একবিংশ শতাব্দীতে এসেও আমাদের দেশে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়টিকে পরিপূর্ণ গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয় না। অথচ মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা সম্পর্কে সচেতন হওয়া অত্যন্ত জরুরি।
আর্টিকেলে যা থাকছেঃ
মানসিক স্বাস্থ্য বলতে মূলত মনের প্রফুল্লতা এবং আত্মিক ও সামাজিক আচরণের স্বতঃস্ফূর্ত বহিঃপ্রকাশ বোঝায়।
মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষিত হলে তা আমাদেরকে মনের অনুভূতি প্রকাশ করা, বিভিন্ন মানসিক চাপের মুহূর্তে নিজেদের সংযত রাখা এবং অন্যের প্রতি আমাদের আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করা শেখায়। প্রতিটি মানুষের জন্য জীবনের প্রতিটি পর্যায়েই মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতার প্রয়োজন রয়েছে।
মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত না হওয়া সে অবস্থাকে নির্দেশ করে যে অবস্থায় আমরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পরি। এ অবস্থায় আমাদের আবেগ অনুভূতির বহিঃপ্রকাশে ব্যাঘাত ঘটে এবং আমাদের আচার আচরণে অস্বাভাবিকতা দেখা দেয়।
আরও বেশকিছু সমস্যা দেখা দিতে পারে। অবসাদ সৃষ্টি, মেজাজের ঘনঘন পরিবর্তন এবং মানসিক চাপের সৃষ্টি হতে পারে। এছাড়াও বিভিন্ন মানসিক ব্যধি যেমন সিজোফ্রেনিয়া, বাইপোলার ডিজঅর্ডার ইত্যাদি দেখা দিতে পারে।
খাদ্যাভ্যাসে অস্বাভাবিক পরিবর্তন কিংবা মানসিক আঘাত থেকে সৃষ্ট কোন রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাও থাকে।
পরিসংখ্যানে জানা যায়, ৫০% মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি হয় ১৪ বছর বয়সে আর ৭৫% সমস্যা হয় ২৪ বছর বয়সে। ৫ থেকে ১৬ বছর বয়সের ১০% মানুষ মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভোগে।
মানসিকভাবে অসুস্থ হওয়ার পেছনে বেশকিছু কারণ থাকতে পারে। দীর্ঘদিন যাবত মানসিক চাপ এবং অবসাদ একসময় ভয়াবহ স্বাস্থ্যহানীর কারণ হয়। অনেক সময় মানসিক অসুস্থতা শারীরিক বিভিন্ন সমস্যাও সৃষ্টি করে।
একাকীত্ব, সম্পর্কে নানা জটিলতা, দুশ্চিন্তা, প্রিয়জনের মৃত্যু, আত্মঘাতী মনোভাব, হতাশা, মাদকদ্রব্যে আসক্তি ইত্যাদি বিভিন্ন কারণ আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যকে ঝুঁকির সম্মুখীন করতে পারে।
মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত না হলে বিভিন্ন অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়। অনেক সময় পরিস্থিতি বেশি খারাপ হয়ে গেলে চিকিৎসা সেবার প্রয়োজন হয়। এক্ষেত্রে মূলত দুই ধরনের চিকিৎসা ব্যবস্থা রয়েছে।
ফারমাকোথেরাপি বলতে সেই চিকিৎসা পদ্ধতিকে বোঝায় যাতে বিভিন্ন ঔষধ ব্যবহার করা হয়। মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্যার চিকিৎসায় সাধারণত Antidepressants, Benzodiazepines, Lithium ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়।
সাইকো থেরাপিতে বিভিন্ন ধরনের মানসিক পরীক্ষা ও প্রশান্তির ব্যবস্থা করা হয়। কয়েকটি উল্লেখযোগ্য থেরাপি হল –
এছাড়াও একই মানসিক অবস্থার একাধিক ব্যক্তিদের একসাধে একই রকম থেরাপির আওতায় রাখা হয় যা গ্রুপ থেরাপি নামে পরিচিত। কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গ্রুপ থেরাপি হল –
মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা যাতে ঝুঁকির সম্মুখীন না হয় সে লক্ষে সকলের উচিত আগে থেকেই সচেতন হওয়া। কিছু অভ্যাস আয়ত্ত্ব করলেই মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করা যায়।
পরিপূর্ণ ঘুমঃ
নিরবচ্ছিন্ন ও পরিপূর্ণ ঘুম আমাদের শারীরিক ও মানসিক উভয় স্বাস্থ্যের জন্য জরুরি। পরিমিত ঘুম আমাদের শরীরের রাসায়নিক পদার্থগুলোকে মস্তিষ্কে প্রেরণ করতে সহায়তা করে যা মানসিক ভারসাম্য বজায়েও ভূমিকা রাখে। এসব রাসায়নিক পদার্থ অবসাদ কমিয়ে আনে এবংমনকে প্রফুল্ল রাখে।
সঠিক খাদ্যাভ্যাসঃ
সঠিক সময়ে সঠিক পরিমাণে খাদ্য গ্রহণ করা শুধু শরীরের জন্যই নয়, মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। সুষম খাবার নিশ্চিত করার ব্যাপারে লক্ষ্য রাখতে হবে।
আরও পড়ুনঃ “ওথেলো সিনড্রোম”- অনিয়ন্ত্রিত এবং প্যাথলজিক্যাল হিংসা
এছাড়াও আয়রন ও ভিটামিন বি ১২ আমাদের মেজাজকে সংযত রাখতে সাহায্য করে। তাই প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় এ-ধরনের খাবার রাখা উচিত। এছাড়া মানসিক চাপে থাকলে ক্যাফেইন পরিহার করা স্বাস্থ্যের পক্ষে উপকারী।
অ্যালকোহল, ধূমপান ও মাদকদ্রব্য গ্রহণ করা যাবেনা। এসব আমাদের শারীরিক ও মানসিক উভয় স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।
প্রতিদিন ৩০ মিনিট থেকে ২ ঘন্টা সূর্যের আলো গ্রহণে অনেকের মানসিক প্রফুল্লতা বজায় থাকে । এছাড়াও সূর্যের আলো শরীরে ভিটামিন ডি কে উদ্দীপিত করতে পারে যা মস্তিষ্কের জন্য উপকারী। অনেকের ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে শীতকালে সূর্যের আলো না পাওয়ায় তারা Seasonal Affective Disorder (SAD) এ ভোগে।
বিভিন্ন কাজকর্মে ব্যস্ত থাকা মনকে শান্ত রাখতে সহায়তা করে থাকে।
ব্যায়াম আমাদের শরীর ও মন উভয়ের জন্য একটি কার্যকর ব্যবস্থা হিসেবে প্রমাণিত। মনকে প্রফুল্ল রাখার পাশাপাশি দীর্ঘায়ু লাভেও ব্যায়ামের ভূমিকা রয়েছে। এছাড়াও যোগ ব্যায়াম মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় বেশ উল্লেখযোগ্য।
যেসকল কাজ আমাদের আনন্দ দেয় সেসকল কাজ বেশি বেশি করার মাধ্যমে মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করা যায়।
সামাজিকতা আমাদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় বেশ গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের সাথে মেলামেশা, কথা বলা ইত্যাদি আমাদের মনের দুশ্চিন্তা ও অবসাদকে দমিয়ে রাখতে পারে।
সামাজিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগদানও মানসিক স্বাস্থ্যের পক্ষে উপকারী। এক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে অন্যের সাথে মাত্র ১০ মিনিট কথা বলা আমাদের স্মৃতিশক্তির জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ ও সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
নিজের মনের অবসাদ ও দুশ্চিন্তার কথা পরিবারের কাউকে জানানো খুবই প্রয়োজন। এতে করে পরিস্থিতি নাগালের বাইতে যাওয়া থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সাধারণ মানুষের মাঝে বেশকিছু ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে। এমনকি বর্তমান সময়েও অনেক মানুষই এই ব্যাপারটিকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করেনা।
পূর্বে বিভিন্ন জাতির মানুষ বিশ্বাস করতো ধর্মীয় শাস্তি ও অতিপ্রাকৃত শক্তির উপস্থিতিতে। প্রাচীন কালে আমেরিকার মানুষরা মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত মানুষদেরকে ধর্মীয় কোন শাস্তি দেয়া হচ্ছে বলে মনে করতো।
গ্রীক, মিশরীয়, রোমান এবং ভারতীয়রা মনে করতো মানসিক সমস্যা মূলত ধর্মীয় কোন ব্যাপার। বিভিন্ন ওঝা বা আধ্যাত্মিক গুরুর সহায়তায় তারা সেসব রোগীদের চিকিৎসা করাতো যা কার্যত কোন ভূমিকা রাখতে পারতো না।
আমাদের দেশে এখনো অনেক মানুষ মানসিক স্বাস্থ্য ব্যাপারটি সম্পর্কে সঠিক ধারণা পায়নি। তারা এখনো পরিপূর্ণ চিকিৎসা সেবার পরিবর্তে ভুল চিকিৎসার আশ্রয় নেয়।
আধুনিক যুগে আমাদের দেশেও বেশকিছু মানুষ মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন হচ্ছে। আশা করা যায় ধীরে ধীরে আমাদের দেশের সকল পর্যায়ের মানুষের মাঝেই এ ব্যাপারে সচেতনতা তৈরি হবে।
বাংলাদেশে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা চিহ্নিতকরণ ও সঠিক চিকিৎসা প্রদানে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। তবে এসকল প্রতিষ্ঠান খুবই সীমিত। ঢাকায় অবস্থিত এরকম কয়েকটি প্রতিষ্ঠান –
দেশের প্রতিটি জেলায় এধরণের স্বাস্থ্যকেন্দ্র তৈরি করতে হবে। কিন্তু সবচেয়ে জরুরি কাজ হল সাধারণ মানুষকে মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে সঠিক শিক্ষা প্রদান করা। প্রতিটি মানুষকে এ ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। কারণ মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা সুস্থ সুন্দর জীবনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। সচেতনতাই পারে মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে।
মন্তব্য লিখুন