পৃথিবী সম্পর্কিত বর্ণনা, আলোচনার সামগ্রিক যে শিক্ষা, তাই সর্বমহলে ভূগোল শিক্ষা হিসেবে সুপরিচিত। ভূগোল হচ্ছে বিজ্ঞানের সেই শাখা যেখানে পৃথিবীর ভূমি, এর গঠন বিন্যাস ও অধিবাসী সংক্রান্ত বিষয়াদি বিস্তৃত পরিসরে আলোচিত হয়। ভূগোল পৃথিবী ও মানবসত্ত্বার মধ্যে যুগ যুগ ধরে চলে আসা আন্তঃক্রিয়ার কথা বলে।
ভূগোল শিক্ষার চেতনার মাধ্যমে মানব সম্প্রদায় মানসিক চেতনার উন্মেষ ঘটানোর পাশাপাশি জীবনযাত্রা ও মানোন্নয়নের সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে।
ভূগোল যাদের একাডেমিক পঠিতব্য বিষয়, তাঁদের অনেকের কাছেই আতঙ্কের একটি নাম। ভবিষ্যত জীবনে এই শিক্ষার প্রভাব এবং সুফল নিয়ে তাঁরা অবহিত নয়। বাস্তব জীবনেও যে এর প্রয়োগ ঘটানো সম্ভব, সেই বিষয়েও অনেকে অবগত নয়।
এছাড়া বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষায় তো ভূগোলের সম্পর্কে সাধারণ প্রশ্ন আসেই। চলুন, আজকে ভূগোলের অলিতে গলিতে পদচারণা করা যাক।
আর্টিকেলে যা থাকছেঃ
প্রাচীন গ্রিক পণ্ডিত এরাটোসথেনিস পৃথিবী সম্পৃক্ত বর্ণনা বোঝাতে সর্বপ্রথম “Geography” শব্দটির ব্যবহার করেন। Geography এর Geo অর্থ পৃথিবী এবং graphos অর্থ বিবরণ। অর্থাৎ, Geography শব্দটির সার্বিক অর্থ হলো পৃথিবীর বর্ণনা ।
বাংলা ভাষায় প্রাচীন হিন্দু পুরাণে ব্যবহৃত ভূগোল শব্দটি ‘জিওগ্রাফি’ শব্দের প্রতিশব্দ হিসেবে গৃহীত হয়েছে। যদিও ভূগোল শব্দটি ‘জিওগ্রাফি’ শব্দের সঠিক ভাব প্রকাশ করে না। এ ছাড়া বর্তমান জিওগ্রাফির সংজ্ঞা অনুসারে “ভূগোল” শব্দটি দিয়ে Geography শব্দটিকে ধারণ করা যায় না।
বাংলা একাডেমির ইংরেজি-বাংলা অভিধানে (তৃতীয় সংস্করণ, ২০১৫) জিওগ্রাফির প্রতিশব্দ হিসেবে ‘ভূগোলবিদ্যা’ বা ‘ভূবিজ্ঞান’ ব্যবহৃত হয়েছে। ‘ভূগোল’ নয়। এ কারণে বাংলাভাষা সচেতন অনেক ভূগোলবিদ জিওগ্রাফির প্রতিশব্দ হিসেবে ‘ভূবিদ্যা’ শব্দটির ব্যবহারে অধিক আগ্রহী।
ভূগোল শিক্ষায় দুইটি শাখা রয়েছে।
এদের উপশাখাগুলোকে দাড় করালে মোট ১৪৮ টির মত উপশাখা পেয়ে যাবেন।
এই শাখা পৃথিবীর গঠনপ্রকৃতি থেকে জীবজগৎ এবং এদের মধ্যেকার আন্তঃসম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করে থাকে। এটি ভূমিবিদ্যা বা ভূবিদ্যা নামেও সুপরিচিত।
গুগল ম্যাপ থেকে শুরু করে কাগজের মানচিত্র, কিংবা কয়লার খনি থেকে নভোযান, বৃষ্টিপাত থেকে নক্ষত্রপতন সর্বত্র প্রাকৃতিক ভূগোল।
সমাজ বিজ্ঞানের বিস্তৃত একটি শাখা মানবীয় ভূগোল যা পৃথিবী এবং তার অভিবাসীদের বসবাসের স্থান থেকে শুরু করে সংস্কৃতির সম্পৃর্ক্ততা – প্রতিটি বিষয় নিয়ে নিবিড় আলোচনা করে।
প্রাকৃতিক ভূগোল সম্পর্কে বলা যায়, এতে অশ্মমণ্ডল, বারিমণ্ডল, বায়ুমণ্ডল ও জীবমণ্ডল- এই চারটি মণ্ডলের উপাদানগুলোর বৈশিষ্ট্য বিস্তারিতভাবে ও গুরুত্বের সাথে আলোচনা করা হয়।
উল্লেখিত চারটি উপাদান সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা লাভের জন্য পৃথিবীর উৎপত্তি, বয়স, ভূঅভ্যন্তরের শিলা স্তরেরর গঠন ইত্যাদি বৈশিষ্ট্যসমূহ নিবিড়ভাবে পর্যালোচনা করা হয়।
পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ শক্তির দ্বারা ভূপৃষ্ঠে বিভিন্ন ধরনের উঁচুনিচু ভূমিরূপের সৃষ্টি ঘটে। পক্ষান্তরে, বায়ুমণ্ডল থেকে সৃষ্ট বহিস্থ শক্তি ভূপৃষ্ঠের উঁচু স্থানগুলোকে সমুদ্র সমতলে নামিয়ে আনার কাজে সর্বদা ব্যস্ত থাকে।
আগ্নেয়গিরি থেকে অগ্নুৎপাত, ভূপৃষ্ঠে এদের বণ্টন এবং অগ্ন্যুঃপাতের ফলে সৃষ্টি হওয়া বিপর্যয় যা উদ্ভিদ ও প্রাণীর ওপর প্রভাববিস্তার করে সে সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়। অতিকায় ডাইনোসরের বিলুপ্তি জীববিজ্ঞান আলোচনা করলেও ভূগোলে এদের বিপর্যয়ের প্রাকৃতিক কারণ বিশদভাবে বর্ণনা করা হয়।
বহিস্থ শক্তির দ্বারা সৃষ্ট ভূপৃষ্ঠের অবয়বগুলোর পর্যালোচনার মাধ্যমে ভূমিরূপ পদ্ধতি এবং এর কাজের ধরন সম্পর্কে জানা যায়।
সমুদ্রের পানির তাপমাত্রা ও লবণাক্ততা, সমুদ্রের অভ্যন্তরীণ সঞ্চয়, জোয়ার-ভাটা, মরা কটাল- ভরা কটাল, সমুদ্র স্রোতের গতিপ্রকৃতি, কোরাল রিফ ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে ভূগোল শিক্ষায়।
বায়ুমণ্ডলীয় উপাদানগুলোর পর্যালোচনায় আসা যাক এবার। বায়ুমণ্ডলের সংমিশ্রণ, গঠন উপাদান, জলবায়ু ও আবহাওয়ার নিয়ামক, তাপসমতা, ভূপৃষ্ঠের তাপ বিকিরণ পদ্ধতি, বায়ু চাপ পরিমাপ, বায়ুপ্রবাহ, বর্ষণ, ঘূর্ণিঝড়, জলবায়ু পরিবর্তন, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, মৃত্তিকা ক্ষয়, পরিবেশ দূষণ, দুর্যোগ ও বিপর্যয় ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে বায়ুমন্ডলীয় উপাদানের মধ্যে।
ভূগোলের পরিধি কার্যত বিস্তৃত এবং প্রয়োগমূলক। মানুষ তার পরিপার্শ্বের সঙ্গে কিভাবে খাপ খাইয়ে নিজস্ব পরিবেশকে কাজে লাগাচ্ছে এবং ফলপ্রসূ হচ্ছে তাই মানব ভূগোল আলোচোনার মূল বিষয়।
মানবীয় ভূগোল বলে, পৃথিবীতে মানুষ হলো অন্যতম ভৌগোলিক নিয়ামক। এর কারণ, মানুষ পরিবেশের মধ্যে বসবাস করে। মানুষ তার নিজের প্রয়োজনে ভূদৃশ্যের পরিবর্ধন ও পরিমার্জন সাধন করে থাকে।তাই, মানব ভূগোলের অন্যতম আলোচ্য বিষয় হলো মানুষ।
মানুষের নির্মাণ করা সংস্কৃতি পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিক সম্পর্কের বর্ণনা এবং ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে থাকে। মানব ভূগোলে সাংস্কৃতিক বিষয়য়াবলী চারটি যৌগিক চিন্তার সমন্বয়ে গঠিত। সাংস্কৃতিক আলোচনায় মানুষ হলো কেন্দ্রীয় চরিত্র।
নৃবিজ্ঞান (Antropology) বিষয় সংশ্লিষ্ট নৃগোষ্ঠীর পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া, গঠন-বিন্যাস, সমাজবিজ্ঞানের মৌলিক সারকথা নিয়েও ভূগোল আলোচনা করে।
মোট কথা, মানুষের সংস্কৃতি বিষয়ক যেমন- নৃতত্ত্ব, জাতিতত্ত্ব, ভাষাতত্ত্ব, প্রত্নতত্ত্ব, জীবাশ্ম ইত্যাদি যাবতীয় বিষয়াবলী মানব ভূগোলের বিষয়বস্তুর অন্তর্গত।
এত এত ভূগোল-বিন্যাসের মধ্যে যারা তাঁদের জীবনের বড় একটা সময় ভৌগলিক বিদ্যায় নিজেদের প্রাণোৎসর্গ করেছেন, সেই সকল মহৎ ব্যক্তিদের কথা অবশ্যই উল্লেখ্য।
যুক্তিবাদী, অনুসন্ধানী ও অন্বেষী মনোভাবের বিকাশে এই শিক্ষার গুরুত্ব নেই। বিভিন্ন ঘটনার সংঘটনের সাথে পার্থিব শক্তিসমূহের প্রভাব নিয়ে বিশুদ্ধ ধারণা সভ্যতার বিকাশে অতীব গুরুত্বপূর্ণ।
প্রাকৃতিক সম্পদের যৌক্তিক অবস্থান, দিন রাত কেনো হয়, জোয়ার ভাটা কেনো হয় এসব মৌলিক ভূগোল শিক্ষা বিষয়ে সম্যক ধারণা বৈশ্বিক নাগরিক হিসেবে সবার জানা থাকা আবশ্যক।
শুধুমাত্র ভৌগলিক উৎকর্ষের সাধন সম্পর্কে জানাই যে, ভূগোল শিক্ষার উদ্দ্যেশ্য নয়, আশা করি এই লেখনীর মাধ্যমে আমরা সে বিষয়ে ধারণা লাভ করতে পারি। আসুন আমরা বিশ্বকে জানি, বিশ্বের ভূ-প্রাকৃতিক অবস্থার সাথে অতীত সময়ে মানুষের আন্তঃক্রিয়াকে জানি এবং বাস্তবজীবনে ভূগোলকে ব্যবহার করি।
তথ্য সহায়তায়: Wikipedia, দৈনিক কালের কন্ঠ
মন্তব্য লিখুন