বাংলাদেশ ৫৬ হাজার বর্গমাইলের একটি কৃষিপ্রধাণ দেশ। বাংলাদেশের কৃষিক্ষেত্রে যেসকল কৃষিবিদ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ভুমিকা রেখেছে, শাইখ সিরাজ তাঁদের মধ্যে অন্যতম।
শাইখ সিরাজ মূলত বাংলাদেশী সাংবাদিক, কৃষি উন্নয়নকারী এবং সুপরিচিত গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব। কৃষি সাংবাদিকতার মাধ্যমে, কৃষি বিষয়ক নানাবিধ অনুষ্ঠান পরিচালনার মাধ্যমে তৃণমূল পর্যায়ে পৌঁছানোর জন্য তিনি নিরলস পরিশ্রম করে গিয়েছেন।
তিনি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের টেলিভিশিন চ্যানেল “বিটিভি” তে “মাটি ও মানুষ” অনুষ্ঠানটির মাধ্যমে সর্বমহলে সুপরিচিত হয়ে উঠেন।
তাঁর নিজস্ব একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেল রয়েছে (চ্যানেল আই) যেখানে তিনি “হৃদয়ে মাটি ও মানুষ” নামক কৃষি বিষয়ক জনপ্রিয় ওকটি অনুষ্ঠান পরিচালনা করে থাকেন।
১৯৫৪ সালের ৭ সেপ্টেম্বর চাঁদপুর জেলায় প্রতিভাবান এই কৃষিবিদ জন্মগ্রজণ করেন। তাঁর পিতার নাম ওবায়দুল হক। খিলগাঁও সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, নটরডেম কলেজ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর শিক্ষাজীবন অতিবাহিত হয়।
পরবর্তীতে ভূগোল বিষয়ে মাস্টার্স সম্পন্ন করে তিনি কৃষি সাংবাদিকতা পেশায় নিয়োজিত হন।
কর্মজীবনে তিনি গণমাধ্যম কর্মী হিসেবে নিজেকে কৃষক নিবেদিত একজন ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিচিতি দিতে উৎসুক বোধ করেন।
তিনি ইমপ্রেস টেলিফিল্ম লিমিটেড চ্যানেল আই এর প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ও বার্তাপ্রধান হিসেবে দায়িত্বরত আছেন।
তাঁর কৃষিবিষয়ক কার্যক্রমের ধারাবাহিকতায় দেশের সব পত্রপত্রিকা ও টেলিভিশনে কৃষিভিত্তিক কার্যক্রমের পরিধি বেড়েছে। তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশন এর মাটি ও মানুষ নামক টিভি প্রোগ্রামের জনপ্রিয় উপস্থাপক ও কৃষি ব্যক্তিত্ব।
উক্ত অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে আধুনিক কৃষি ও বিভিন্ন উন্নত চাষ পদ্ধতি, কৃষি ব্যবস্থাপনা, বেকার ও শিক্ষিত যুবকদের কৃষিকাজে উৎসাহিত করা হতো।
এই অনুষ্ঠান দেখে জৈব সারের উপযুক্ত ব্যবহার,চাষাবাদের অভিনব পদ্ধতি,স্বল্প খরচে কৃষিকাজ সম্পাদনসহ নানাবিধ কৌশল সম্পর্কে তৃণমূল পর্যায়ের কৃষকরা অবগত হতে থাকে।
তিনি ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’ নামক চ্যানেল আইতে সাপ্তাহিক অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করেন। চ্যানেল আইতে জাতীয় সংবাদে প্রতিদিনের কৃষি সংবাদ চালুর মধ্য দিয়ে তিনিই প্রথম দেশের গণমাধ্যমে কৃষিকে প্রাত্যহিক গুরুত্বের মধ্যে নিয়ে আসেন।
এর ধারাবাহিকতায় চ্যানেল আইতে একটি পৃথক ও বিশেষ বুলেটিন আকারে প্রচার শুরু হয় কৃষি সংবাদ।
লেখক হিসেবেও তিনি সুপরিচিত। বহুমেধার অধিকারী এই ব্যক্তিটি কৃষি বিষয়ক অনেক বই লিখেছেন। তাঁর লেখা বইগুলোর মধ্যে অন্যতম-
তাঁর জীবনের প্রথম জাতীয় পর্যায়ের কোনো পুরস্কার হলো একুশে পদক। ১৯৯৫ সালের কোনো এক মাহেন্দ্রক্ষণে তিনি এই মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কারটি লাভ করেন।
এরপর ২০০৯ সালে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি বিষয়ক সংস্থা হতে এএইচ বুর্মা সম্মাননা লাভ করেন।মর্যাদাপূর্ণ এই সম্মাননা লাভের মাধ্যমে তিনি বাইরের দেশেও সুপরিচিত হয়ে উঠেন। বহির্বিশ্বের কাছে তাঁর কৃষি বিষয়ক অভিমতগুলো সমাদৃত হতে থাকে।
শাইখ সিরাজকে আজ পর্যন্ত যত টিভি অনুষ্ঠানে আমরা দেখেছি, প্রতিবারই তিনি একই রকমের এবং একই রং এর শার্ট পড়ে সবার সামনে এসেছেন।এই বিষয়ে শাইখ সিরাজের বক্তব্য হুবহু বর্ণনা করা হলো।
“আমি প্রথম যখন টেলিভিশনে অনুষ্ঠান শুরু করলাম, তখন শহরের ভাষায় কৃষকের সঙ্গে কথা বলতে হতো। যেমন, মাইক্রোফোন এগিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করতাম, ‘আপনি যে চাষ করছেন তাতে লাভ হচ্ছে?’
এই যে শহরের ভাষা, তা কিন্তু একজন সাধারণ কৃষক বোঝে না। সে আমার মতোই শহরের মানুষ হতে গিয়ে তার নিজস্বতা ভুলে যায়। তখন বলতে শুরু করেন, ‘আমি চাষ করেছিলাম, কিন্তু লাভ তো হয় নাই।’ তার মানে, এটা তার মনের কথা না।
এভাবেই তাদের সঙ্গে আমার দূরত্ব বাড়ছে। কিন্তু এই দূরত্ব তো কমিয়ে আনতে হবে। তাই আমি একটা নিজস্ব ভাষা তৈরি করলাম।
তখন আমার প্রশ্নটা এমন হতো, ‘আপনি যে চাষ করছেন, এতে কি লাভ হইছে? নাকি লস হইতেছে?’ এতে চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, ঢাকা, কুষ্টিয়াসহ সব জায়গার মানুষই বুঝতে পারেন।
আরও পড়ুনঃ বাউকুল চাষ করে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হউন
নিজস্ব ভাষা দিয়ে যখন অনুষ্ঠান শুরু করলাম, অনেকেই প্রতিবাদ করলো। বললো, এই ভাষা টেলিভিশনে ব্যবহার উপযোগী না। তখন নাসিরউদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু টেলিভিশনের প্রযোজক ছিলেন; তিনি এবং মোস্তফা মনোয়ার আমার পাশে দাঁড়ালেন।
ভাষা তো মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্যই; আমি তার মতো বললেই তো কৃষক মনের কথা বলবেন। অতএব এটা বিশেষ অনুষ্ঠানে হতে পারে।
আরেকটা কথা হচ্ছে, টেলিভিশন একটা জৌলুসের জায়গা। টেলিভিশন চকচক করতে হবে সবসময়। কিন্তু আমার কাছে মনে হলো যে মানুষগুলোর পেটে খাবার নেই, যার গেঞ্জিটা ছেঁড়া, সে মানুষটির কাছে যদি আমি প্রতিদিন একেক পোশাকে যাই তাহলে কি আমাকে আপন করে নেবে? সে কোনোদিনই আমাকে আপন ভাববে না। তাই ভাবলাম এমন একটি শার্ট পরা দরকার, যেটার দেখলেই তার কাছে আপন মনে হবে।
সবুজ একজন কৃষকের আপন রঙ। যেহেতু আউটডোর অনুষ্ঠান, তাই ফরশাল শার্ট মানাবে না। তাই পাইলট শার্ট পরা শুরু করলাম।
তাই সবাই বলেন, ‘ভাই, আপনার কি একটাই শার্ট?’ প্রথম দিকে কৃষককে বোঝানোর জন্য আমি বেশি কথা বলতাম, এখন কিন্তু তাদেরকেই স্ক্রিনে আসতে দিই বেশি। আমি থাকি নেপথ্যে।
স্ক্রিনে আমার শার্টের শোল্ডার দেখলেও অনেকে বুঝে ফেলেন যে, এটা শাইখ সিরাজ।”
প্রতিভাবান এই কৃষক সম্প্রতি ইউটিউব কর্তৃক গোল্ডেন বাটন এওয়ার্ড পেয়েছেন কৃষি বিষয়ক উপকারী কন্টেন্ট তৈরীর মাধ্যমে তৃণমূল পর্যায়ে পৌঁছে যাওয়ার জন্য।
বাংলাদেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করতে কৃষির অবদান যেতন অনস্বীকার্য,তেমনি বাংলাদেশের কৃষিক্ষেত্রে শাইখ সিরাজের অবদান অকল্পনীয়।
ছবি:সংগৃহীত
তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া, চ্যানেল আই
মন্তব্য লিখুন