এন্টিবায়োটিক কথাটার সাথে আমরা সকলেই পরিচিত। বাংলা অর্থ হলো “জীবন বিরুদ্ধ”। তবে এদের সমষ্টিগত ভাবে এন্টিবায়োটিক্স বলা হয়, এর কাজ সুদেহী জীবদের ধ্বংস করা। অর্থাৎ মানবদেহের জন্য ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করতে এন্টিবায়োটিক ব্যবহৃত হয়।
তবে সব কিছুরই আছে একটা নিদিষ্ট মাত্রা। তেমনি এন্টিবায়োটিক গ্রহণেরও রয়েছে নিদিষ্ট পরিসীমা। অতিরিক্ত এন্টিবায়োটিক ব্যবহারের ফলে ব্যাকটেরিয়াগুলো তাদের ডিএনএতে পরিবর্তন আনতে সক্ষম হন।
আর এর ফলে ব্যাকটেরিয়া গুলো এন্টিবায়োটিক প্রতিরোধী সুপারবাগে পরিনত হয়।আর আমাদের জীবনের জন্য হয়ে দাঁড়ায় মারাত্মক হুমকি স্বরুপ।
বিশ্বে যে হারে নতুন এন্টিবায়োটিক তৈরি করা হচ্ছে, এর চেয়ে কয়েকগুন বেশি হারে বাড়ছে এন্টিবায়োটিকের রেসিস্ট্যান্স। একটি এন্টিবায়োটিক আবিষ্কার করতে সময় লাগে ১৫বছর, এর বিপরীতে ব্যাকটেরিয়া রেসিস্ট্যান্স হতে সময় লাগে মাত্র এক বছর।
২০১৫ সালে ইউরোপিয়ান জার্নাল অব সায়েন্টিফিক রিসার্চে প্রকাশিত এক সমীক্ষার তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের এক তৃতীয়াংশের বেশী রোগীকে কোন ধরণের যথাযথ কর্তৃপক্ষেরর অনুমোদন ছাড়াই এন্টিবায়োটিক দেয়া হয়।
সম্প্রতি ব্রিটেনের দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনের ভিত্তিতে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়েরর ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা.সায়েদুর রহমান বলেছেন ২০১৮ সালে বিএসএমএমইউর আইসিইউতে ভর্তি হয়েছিল ৯০০ জন রোগী।
যার ৪০০ জনই পরে মারা গেছেন। যারা মারা গেছেন তাদের ৮০ শতাংশেরই ব্যাকটেরিয়া বা ছত্রাকজনিত সংক্রমন ছিল। এসব সংক্রমন ছিল এন্টিবায়োটিকের প্রতিরোধী।
টেলিগ্রাফের প্রতিবেদনে আরো বলা হয় বাংলাদেশে হাসপাতালে আইসিইউ গুলোতে ৮০ শতাংশ মৃত্যুর কারণ হতে পারে এন্টিবায়োটিকের প্রতিরোধী হয়ে ওঠা অনুজীব বা সুপাররবাগ।
বাংলাদেশের সম্প্রতি রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রন ও গবেষবা প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআরের এক গবেষনায় দেখা গেছে, দেশে প্রচলিত এন্টিবায়োটিকের মধ্যে অন্তত ১৭টির কার্যক্ষমতা অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে।
আইইডিসিআরের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের প্রধান ডা.জাকির হোসাইন হাবিব দেশের ৯টি মেডিকেল কলেজের রোগীদের ওপর গবেষনা চালিয়েছেন। ডা. হাবিব জানিয়েছেন, “গবেষনায় দেখা গেছে জীবানুর প্রায় ৫৭ শতাংশ সক্রিয় ছিল অর্থাৎ এগুলো প্রচলিত ঔষধ দিয়ে সারানো সম্ভব হচ্ছিল না”।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের পরিচালক অধ্যাপক সানিয়া তাহমিনা বলেন, বাংলাদেশে এন্টিবায়োটিক ঔষধ বিক্রির ক্ষেত্রে কোন নীতিমালা নেই। কিছু নির্দেশনা থাকলেও সেগুলো ক্রেতা বা বিক্রেতা কেউই মানে না।
অধ্যাপক তাহমিনা আরও বলেলেছেন আরেকটি ঝুঁকি হচ্ছে মানুষের সঙ্গে সঙ্গে প্রানীর উপরেও এন্টিবায়োটিক ব্যবহার হয়। যা কখনোই পুরোপুরি বিলীন হয় না। মাটিতে রয়ে যায়।
এর ফলে আমরা যা খাই সবজি ফল, মাছ, মাংস ও দুদ্ধজাতীয় খাবারের মধ্যে থেকে যাওয়া এন্টিবায়োটিকের কারণে আমাদের শরীরে এন্টিবায়োটিকের রেজিস্টান্ট হয়ে থাকে।
আইইডিসিআরের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের প্রধান ডা.জাকির হোসাইন হাবিব জানিয়েছেন পরিস্থিতি যথেষ্টে ভয়াবহ। কারণ বাংলাদেশের বহু মানুষ বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষ চিকিৎসকের কাছে না গিয়ে ফার্মেসীতে গিয়ে এন্টিবায়োটিক কিনে সেবন করে।
তাদের ধারণাই নাই যে এর ফলে তার শরীরে এন্টিবায়োটিকের রেজিস্টান্ট হয়ে যাচ্ছে এবং পরবর্তীতে কোন সংক্রমন হলে সেটা আর কোন ঔষধে সারানো সম্ভব না।
১. বিনা প্রেসক্রিপশনে ঘনঘন এন্টিবায়োটিক সেবন করলে পরবর্তীতে শরীরে কোন এন্টিবায়োটিকর আর কাজ করে না।
২. প্রয়োজনের তুলনায় স্বল্প ডোজের এন্টিবায়োটিক দেয়া হলে এন্টিবায়োটিক শরীরে কাজ করে না।
৩. ভাইরাসজনিত কোন অসুখে অর্থাৎ যেসব ক্ষেত্রে একটি নিদিষ্ট সময় পরে এমনি সেরে যেত সেসব ক্ষেত্রে এন্টিবায়োটিকটি গ্রহণ করলে।
৪. কোর্সপূরণ করে এন্টিবায়োটিক না খেলে এন্টিয়োটিকটি শরীরে কাজ করে না।
আমাদের কারো জ্বর হয়েছে যদি আমরা তখন ডাক্তারেরর পরামর্শ ছাড়া ঔষধ খাই আর পরবর্তীতে যদি জ্বর না কমে এবং আমরা ডাক্তারের কাছে যাই তখন ডাক্তার কোন পরীক্ষা দিলে তার মাধ্যমে সঠিক রোগ নির্নয় করা সম্ভব হয় না।
তাই আমাদের প্রেসক্রিপশন ছাড়া ঔষধ কিনার ব্যপারে সচেতন হতে হবে। রোগীর লিভার বা কিডনিতে কোন সমস্যা থাকলে সে সব দিক বিবেচনা করে ডাক্তার ঔষধ দেন। কিন্তু সাধারণ মানুষের পক্ষে এসব জানা সম্ভব না।
তাছাড়া আমাদের দেশে যতগুলো লাইসেন্সধারী ফার্মেসী আছে ঠিক ততগুলাই লাইসেন্সবিহীন ফার্মেসী আছে। আর তারা অধিক মুনাফার জন্য প্রেসক্রিপশন ছাড়া ঔষধ বিক্রি করে। তাই সবদিক বিবেচনা করে নিজেদের সচেতন হওয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই। না হলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন হবে।
ছবিঃ সংগৃহীত
তথ্য সহায়তায়ঃ দ্য ডেইলি স্টার, ভোরের কাগজ পত্রিকা, BBC NEWs, উইকিপিডিয়া
মন্তব্য লিখুন