মুসলিমদের জন্য পবিত্র হওয়ার ২/৩ টি পন্থা রয়েছে। এর মধ্যে ওযু করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিধান। ওযু করার ক্ষেত্রেও সহিহ বিধান রয়েছে। এর মধ্যে একটি বিধান হলো ওযুতে মুজার উপর মাসেহ করা! এখন কখন কিভাবে ওযুতে মুজার উপর মাসেহ করা যাবে এ নিয়ে ইসলামী স্কলারগণ থেকে ভিন্ন ভিন্ন মত পাওয়া যায়। তবুও উম্মাহর সকল আলিম বা স্কলারগণ একমত যে, ওযুতে মুজার উপর মাসেহ করা যাবে।
আমাদের দেশে ওযু করার ক্ষেত্রে এই আমলটি একেবারেই চোখে না পড়ার মত দৃশ্য। কেননা আমরা এই আমলটি করার ক্ষেত্রে কেমন জানি এক প্রকার সংবেদনশীল। এমনকি শীতের সময় তীব ঠান্ডায়ও পায়ের মুজো খুলে ওযু করছি। কিন্তু পায়ে মুজো থাকায় তা না করাই যে সুন্নাত এটি বুঝতে চাই না। পবিত্র হওয়ার নিয়ম আল্লাহর রাসূল (সা:) আমাদের শিখিয়েছেন। ওযুতে মুজার উপর মাসেহ করা যাবে এটিও তিনিই বলছেন ও শিখিয়েছেন।
তাহলে আমরা কেন তা আমল করব না? সমস্যা মূলত চামরা ও সুতোর মুজো নিয়ে। যে বিষয়ে আলিম বা স্কলারগণ মত পার্থক্য করেছেন। আজ আমরা আলোচ্য এ ছোট্ট প্রবন্ধে তাদের সকল মতামতকে সম্মান জানিয়ে। তাদের মতামতকে ভিত্তি করেই একটি গ্রহনযোগ্য মধ্যমপন্থা তুলে ধারার চেষ্টা করব। ইনশাআল্লাহ।
কখন ওযুতে মুজার উপর মাসেহ করা যাবে?
ওযুতে মুজার উপর মাসেহ করার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোনো মাস বা সময় বা দিন নেই। অনেকেই মনে করতে পারে এটি মনে হয় শীতের সময় করা যাবে, গরম কালে নয়। বরং এই বিধানটি একেবারেই বিশেষ কোনো মাস বা সময়কে কেন্দ্র করে দেওয়া হয়নি। বরং যেকোনো সময়, দিন বা মাস সকল ক্ষেত্রে এটি আমল করা যাবে।
আলহামদুলিল্লাহ। বেশ কয়েক বছর আগেই আমি (“আসান ফেকাহ ১ম খন্ড”- মাওলানা ইউসূফ ইসলাহী) থেকে বিংশ শতাব্দীর অন্যতম ইসলামী স্কলার মাওলানা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদী (রহ.)-এর দেওয়া এ বিষয়ে একটি বিস্তারিত ফতোয়া জেনেছিলাম। তখন থেকে অনেক সময় এই আমলটি আমি করতাম।
কিন্তু বিভিন্ন পরিস্থিতিতে অনেক জায়গায় নামাজ পড়তে গিয়ে এই আমলটি করায় বেশ কিছু ব্যক্তি আমার প্রতি আপত্তি করেছিল। কেননা আমি তখন কাপড়ের মুজা পরিহিত ছিলাম। যদিও পরিহিত মুজা খুব একটা পাতলা ছিল না। মুজা পড়ার পর পায়ের চামড়াও দেখা যেত না।
কিন্তু তাদের আপত্তি থেকে দীর্ঘদিন এই মাসআলাটি নিয়ে আমি মোটামুটি বেশ পড়াশোনা করার চেষ্টা করেছি। তাই এ বিষয়ে বিভিন্ন কিতাব ও অনলাইনে ইসলামী বিভিন্ন সাইটে আলিমদের লেখা আর্টিকেলগুলো খুঁজে খুঁজে পড়ার চেষ্টা করেছি।
সবকিছু থেকে অবশেষে ওযুতে মুজার উপর মাসেহ করা প্রসঙ্গে আমি যেভাবে সমাধান পেয়েছি ও বুঝেছি, সাধারণ পাঠকদের উদ্দেশ্য তা সংক্ষিপ্ত ভাবে এভাবে কয়েকটি পয়েন্টে তুলে ধরতে পারি। যেমন-
একঃ একবার সম্পূর্ণ ভাবে ওযু করার পর অর্থাৎ পবিত্র হয়ে পায়ে মুজা পরিধান করলে, বাড়িতে থাকা অবস্থায় ১ দিন ১ রাত। আর মুসাফির অবস্থায় ৩ দিন ৩ রাত ওযুতে মুজা খুলে পা ধৌত করার কোনো প্রয়োজন নেই। বরং আপনি শুধু পায়ের উপরি অংশে একবার মাসেহ করলেই ওযু সম্পূর্ণ হয়ে যাবে। তবে বিশেষ ক্ষেত্রে আলাদা বিষয়।
দুইঃ মু্জাটি চামড়ার বা কাপড়ের হতে পারে। উভয় ক্ষেত্রেই ওযুতে মুজার উপর মাসেহ করা জায়েজ। তবে কাপড়ের হওয়ার ক্ষেত্রে একটু পুরু হলে ভালো হয়। অর্থাৎ উত্তম। যদিও হাদিসের কিতাবে মুজা মোটা/পাতলা হতে হবে এমন কোনো স্পষ্ট নির্দেশনা নির্দিষ্ট করে দেওয়া নেই।
তিনঃ তবে আমি, ফহিকদের মতামতের আলোকে কাপড়ের মুজার উপর মাসেহ করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ মনে করি যে, এটি পরিধান করলে পায়ের চামড়া যেন না দেখা যায়। অন্তত এতোটুকু পুরু হওয়া উত্তম। যদিও হাদিসে এর কোনো বাধ্যবাধকতা আমি খুঁজে পাইনি। ফকিহগনও এর বাধ্যবাধকতার সুনির্দিষ্ট প্রমান দেয়নি।
চারঃ ওযুতে মুজার উপর মাসেহ করা প্রসঙ্গে ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রহ.) ও শাইখ মুহাম্মদ বিন সালিহ আল-উসাইমিন (রহ.) একই ফতোয়া দিয়েছেন। তাদের মতেও মুজা যাই হোক না কেন সেটি পবিত্র হয়ে পরিধান করলে তাতে মাসেহ করতে কোনো দোষ নেই। উল্লেখ যে, তাঁদের ফতোয়া বা ইজতিহাত আমি সাধারণত বেশি ফলো করার চেষ্টা করি।
পাচঁঃ সাধারণ ভাবে সকল ধরনের জাওরাবের (সুতোর বা পশমের মুজা) উপর মাসাহ বৈধ। এমনকি যদি তা খুব পাতলা হয় তবুও: এটাই ইবনু হাযম ও ইবনু তাইমিয়ার স্পষ্ট মাযহাব। আর এ মতকেই ইবনু উছাইমীন ও আল্লামা শানক্বীতী রহ. পছন্দ করেছেন। ( সহিহ ফিকহুস সুন্নাহ)
এ সম্পর্কে বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বড় ফকিহ শাইখ মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রহঃ) বলেন-
“বিশুদ্ধ মত হচ্ছে, ছেঁড়া মোজা এবং বাইরে থেকে চামড়া দেখা যায় এমন পাতলা মোজার উপর মাসেহ করা জায়েয। যে অঙ্গের উপর মাসেহ হবে তাকে পরিপূর্ণরূপে ঢেকে রাখতে হবে এটা উদ্দেশ্য নয়। কেননা পা তো আর সতর নয়। মাসেহ করার উদ্দেশ্য হচ্ছে ওযুকারী ব্যক্তির উপর সহজতা ও হাল্কা করা। অর্থাৎ- আমরা প্রত্যেক ওযুর সময় মোজা পরিধানকারীকে মোজা খুলে পা ধৌত করতে বাধ্য করব না। বরং বলব, এর উপর মাসেহ করাই আপনার জন্য যথেষ্ট। আর এই সহজতার উদ্দেশ্যেই মোজার উপর মাসেহ শরীয়ত সম্মত করা হয়েছে। অতএব কোন পার্থক্য নেই চাই মোজা ছেঁড়া হোক বা ভাল হোক, পাতলা হোক বা মোটা হোক।” (ফতোয়া আরকানুল ইসলাম)
পরিশেষেঃ
ওযুতে মুজার উপর মাসেহ করা এ বিধানটি মুসলিমদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ আমল এবং এই শীতের সময়ের ওযুর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি সহজ সমাধান। যা মুরব্বিদের জন্য ওযু করাকে আরও সহজ ও কষ্ট মুক্ত করতে পারে। যদিও এ আমল শুধু শীতের সময়ের জন্য নয় এবং নির্দিষ্ট কোনো বয়সের মানুষের জন্যও নয়। বরং প্রয়োজনে সবসময় আমল করা যাবে এবং আমল করা উচিত। এটি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামআতের গুরুত্বপূর্ণ একটি আমলের নিদর্শন। তাই ওযু করার ক্ষেত্রে প্রয়োজনে এই আমলটি আমাদের সবার করা উচিত।
জাযাকাল্লাহ খাইরান