অনলাইন শিক্ষা ব্যবস্থার একটি উল্লেখযোগ্য মাধ্যমের নাম খান একাডেমি । আমেরিকান শিক্ষাবিদ সালমান খান প্রতিষ্ঠিত এই অলাভজনক সংস্থাটি সারা বিশ্বের অনেক শিক্ষার্থীকে তাদের পড়াশোনায় সহযোগিতা করে যাচ্ছে। এখানে কি কি বিষয় পড়ানো হয়, এর ব্যয়ভার বহন করে কে বা কারা এবং এর প্রতিষ্ঠাতা সালমান খানের সংক্ষিপ্ত পরিচয় তুলে ধরেছেন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী – ফারিয়া তাবাসসুম
ইন্টারনেট যে কেবল বিনোদনের মাধ্যম নয় তা আমরা ইতিমধ্যে অনুধাবন করতে পেরেছি। বিশেষ করে চলমান কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রমের সাথে আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা আরও বেশি পরিচিত হয়েছে।
আমাদের দেশে ১০ মিনিট স্কুল বিস্তৃত পরিসরে অনলাইন শিক্ষা উপস্থাপন করেছে। তবে ১২ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় ও আলোচিত খান একাডেমির কথা আমরা কতটুকু জানি?
আর্টিকেলে যা থাকছেঃ
আমেরিকান অলাভজনক এই মাধ্যমটি আনুষ্ঠানিক ভাবে যাত্রা শুরু করে ২০০৮ সালে। প্রতিষ্ঠাতা বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক সালমান খান।
২০০৫ সালে তিনি নিজের এক বোনের জন্য ইয়াহুতে গণিত নিয়ে একটি ভিডিও তৈরি করেন। তবে ধীরে ধীরে তার পরিবারের অন্যান্য ভাইবোনসহ বাইরের শিক্ষার্থীরাও এসব ভিডিওতে আগ্রহ প্রকাশ করে।
ফলশ্রুতিতে ২০০৮ সালে তিনি ইউটিউবে বিজ্ঞান ও গণিত নিয়ে সংক্ষিপ্ত ভিডিও প্রকাশ শুরু করেন। তার কম্পিউটারে এসব ভিডিও রেকর্ড করা হত।
জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকলে ২০০৯ সালে তিনি চাকরি ছেড়ে দিয়ে এক্ষেত্রে সম্পূর্ণ মনোনিবেশ করেন। তখন থেকেই ভিডিওগুলো প্রকাশ করেন খান একাডেমি নামে।
খান একাডেমি বিভিন্ন বিষয়ের লেকচারকে ভিডিও আকারে প্রকাশ করে থাকে। ইউটিউবে সংক্ষিপ্ত ভিডিও লেকচারের পাশাপাশি এর ওয়েবসাইট www.khanacademy.org তে লেকচারের ব্যাখ্যা এবং অনুশীলনের জন্য উদাহরণ দেয়া থাকে।
শুরুতে সালমান খান নিজেই সকল ভিডিও তৈরি করলেও বর্তমানে এখানে ২০০ জন বিষয়ভিত্তিক বিশেষজ্ঞ রয়েছেন। প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক এবং কলেজ পর্যায়ের প্রায় সকল বিষয়ের লেকচার রয়েছে খান একাডেমিতে।
বিজ্ঞান ও গণিতকে প্রাধান্য দেয়া হলেও অন্যান্য আরও অনেক বিষয়ে পড়ানো হয়।
গণিতে বীজগণিতের বিভিন্ন কোর্সসহ জ্যামিতি এবং বিজ্ঞান নিয়ে সাধারণ আলোচনাসহ পদার্থ, রসায়ন, জীববিজ্ঞান, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা, জৈব রসায়ন এবং প্রকৌশলের বিভিন্ন কোর্স করানো হয়।
এছাড়াও ব্যাকরণ ও মানবিকের কিছু বিষয়েও আলোচনা করা হয় খান একাডেমিতে। কয়েকটি বিষয়ের সম্পূর্ণ কারিকুলামও রয়েছে যার মধ্যে গণিত অন্যতম।
এছাড়াও এখানে SAT, AP Chemistry সহ এরকম আরও কিছু বিষয়ের গাইডলাইন রয়েছে। নিজেদের কোর্সের পাশাপাশি অন্যান্য অনেক ইউটিউব চ্যানেলের শিক্ষা বিষয়ক বিভিন্ন কনটেন্টও প্রচার করে থাকে খান একাডেমি।
ভিডিও লেকচারগুলোতে বৈদ্যুতিক বোর্ড ব্যবহার করা হয়। এতে করে শিক্ষার্থীরা সাধারণ ক্লাসের লেকচারের মত করে অনলাইন লেকচারও বুঝতে পারে।
আরও পড়ুনঃ বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল -পৃথিবীতে ব্যাখ্যাতীত ঘটনা ঘটে নাকি পুরোটাই মিথ
খান একাডেমির একটি উল্লেখযোগ্য দিক হল এখানে যেসব বিষয় পড়ানো হয় সেগুলোকে আকর্ষণীয় ভাবে উপস্থাপন করা হয় যাতে শিক্ষার্থীরা আনন্দের সাথে শিখতে পারে।
বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ খান একাডেমি সারা বিশ্বের যেকোন শিক্ষার্থীকে তাদের সেবাসমূহ গ্রহণের সুযোগ দিয়ে থাকে। এখানকার কোর্সগুলোতে মূল বিষয়টি বোঝানোর দিকে লক্ষ্য রাখা হয়।
এতে করে যে কেউ তার প্রয়োজনের বিষয়গুলো জানতে পারে। এছাড়াও বেশ কিছু স্বেচ্ছাসেবক এখানে প্রচারিত লেকচারগুলোকে অফলাইনে উপস্থাপন করে এশিয়ার গ্রামাঞ্চল,ল্যাটিন আমেরিকা সহ আফ্রিকার বেশ কিছু দেশে।
প্রতিটি ভিডিও বেশ কয়েকটি ভাষায় অনুবাদ করা হয়। প্রায় ২০,০০০ সাবটাইটেল রয়েছে একেকটি ভিডিওতে। ইংরেজি, বাংলা, চায়নিজ, পোলিশ, পর্তুগিজ, স্প্যানিশ, তুর্কি সহ আরও ১৪টি ভাষায় সম্পূর্ণভাবে ভিডিওগুলো পাওয়া যায়।
এছাড়া আরও ২৮ টি ভাষায় আংশিকভাবে বিভিন্ন ভিডিও পাওয়া যায়। প্রতিবছর বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের প্রায় ১০০ মিলিয়ন শিক্ষার্থী খান একাডেমিতে পড়াশোনা করে।
খান একাডেমি একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। শিক্ষার্থীরা একাডেমির বিভিন্ন কোর্সে বিনামূল্যে অংশগ্রহণ করে থাকে। এই প্রতিষ্ঠানটি তাদের ব্যয় নির্বাহ করে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ডোনেশন থেকে।
২০১০ সালে গুগল ২ মিলিয়ন ডলার দান করে। বিভিন্ন ভাষায় এর ভিডিওগুলো রূপান্তর করে সেসব দেশ থেকেও ডোনেশন পেয়ে থাকে এই প্রতিষ্ঠান।
খান একাডেমির মোবাইল ভার্সন চালু করার জন্য ২০১৫ সালে AT &T প্রায় ২.২৫ মিলিয়ন ডলার দান করে।
The Bill and Melinda Gates Foundation, Bank of America সহ বিশ্বের আরও বহু প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন সময়ে ডোনেশন দেয়ার মাধ্যমে এর কার্যক্রমকে সচল রাখে।
২০১৪ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর Khan Lab School প্রতিষ্ঠিত হয় যা ক্যালিফোর্নিয়ায় অবস্থিত।
এরপর ২০১৭ সালের জুনে খান একাডেমি আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রকাশ করে Financial Literacy Video Series যা কলেজ গ্র্যাজুয়েট, চাকরি প্রার্থী ও নতুন করে চাকরি প্রাপ্তদের জন্য উপযোগী বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কাজ করে।
সর্বশেষ ২০১৮ সালে Khan Academy Kids নামে একটি মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন তৈরি করা হয়। এখানে মূলত ২ থেকে ৬ বছর বয়সের বাচ্চাদের বিভিন্ন প্রাথমিক বিষয়ে ধারণা দেয়া হয়।
খান একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক সালমান খান। ১৯৭৬ সালের ১১ অক্টোবর আমেরিকায় জন্মগ্রহণ করেন বিশিষ্ট এই শিক্ষাবিদ।
তার বাবা বাংলাদেশের বরিশাল জেলার এবং মা ভারতের মুর্শিদাবাদের সন্তান। সালমান খান যিনি Sal নামে অধিক পরিচিত, Grace King High School এ প্রাথমিক পড়াশোনা করেন।
University of New Orleans এ কিছুদিন পড়াশোনা করলেও স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করেন MIT থেকে। তিনি ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এবং কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করেন।
পাশাপাশি গণিত বিষয়ে আরও একটি স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেন। পরবর্তীতে Harvard University থেকে ব্যবসা শিক্ষায় স্নাতকোত্তর করেন।২০০৪ সালে বিয়ে করেন পাকিস্তানের ফিজিশিয়ান উমাইমা মার্ভিকে।
২০০৩ থেকে ২০০৯ সালের কিছুদিন পর্যন্ত Financial Analyst হিসেবে Connective Capital Management এ কর্মরত ছিলেন। ২০০৮ এ খান একাডেমি প্রতিষ্ঠার পর ২০০৯ সালে চাকরি ছেড়ে দেন তিনি।
শিক্ষাক্ষেত্রে বিভিন্ন মাধ্যমে নানাভাবে অবদান রেখে চলেছেন এই শিক্ষাবিদ। অনলাইন ভিত্তিক আরেকটি জনপ্রিয় মাধ্যম Coursera এর প্রতিষ্ঠার পেছনে তাকে প্রেরণা হিসেবে গণ্য করা হয়।
২০১২ সালে সালমান খান টাইমস ম্যাগাজিনের সেরা ১০০ জন প্রভাবশালী ব্যাক্তি তালিকায় স্থান করে নেন।
অনলাইনে শিক্ষাব্যবস্থা এবং নিজের প্রতিষ্ঠান খান একাডেমি নিয়ে The One World Schoolhouse : Education Re-imagined নামে একটি বইও রচনা করেছেন তিনি।
কেবল বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে ইন্টারনেট ব্যবহার না করে আমাদের উচিত শিক্ষাক্ষেত্রেও এর সেবাসমূহ গ্রহণ করা।
প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার পাশাপাশি সেলফ ডেভেলপমেন্টে সহায়ক আরও কিছু অনলাইন মাধ্যমের সাহায্যে আমরা নিজেদের দক্ষতা বৃদ্ধি করতে পারি যা আমাদের কর্মক্ষেত্রে সহায়ক হবে।
তথ্যসূত্রঃ উইকিপিডিয়া, khanacademy.org
মন্তব্য লিখুন