বীমার উৎপত্তি ও ক্রমবকিাশ সম্পর্কে বলতে গেলে প্রথমেই বলতে হয় বিশ্বে যখন ব্যাংক ব্যবস্থার কল্পনাও কেউ করেনি, তার বহুকাল পূর্ব হতে বীমা ব্যবস্থা চালু ছিল। বিশ্বে সর্বপ্রথম ব্যাংক ব্যবস্থার প্রবর্তন হয় খ্রীষ্টিয় ৭ম শতাব্দীতে ইতালীর রোম শহরে। ইহুদী ব্যবসায়ী ও মহাজনগণ যৌথ উদ্যোগে ব্যাংক ব্যবস্থার প্রবর্তন করে। খ্রীষ্টিয় ৪০০ সাল হতে ১৪০০ সাল পর্যন্ত সময়কালকে ব্যাংক ব্যবস্থার মধ্যযুগ বলা হয়।
১১৫৭ সালে ভ্যানিস সরকারের প্রচেষ্টায় “ব্যাংক অব ভ্যানিস” প্রতিষ্ঠা হয়, যা বিশ্বের প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাংক হিসেবে ইতিহাসে স্থান করে নেয়। আর বীমার অনুরূপ পদ্ধতির উৎপত্তি হয় ৪০০০ বছর আগে ব্যববিলনে। বিস্তারিত জানতে গেলে প্রথমে জানতে হবে বীমা কি এবং এর প্রয়োজনীয়তা কি ?
আর্টিকেলে যা থাকছেঃ
আদিমকাল হতে মানুষ নানা ধরনের প্রাকৃতিক দূর্যোগজনিত ঝুঁকি এবং খাদ্যপ্রাপ্তির অনিশ্চয়তার সাথে মোকাবেলা করে আসছে। মানবজীবনের প্রতিটি মুহূর্ত্ই ঝুঁকিপূর্ণ। ঝুঁকি ছাড়া মানুষের জীবনের কথা ভাবা্ই যায় না। আর ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তা আছে বলেই মানুষ তা জয় করার জন্য প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখে। যার ফলে মানুষের মধ্যে প্রতিযোগিতার মনোভাব গড়ে উঠেছে।
কিন্তু বিপদসঙ্কুল এ্ই ছোট্ট গ্রহে নানাধরণের প্রতিকূলতার বিরূদ্ধে সংগ্রাম করে কখনো সে জয়ী হয়, আবার কখনো হয় পরাজিত। পরাজিত হওয়ার পর থেমে যায় তার চলার গতি। মানুষের চলার গতিকে সচল রেখে সামনের পথ মসৃণ রাখার জন্য ঝুঁকিকে ভাগাভাগি করে নিতে এগিয়ে এসেছে একটি বিশেষ দল, যারা বীমা কোম্পানী নামে পরিচিত। বীমা মানুষের চলার পথ সুগম রাখার নিশ্চয়তা প্রদান করে।
চার হাজার বছর আগে বিশ্বের বাণিজ্যিক কেন্দ্র ছিল ব্যাবিলন। বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে ব্যবসায়ীরা কাফেলা করে ব্যাবিলনে আসার সময় দস্যুদের দ্বারা লুন্ঠনের শিকার হতো। অনেক সময় দস্যুরা অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করতো। ফলে আক্রান্ত ব্যবসায়ী কাফেলা নিঃস্ব হয়ে যেতো। সেক্ষেত্রে কাফেলা ব্যবসায়ীদের ঋণদাতা পূঁজিপতিরা তাদের প্রদত্ত ঋণ মওকুফ করে দিতো।
পরবর্তীতে ব্যবিলনের তৎকালিন রাজা হাম্মুরাবি একটু ভিন্ন আঙ্গিকে ক্ষতিপূরণের স্থায়ী একটি ব্যবস্থার প্রচলন করেন। তা হলো, দস্যুদের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্থ ব্যবসায়দের ক্ষতি অন্য সকল কাফেলাকে ভাগাভাগি করে বহণ করতে হবে। স্থল পরিবহনে বিপদ ভাগাভাগির এটিই প্রথম উদাহরণ।
খৃষ্টপূর্ব ৬০০ বছর আগে হিন্দু বণিকেরা ঋণ চুক্তির মাধ্যমে বীমা চিন্তার বিকাশ ঘটায়। এই ধরণের ঋণ চুক্তি মধ্যযুগে বিকশিত হয় এবং সামুদ্রিক ঋণ ও নৌবীমার ভিত্তি তৈরী করে। পরবর্র্তীতে কার্থাগিনিয়ান, রোমান ও গ্রীক পূঁজিপতিরা পানিপথে বহনযোগ্য পণ্যসামগ্রী মূল্য ধার দিয়ে ঝেুঁকি বহন করতো এবং নিরাপদে পৌঁছে যাওয়ার পরে উচ্চহারে সুদসহ আসল আদায় করতো। এই প্রক্রিয়া গির্জার নিষেধাজ্ঞায় পরিবর্তন হয়ে পরবর্তীতে র্অগ্রিম প্রিমিয়ামের জন্ম দেয় এবং ক্রমান্বয়ে বীমার রূপ লাভ করে।
১২৫০ খৃষ্টাব্দের দিকে ভ্যানিস, ফ্লোরেন্স ও জেনোয়া শহরে প্রিমিয়াম ভিত্তিক বীমার উৎপত্তি হয়। নৌ বীমার সর্বপ্রথম উৎপত্তি হয় ইতালীর জেনোয়া শহরে। প্রথম চুক্তিটি হয়েছিল ২৩ অক্টোবর ১৩৪৭ সনে।
প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক বীমা কোম্পানী ১৪২৪ সনে জেনোয়ায়। বীমা সংক্রান্ত প্রথম আইনী নীতিমালা প্রকাশিত হয় ১৪৩৫ সনে, যা “বার্সেলোনা এডিক্ট” নামে খ্যাত।
০২ সেপ্টেম্বর ১৬৬৬, লন্ডনে সংঘটিত হয় বিশাল অগ্নিকান্ড, যা চারদিন স্থায়ী ছিল। এ্ই অগ্নিকান্ডে ১৩০০০ ঘর ও ১০০ টি গীর্জা পুড়ে ভষ্ম হয়ে গিয়েছিল্, যার ফলে অগ্নিবীমার জন্ম হয়েছিল। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে বীমা কোম্পানীগুলো এমন একটি স্তরে পৌঁছেছে, যা সব ধরনের বীমার চাহিদা পূরণের জন্য কার্যকর ভূমিকা নিতে সক্ষম।
বীমা হচ্ছে দু্ই বা ততোধিক পক্ষের মধ্যে সম্পাদিত একটি চুক্তি, যার মাধ্যমে এক বা একাধিক পক্ষ বীমাকারীর নিকট নির্দিষ্ট পরিমাণ চাঁদা বা প্রিমিয়ামের বিনিময়ে সম্পূর্ণ বা আংশিক ক্ষতিপূরণ দিতে সম্মত হয় এবং বীমাচুক্তিপত্রে উল্লেখিত নির্দিষ্ট কারণে বীমাগ্রহীতা ক্ষতিগ্রস্থ হলে বীমাকারী চুক্তির শর্তানুযায়ী বীমাগ্রহীতা বা তার প্রতিনিধিকে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ প্রদানের নিশ্চয়তা দেয়।
এম.কে.ঘোষ এবং এ.এন আগরওয়ালা বলেন, “বীমা হচ্ছে এমন এক যৌথ সমবায় ব্যবস্থা, যার মাধ্যমে নির্দিষ্ট পরিমান ঝুঁকি সংশ্লিষ্ট পক্ষগণের মধ্যে বন্টন করা হয়।”
বীমা বিশারদ পোর্টালের মতে, “মানুষের জীবন ও তার কার্যাবলী বিভিন্ন প্রকার বিপদাপদে বেষ্টিত। এসব অজানা বিপদাপদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার ব্যবস্থা্ই হচ্ছে বীমা।”
এক কথায় বলা যায়, বীমা হচ্ছে এক ধরণের যৌথ ব্যবস্থা, যার দ্বারা সম্ভাব্য ক্ষতিগ্রস্থ ব্যক্তিদের মধ্যে ঝুঁকি বন্টনের সুযোগ সৃষ্টি হয়।
বীমা সাধারনত ২ (দুই) প্রকার- (১) জীবন বীমা ও (২) সাধারন বীমা।
এই ধরনের বীমার মূল বিষয়বস্তুই হলো একজন মানুষের জীবনকে অর্থের বিনিময়ে সুরক্ষিত করা। জীবন বীমার মাধ্যমে পলিসি হোল্ডারের যে কোন দূর্ঘটনায় অঙ্গহানি বা মৃত্যুতে বা মেয়াদান্তে বীমার নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ তার মনোনিত ব্যক্তিকে দেয়া হয়। এই ধরনের বীমা পলিসি হোল্ডারের অকাল মৃত্যুতে তার পরিবারকে সুরক্ষা প্রদান করে। কিংবা বৃদ্ধ বয়সে যখন উপার্জন বন্ধ হয়ে যায়, তখন আর্থিক সহযোগিতা পাওয়া যায়।
বর্তমানে জীবন বীমা জনপ্রিয় একটি সুরক্ষা ব্যবস্থা কারণ জীবন হলো যে কোন মানুষের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পত্তি। বাংলাদেশে মোট ৭৯ টি বীমা প্রতিষ্ঠান রয়েছে, তন্মধ্যে ৪৬ টি সাধারন বীমা ও ৩৩ টি জীবন বীমা। ৩৩ টি জীবন বীমার মধ্যে একটি মাত্র সরকারী, যা “জীবন বীমা কর্পোরেশ” নামে প্রতিষ্ঠিত। বাকী ৩২ টি বেসরকারী জীবন বীমা কোম্পানী।
১৯৭১ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ৭৫টি বীমা কোম্পানী ছিল, তারমধ্যে ১০টি স্থানীয়ভাবে নিবন্ধিত। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতির ৯৫নং আদেশ বলে বাংলাদেশের সকল জীবন ও সাধারন বীমা কোম্পানী জাতীয়করন করা হয়্। এ্ই জাতীয়করনের দ্বারা অধিকৃত কোম্পানীগুলো বিলুপ্ত করে ৫টি কোম্পানী গঠন করা হয়।
বাংলাদেশ জাতীয় বীমা কর্পোরেশন, তিস্তা বীমা কর্পোরেশন, কর্ণফুলী বীমা কর্পোরেশন, সুরমা জীবন বীমা কর্পোরেশন এবং রূপসা জীবন বীমা কর্পোরেশন। ১৯৭৩ সালের ১৪ মে রাষ্ট্রপতির আদেশবলে সুরমা ও রূপসা জীবন বীমা কর্পোরেশনকে একত্রিত করে “জীবন বীমা কর্পোরেশন” নামে প্রতিষ্ঠিত করা হয়। এছাড়া বেসরকারী পর্যায়ে এযাৎ ৩২ টি জীবন বীমা কোম্পানী প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
বাংলাদেশের একমাত্র রাষ্ট্রীয় খাতের সাধারন বীমা হলো “সাধারন বীমা কর্পোরেশন”, যা ১৯৭৩ সালের ১৪ মে বীমা কর্পোরেশন আইনের অধিনে গঠিত হয়। সরকারী এই বীমা সংস্থাটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত একমাত্র সাধারন বা নন লা্ইফ ইস্যুরেন্স ব্যবসা পরিচালনা করে আসছিল।
বাংলাদেশের বীমা বাজারের প্রায় ২০ শতাংশ এই প্রতিষ্ঠানটির দখলে। বাংলাদেশের বীমা ব্যবসার ৫০% নিয়ে এটি কাজ করে। বীমা কর্পোরেশন আইন ১৯৯০ অনুসারে দেশের সরকারী সম্পত্তির ঝুঁকি হস্তান্তর সাধারন বীমা কর্পোরেশনে করা বাধ্যতামূলক।
বর্তমানে দেশে মোট ৪৬ টি সাধারন বীমার মধ্যে একমাত্র সরকারী সাধারন বীমা হলো “সাধারন বীমা কর্পোরেশন”। বাকী ৪৫ টি বেসরকারী খাতের বীমা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। বেসরকারী খাতের ৪৫ টি বীমা কোম্পানীকে বাধ্যতামূলকভাবে সাধারন বীমা কর্পোরেশনে পূণঃবীমা বা রি-ইনউ্যরেন্স করতে হয়।
এতে বেসরকারী খাতের বীমা কোম্পানীগুলোকে কমপক্ষে ৫০% প্রিমিয়াম সাধারন বীমা কর্পোরেশনে জমা দিয়ে পূণঃবীমা করতে হয়। আর সাধারন বীমা কর্পোরেশন বড় বড় ঝুঁকি গ্রহনের ক্ষেত্রে দেশের বাহিরে আন্তর্জাতিক বৃহৎ বীমা কোম্পানীগুলোতে রি-ইন্স্যরেন্স অব রি-ইন্স্যরেন্স করে। সেক্ষেত্রে সাধারন বীমা কর্পোরেশনকেও প্রিমিয়ামের বৃহৎ অংশ দেশের বাহিরের মেগা বীমা প্রতিষ্ঠানে পাঠাতে হয়।
সাধারন বীমার আওতায় যেসকল ঝুঁকিসমূহ গ্রহণ করা যায়, সেগুলো হলো- অগ্নিবীমা, নৌবীমা, মোটরযান বীমা, বন্যা/ঝড়/ভূমিকম্প প্রভৃতি প্রাকৃতিক দূর্যোগের ঝুঁকি গ্রহন বীমা, দূর্ঘটনাজনিত বীমা, তৃতীয় পক্ষ বীমা, স্বাস্থ্য বীমা, ভ্রমন বীমা, শস্য বীমা, বিবিধ বীমা ইত্যাদি।
বীমা একটি মহৎ ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠান, যারা অন্যের ঝুঁকি নির্দিধায় বহণ করে। কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নিজের ঝুঁকি নিজেই বহণ করতে অসমর্থ হয়, অথচ বীমা ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ঝুঁকি বহণে পিছপা হয়না। কিন্তু, এই মহৎ শিল্পটি মাঝে রুগ্ন শিল্পে পরিণত হয়েছিল।
বীমা পেশার সাথে সংশ্লিষ্ট এবং বীমা গ্রহীতার মধ্যে কিছু অসৎ ব্যক্তির কারণে বীমা শিল্প মুখ থুবড়ে পরেছিলো। অতঃপর উক্ত প্রতিষ্ঠানে শৃঙ্খলা আনয়ন, নিয়ন্ত্রন ও উন্নয়নের লক্ষে্ সরকার ২০১১ সালের ২৬শে জানুয়ারী বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১০ এর অধীনে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ IDRA (Insurance Development Regulatory Authority) গঠন করে।
ইড্রা বেসরকারী খাতের বীমা কোম্পানীগুলোর নিয়ন্ত্রণ ও তত্ত্ববধান এবং বীমা গ্রহীতাদের স্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্যে গঠিত হয়েছে। পর্যায়ক্রমে ২০১৯ ও ২০২১ সালে ইড্রা ২০১০ এর বীমা নীতির সংশোধন করে। দেশের বীমা খাতকে কল্যাণমুখী ও লাভজনক করার প্রয়াস অব্যাহত রেখে ইড্রা তার কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। তবে একথা অনস্বীকার্য যে, ইড্রার একার পক্ষে লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন দেশের বিশাল জনগোষ্ঠীকে বীমা সম্পর্কে নূনতম জ্ঞান আহোরণ ও সচেতন করে তোলা।
এছাড়া বীমাকারী প্রতিষ্ঠান ও বীমা গ্রহীতাকে অবশ্যই বীমা আইন মেনে চলতে হবে, এর কোন বিকল্প নেই। নয়তো অন্যের ঝুঁকি বহণ করা দূরে থাক নিজের ঝুঁকি বহণ করাও এদেশের বীমা শিল্পের পক্ষে দুঃসাধ্য হয়ে পরবে।
তথ্যসূত্রঃ
মন্তব্য লিখুন