সাধারণ ভাতের হোটেল নিয়ে বাংলা সাহিত্যে রয়েছে অসাধারণ দুটি উপন্যাস। দুই প্রজন্মের দুজন লেখকের এ বই দুটি স্থান, কাল, পাত্রভেদে জয় করে নিয়েছে অসংখ্য পাঠকের হৃদয়। বই দুটি হল বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায় রচিত ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’ ও কল্লোল লাহিড়ী রচিত ‘ইন্দুবালা ভাতের হোটেল’।
বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের লেখা বহুল জনপ্রিয় এ উপন্যাস প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৪০ সালে। ইংরেজ শাসনামল চলাকালে অখন্ড ভারতের পটভূমিতে এক ভাতের হোটেলের রাঁধুনিকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে এ গল্প।
রানাঘাট স্টেশনের রেল বাজারের একটি সাধারণ ভাতের হোটেলে রাঁধুনির কাজ করেন বাঙালি ব্রাক্ষ্মণ হাজারি ঠাকুর। অসাধারণ সব রান্নায় পারদর্শী হওয়ার পরেও হোটেল মালিক বেচু চক্রবর্তীর কাছ থেকে নিজের প্রাপ্ত সম্মান কিংবা সম্মানি কোনটাই পায় না হাজারি ঠাকুর।
উপরন্তু হোটেলের আরেক কর্মচারী পদ্ম ঝিয়ের খারাপ আচরণ সহ্য করে যায় সে। ঠাকুর স্বপ্ন দেখেন তার নিজের ভাতের হোটেল গড়ে তোলার। কিন্তু তার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের ব্যবস্থা নেই তার। এরই মাঝে পদ্ম ঝি তাকে হোটেলের বাসনপত্র চুরির অপবাদ দিলে নিজের চাকরিটিও হারাতে হয় হাজারি ঠাকুরকে।
অতঃপর নিজের বহুদিনের স্বপ্ন পূরণের পথে যাত্রা শুরু হয়। নিজ গ্রামের দুই মেয়ে অতশী আর কুসুমের কাছ থেকে অর্থের যোগান আসে। শুরু করেন আদর্শ হিন্দু হোটেল। এরপর সেই স্বপ্নের সাথে দৌড়ে চলতে থাকা হাজারিকে আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি।
বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের লেখনীতে এক সম্মোহনী শক্তি আছে। সাধারণ বর্ণনাও তার কলমে অপূর্ব সুন্দর হয়ে ওঠে। সামান্য ভাতের হোটেল আর তার এক দরিদ্র রাঁধুনির স্বপ্নকে এত নিপুণ ভাবে তুলে ধরা তার পক্ষে অস্বাভাবিক কিছু নয়।
আদর্শ হিন্দু হোটেল বাস্তবিকই আদর্শের কথা বলেছে। সততা ও নিষ্ঠার সাথে চললে নিজ নিজ স্বপ্ন পূরণের পথ যে সহজ সুন্দর হয়ে যায় সেই কথাই ফুটে উঠেছে এ বইয়ে। সাথে আছে আত্মীয় সম্পর্ক না থাকলেও আত্মীয় হয়ে ওঠার কথা, স্নেহের কথা। কারো উপর রাগ বা ক্ষোভ প্রকাশ না করে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অপূর্ব নজির রয়েছে এতে। বাংলা সাহিত্যের অবশ্য পাঠ্য একখানা বই আদর্শ হিন্দু হোটেল।
অপেক্ষাকৃত নতুন সময়ের উপন্যাস ইন্দুবালা ভাতের হোটেল। কলকাতার তরুণ লেখক কল্লোল লাহিড়ী রচিত বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় ২০২০ সালের জুলাই মাসে। এ বইয়ে এক বিধবার ভাতের হোটেল, অসাধারণ সব রান্না আর তার একাকিত্বের কথা অনেকখানি মায়া মিশিয়ে তুলে ধরেছেন লেখক।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পূর্ব থেকে বর্তমান সময়ের দীর্ঘ স্মৃতিচারণ উঠে এসেছে ইন্দুবালা ভাতের হোটেলে। খুলনার কলাপোতা গ্রামের ইন্দুকে বিয়ে দেয়া হয় কলকাতার এক বিপত্নীক পুরুষের সাথে।
বিয়ের পর কলকাতার ছেনু মিত্তির লেনে ইন্দুর নতুন জীবন শুরু হয়। নিজ দেশ ও পরিবার ছেড়ে এই অচেনা অজানা জায়গায়ই জীবন কাটিয়ে দিতে হয় ইন্দুকে। অল্প বয়সে তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে বিধবা হয়ে গেলে নতুন এক সংগ্রামের পথ খুঁজতে হয় তাকে।
মাছওয়ালী লছমির উৎসাহে শুরু করে ভাতের হোটেল চালানো। শূণ্য থেকে শুরু করা এ হোটেল ধীরে ধীরে ইন্দুর রান্নার জাদুতে খ্যাতি অর্জন করতে থাকে।
একদিকে ছেলে মেয়েদের শিক্ষিত ও প্রতিষ্ঠিত করা, অপরদিকে নিজের হোটেলকে মায়া ও ভালোবাসার মিশেলে পরিচালনা করতে থাকে সে।
নিজ দেশের নানান স্মৃতি রোমন্থন এবং সবাই থাকার পরেও এক অদ্ভুত একাকিত্বের সাথে চলাই ইন্দুর নিত্যদিনের কাজ হয়ে দাঁড়ায়। ছেনু মিত্তির লেনের বাড়িটা আর নিজ হোটেলের সীমিত গন্ডির মাঝে জীবনকে আটকে ফেলে ইন্দু।
ছেলে মেয়েরা মাকে এই সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্ত করতে চাইলেও বিবাদে জড়িয়ে পড়ে ইন্দু নিজেই। যেখানে নতুন একটা জীবনের শুরু হয়েছিল ইন্দুর, যেখানে ধাক্কার পর উঠে দাঁড়াতে শিখেছে, সে জায়গায় জীবন কাটিয়ে দেয়াই যেন ইন্দুর শেষ এবং একমাত্র ইচ্ছে।
আধুনিক সময়ের সাথে অতীতের এক অপূর্ব মেলবন্ধন দেখা যায় ইন্দুবালা ভাতের হোটেল বইটিতে। এক বিধবার জীবনের গল্প উঠে এসেছে তার রান্নাঘরের হাঁড়ি কড়াই, উনুন আর কুমড়ো ফুলের বড়ায়।
বাঙালি রান্নার জাদুর সাথে লেখক যেন আধুনিক যুগের একটা পরিচয় ঘটিয়ে দিচ্ছিলেন এখানে। সাথে ছিল দেশভাগের আগেই দেশ থেকে আলাদা হয়ে পড়া এক তরুণীর গত হয়ে যাওয়া জীবন, অপূর্ণ ইচ্ছেদের দীর্ঘশ্বাস আর শক্তহাতে ভবিষ্যত গড়ার যুদ্ধ জয়ের গল্প।
সহজ সাবলীল বর্ণনার এ বইটি অদ্ভুত এক মায়ার জালে পাঠককে জড়িয়ে ফেলতে সক্ষম। সাধারণ এক মহিলার সাধারণ ভাতের হোটেল তার জীবনের গল্পে আমাদের চোখে জীবন্ত হয়ে ধরা দেয়। আর এখানেই ইন্দুবালা ভাতের হোটেলের স্বার্থকতা, অসাধারণ হয়ে ওঠা।
দুটি ভিন্ন প্রজন্মের দুজন লেখক সাধারণ ভাতের হোটেলকে কেন্দ্রে রেখে যে মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন তা সত্যিই প্রশংসার দাবিদার। পাঠক হৃদয়ে আদর্শ হিন্দু হোটেল ও ইন্দুবালা ভাতের হোটেল দুটি বই-ই জায়গা করে নিতে পেরেছে। বাংলা সাহিত্যের এই মানিকজোড়কে অবশ্য পাঠ্য বলা যেতেই পারে।
মন্তব্য লিখুন