‘হ্রদ’ আর ‘দ্বীপ’ এর দেশ ফিনল্যান্ড। ৩ লক্ষ ৩৮ হাজার ১শ’ ৪৫ বর্গকিলোমিটার আয়তনের দেশে প্রায় ৫৫ লক্ষ জনগণের বসবাস। মনকাড়া প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দেশটি উন্নত দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। তবে একথা না বললেই নয় যে, ফিনল্যান্ডের শিক্ষাব্যবস্থা সেদেশের উন্নতির আসল চাবিকাঠি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ফিনল্যান্ডের ভগ্নপ্রায় অর্থনীতির মেরূদন্ডকে পুনরায় সোজা করে দাড় করিয়েছে সে দেশের সুসংগঠিত শিক্ষাব্যবস্থা। শিক্ষা একটি জাতির উন্নয়নে কতটা প্রভাব বিস্তার করতে পারে তারই জ্বলজ্যান্ত প্রমাণ এটি। তবে গতানুগতিক শিক্ষাব্যবস্থা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ফিনল্যান্ড।
সেখানে বিদ্যালয় মানেই যেন আনন্দের মহল। খেলার ছলে শিশুদের পাঠদানের সূচনা ঘটে। আমাদের দেশের মত বিদ্যালয়ে না যাওয়ার বায়না ধরেনা কোনো শিশু। শিশুদের বিদ্যালয়ের প্রতি এমন আকর্ষণের পেছনে রয়েছে চমৎকার কিছু পদ্ধতি।
আর্টিকেলে যা থাকছেঃ
৭ বছরের আগে ফিনিশ শিশুদের বিদ্যালয়ের অযোগ্য হিসেবে গণ্য করা হয়। কেবল ৭ বছর পূর্ণ হলেই তারা স্কুলে যাবার যোগ্য হয়। তবে সেজন্য তাদের নামতে হয়না কোনো ভর্তি যুদ্ধে। বাধ্যতামূলক শিক্ষার সুযোগ পায় প্রতিটি শিশু। অনেকেই ভাবতে পারে যে এত দেরিতে স্কুলজীবন শুরু হলে পড়ালেখা শেষ করতে না জানি কতবছর লেগে যায়। কিন্তু বাস্তবে এমনটা হয়না।
নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই শিক্ষাজীবনে ইতি ঘটে। ৩ বছর বয়সে শিশুকে দিতে হয় পাইভাকোতিতে। “পাইভাকোতি” ইংরেজিতে যেটাকে আমরা Day Care হিসেবে জানি। এখান থেকেই শুরু শিশুদের জ্ঞানার্জনের যাত্রা। তবে হাতেকলমে নয় বরং খেলার ছলে শিক্ষা দেওয়া হয় শিশুদের।
পাইভাকোতিতে খেলাধুলা, খাওয়া দাওয়া, ঘুমানো আর আধো আধো ভাষা শিক্ষা শুরু হয়। নিয়মিত বাচ্চাদের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে নিয়ে যাওয়া হয়। বাচ্চাদের এক ধরনের বিশেষ গাউন পরানো হয় কোথাও নিয়ে যাওয়ার সময়। এদেরকে ট্রাফিক সিগন্যাল সম্পর্কে শেখানো হয় প্রতক্ষ্যভাবে এবং এভাবেই এরা সিগন্যাল মেনে রাস্তায় চলাচল করার নিয়মগুলো ছোটবেলা থেকেই জব্দ করে ফেলে। এভাবেই ছোটোবেলা অতিবাহিত করে ফিনিশ শিশুরা।
শুনতে অবাক লাগছে? লাগবেইতো কারণ আমাদের দেশে পড়াশোনা মানেই গাদা গাদা হোমওয়ার্ক আর কদিন পরপরই পরীক্ষা। হোমওয়ার্ক আর পরীক্ষা ছাড়া পড়াশোনা অসম্ভব মনে হয় আমাদের সমাজে। তবে ফিনিশদের জন্য এটি খুবই সাধারণ একটি বিষয়। ফিনিশ শিশুদের কোনো হোমওয়ার্ক করা লাগেনা।
স্কুলে তাদের এতটাই মজবুতভাবে পড়ানো হয় যে বাসায় বাড়তি পড়ারও তেমন প্রয়োজন হয়না। তাই অন্যান্য দেশের তুলনায় এদের হোমওয়ার্ক করতে হয় খুব কম। শুধু হোমওয়ার্কই নয়,ফিনিশ শিক্ষার্থীদের বিরত থাকতে হয় পরীক্ষার চাপ থেকেও। মাত্র ১৬ বছর বয়সে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা বাধ্যতামূলক দিতে হয়।
এর আগে দীর্ঘ ৯ বছর তাদের কোন ধরণের বার্ষিক পরীক্ষায়ও অংশগ্রহণ করতে হয় না। কি অসাধারণ! এ যেন স্বপ্নের সেই পাঠশালা। পরীক্ষা যেমন গুরুত্বহীন তেমনটাই গুরুত্বহীন পরীক্ষার ফলাফল। শিক্ষক এবং অভিভাবক কারোরই এ নিয়ে নেই কোনো মাথাব্যথা। যার ফলে প্রকৃত শিক্ষার্জনে তাদের তুলনা হয়না।
নতুন নতুন জ্ঞানার্জনে আগ্রহী সর্বদাই। ক্লাস টপার আর ফেইলর বলতে সেখানে কিছুই নেই। সবাই সমমর্যাদার অধিকারী। প্রতিটি শিক্ষার্থীকে যোগ্য করে তোলাই তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য। “চাপিয়ে দেওয়া নয়, দায়িত্ববোধ থেকেই শিক্ষাগ্রহণ”-এমনটাই ফিনল্যান্ডের শিক্ষাব্যবস্থার মূলমন্ত্র।
আরও পড়ুনঃ খান একাডেমি –অনলাইন শিক্ষা ব্যবস্থায় একটি উল্লেখযোগ্য মাধ্যম
ফিনল্যান্ডের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারি। ফিনল্যান্ডের শিক্ষাব্যবস্থা ১০০% অবৈতনিক। তাই শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হয়না কোনো শিশু। যার ফলে শিক্ষা নিয়ে ব্যবসারও কোনো সুযোগ নেই সেখানে। অর্থের বিনিময়ে শিক্ষাদান নয় বরং দায়িত্ববোধ থেকেই শিক্ষাদানে অব্যাহত এখানকার শিক্ষকগণ। আমাদের দেশের মত ফিনল্যান্ডে নেই কোনো প্রাইভেট টিউটর বা কোচিং সেন্টার। শিক্ষাকেন্দ্রই যথেষ্ট শিক্ষার্জনের জন্য।
ফিনল্যান্ডের সমাজব্যবস্থায় শিক্ষকদের মর্যাদা অতুলনীয়। ফিনল্যান্ডে স্কুল শিক্ষক হিসাবে চাকরি পেতে ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা হতে হবে মাস্টার্স ডিগ্রী। তবে শুধু ডিগ্রি থাকলেই চলবে না। পড়ানোর ক্ষেত্রে থাকতে হবে বিশেষ দক্ষতা। যারা শিক্ষক হতে চান তাদের প্রতি ১০ জনে ১ জন শিক্ষক হওয়ার সুযোগ পান।
ভালো শিক্ষক হতে হলে ভালো ছাত্র হতে হবে আাগে এ মতবাদে বিশ্বাসী তারা। কিন্তু ভালো ছাত্র হলেও পড়ানোর দক্ষতাও ভালো থাকতে হবে, তবেই সে ব্যক্তি শিক্ষকতার সুযোগ পাবে। তবে বছরে বছরে শিক্ষক বদলানো হয়না, একই শিক্ষকের কাছেই প্রায় ৪-৬ বছর পড়ার সুযোগ হয়, যার ফলে ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে ভালো বোঝাপড়াও গড়ে ওঠে।
ফিনল্যান্ডের সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক বাছাই হয় স্টুডেন্টের মতামতে। শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয় মূলত অল্প সময়ের জন্য। এদের চাকরি নির্ভর করে স্টুডেন্টদের মতামতের ওপর। প্রতিটি কোর্স শেষে স্টুডেন্টদের কাছ থেকে মতামত নেওয়া হয়। খারাপ মতামত পেলে ওই শিক্ষকের চাকরি থাকে না আর।
যার পড়ানো ভালো বুঝতে পারে তাকেই শিক্ষক হিসেবে বেছে নেয় স্টুডেন্টরা। তাই শিক্ষকেরাও সব সময় ভালো পড়ানোর চেষ্টাই করে থাকেন।
না বুঝে মুখস্থ করার প্রয়োজন হয়না সেখানে, কেননা হাতেকলমে শেখানো হয় সবকিছু। কারিগরি শিক্ষাদানে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয় ফিনল্যান্ডের শিক্ষাব্যবস্থায়। বিশেষ করে বিজ্ঞানভিত্তিক বিষয়গুলি প্রাক্টিকালি শেখানো হয় সবাইকেই।
এতে করে পড়াশোনায় আরও বেশি আগ্রহী হয়ে ওঠে শিক্ষার্থীরা। পাসের জন্য নয় সঠিক জ্ঞান অর্জনের পেছনে ছুটে চলেছে সবাই। বেসিক শিক্ষাদানে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়। শিক্ষার বাস্তব প্রয়োগের মাধ্যমে সমাজের উন্নয়ন করাই ফিনল্যান্ডের শিক্ষাব্যবস্থার একমাত্র লক্ষ।
বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা শেষে উচ্চমাধ্যমিক পড়ার পালা। উচ্চমাধ্যমিকে ২-৪ বছর সময় লাগে। উচ্চমাধ্যমিক পাসের পর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার বিশেষ সুযোগ পায় সেখানকার শিক্ষার্থীরা। ফিনল্যান্ডে মোট ১০টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, ন্যাশনাল ডিফেন্স বিশ্ববিদ্যালয়সহ পাঁচটি স্পেশালাইজড বিশ্ববিদ্যালয়, ২৭টি পলিটেকনিক বা অ্যাপ্লাইড সায়েন্স বিশ্ববিদ্যালয় আছে।
যোগ্যতা অনুসারে পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পাবে যে কেউ। তবে ভালো চাকরি লাভের আশায় কিংবা সার্টিফিকেট অর্জনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় ছুটে না কেউ। বরং যাদের গবেষণার প্রতি প্রবল আগ্রহ থাকে তারাই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়।
সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় মানেই একটা ভালো গবেষণা কেন্দ্র এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরাও একেকজন অনেক ভালো গবেষক। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকেও ছাত্রছাত্রীরা গবেষণার জন্য বেছে নেয় ফিনল্যান্ড। তবে যাদের গবেষণার প্রতি আগ্রহ থাকেনা তারা নিজেদের ক্যারিয়ার শুরু করে দেয় এপর্যায়।
নৈতিক শিক্ষা প্রদানে ফিনল্যান্ড অন্যতম। ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনার পাশাপাশি নীতিশিক্ষায় দীক্ষিত হয়ে ওঠে সেখানকার ছাত্রছাত্রীরা। শুধু পাঠ্যবইয়ের শিক্ষাকে যথেষ্ট মনে করেনা তারা, পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি নীতিশিক্ষাটাও অপরিহার্য মনে করে ফিনিশরা। একারণে তাদের নৈতিকতার পরিচয় মেলে সচারাচর যা আসলেই প্রশংসনীয়।
পরিশেষে বলা যায়, এই ছোট ছোট প্রচেষ্টাই ফিনল্যান্ডের শিক্ষাব্যবস্থা -কে পৃথিবীতে সেরা স্থান দখল করতে সহায়তা করেছে। “শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড” ছোটোবেলা থেকে এই প্রবাদটি আমরা কেবল মুখস্থ করে এসেছি, তবে এই প্রবাদের বাস্তবতা প্রকাশ পায় ফিনল্যান্ডের শিক্ষাব্যবস্থায়।
আামাদের দেশে এমন শিক্ষাব্যবস্থা আজও স্বপ্নের মতো। তবে, আমাদের সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমরাও বদলে দিতে পারি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে। শুধু সার্টিফিকেটের পেছনে না ছুটে প্রকৃত শিক্ষা অর্জনে নিয়জিত হলে শিক্ষার মান বেড়ে যাবে বহুগুণে।
ছবিঃ সংগৃহীত
মন্তব্য লিখুন