জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত করেন।
এরমধ্যে গ্রীষ্মের ছুটি শুরু হয়। ছুটি শেষে ফিরে এসে পাস্তুর পুরনো কালচার করা ব্যাকটেরিয়া কিছু সংখ্যক মুরগীকে ইনজেক্ট করেন। এই মুরগী গুলো অসুস্থ হয় ঠিকই কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে সেরে উঠে।
আরও পড়ুনঃ ভিটামিন আমাদের কোন শক্তি প্রদান করে না
তারপর তিনি নতুন করে ব্যাকটেরিয়া কালচার করেন এবং নতুন মুরগীতে ইনজেক্ট করেন। কিন্তু কমসংখ্যক মুরগী থাকায় তিনি পুরানো মুরগীতে ও ব্যাকটেরিয়া ইনজেক্ট করেন।
তিনি দেখে অবাক হন যে, নতুন মুরগী গুলো সব মারা গেছে আর পুরানো মুরগীগুলো সম্পূর্ণ সুস্থ, তাদের কোনো রোগের লক্ষণ নেই।
এই ঘটনা থেকে পাস্তুর ধারণা করেন , সময় জীবাণুর রোগ সৃষ্টিকারী ক্ষমতাকে দুর্বল করে দেয় এবং এই দুর্বল জীবাণু রোগ প্রতিরোধ করতে সক্ষম।
পাস্তুর এই দুর্বল প্রজাতির নাম দেয় “আ্যটিনিউটেট স্ট্রেইন” ( attenuate strain)। তিনি এই আ্যটিনিউটেট স্ট্রেইন কে ভ্যাকসিন বলে অভিহিত করেন।
ল্যাটিন ভাষায় “vacca” শব্দের অর্থ cowlযেহেতু জেনার গোবসন্ত নিয়ে কাজ করেছিলেন তাই পাস্তুর এই নামকরণ করেন।
১৮৮১ সালে পাস্তুর সর্বপ্রথম একপাল ভেড়ার উপর পরীক্ষামূলকভাবে,ভ্যাকসিন প্রয়োগ করেন অ্যানথ্রাক্স রোগের জন্য।
এরপর তিনি ভ্যাকসিনেটেড ভেড়া এবং ভ্যাকসিনেশন ছাড়া একপাল ভেড়াকে অ্যানথ্রাক্সের জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত করেন। এই থেকে শুরু হয় বিজ্ঞানের নতুন যাত্রা।
পরীক্ষায় দেখা যায়, সব ভ্যাকসিনেটেড ভেড়া সুস্থ আছে এবং ভ্যাকসিন ছাড়া ভেড়াগুলো মারা গেছে।
১৮৮৫ সালে, সর্বপ্রথম মানুষের শরীরে ভ্যাকসিনের প্রয়োগ করেন। একটি ছোট বালকের উপর জলাতঙ্কের ভ্যাকসিন প্রয়োগ করেন এবং সফল হয়।
সেই ছেলেটির নাম জোসেফ মেইস্টার। পাস্তুরের ভ্যাকসিনেশনের জন্য সে বেঁচে যায় এবং পরবর্তীতে পাস্তুরের প্রতিষ্ঠানের তত্ত্ববধায়ক হিসেবে কাজ করেন।
ভ্যাকসিন আবিষ্কারের এই ঘটনা চিকিৎসা বিজ্ঞানের এক নতুন দ্বার উন্মোচন করে। চিকিৎসা বিজ্ঞানকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে গেছে। এই যুগান্তকারী আবিষ্কারের জন্য চিকিৎসা বিজ্ঞানে লুইস পাস্তুর ও সহকর্মীদের নাম অবিস্মরনীয় হয়ে থাকবে।
মন্তব্য লিখুন