সৃষ্টিকর্তা নাকি সকল মানুষকে সমান মেধা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু আমরা কি সবাই সমানভাবে আমাদের মেধা ব্যবহার করতে পারি? আমরা সবাই কি সমান মেধাবী? নিশ্চয়ই না। যদি আমরা সবাই সমান ভাবে আমাদের মেধার প্রয়োগ করতে পারতাম তাহলে তো আমরা সবাই, বিজ্ঞানী নিউটন, আইনস্টাইন কিংবা, আর্কিমিডিস হতাম।
প্রকৃতপক্ষে আমরা সবাই আমাদের মেধার সঠিক ব্যবহার করতে পারিনা। আবার কখনো কখনো আমরা আমাদের মেধার উৎসটাকেই খুঁজে পাইনা। অন্যদিকে কারো কারো মধ্যে শিশু কাল থেকেই তার মেধার পরিস্ফুটন ঘটতে থাকে। আর কারো মধ্যে যখন বয়সের তুলনায় অধিক মেধার পরিস্ফুটন ঘটে তখন আমরা তাকে এক বিষ্ময় হিসেবে বিশেষায়িত করি।
মাত্র দেড় বছর বয়সে যদি কোনো শিশু রসায়নের পর্যায় সারণী মুখস্থ করে ফেলে এবং পদার্থ বিজ্ঞানের কঠিন কঠিন সূত্র আয়ত্ত করে ফেলে তাহলে তো তাকে বিষ্ময় বলতেই হয়। এমনই এক বিষ্ময়কর বালকের কথা বলতে চলেছি আজ।
অনেকেই হয়তো আন্দাজ করতে পেরেছেন কার কথা বলতে চলেছি। হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন বলছি বিষ্ময় বালক সুবর্ণ আইজাক বারী এর কথা।
বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত সুবর্ণের জন্ম ২০১২ সালের ৯ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রে। পিতা রাশেদুল বারী চট্টগ্রামের সন্তান। তিনি উচ্চশিক্ষার জন্য নিউইয়র্কে আসেন এবং ব্রঙ্কসের লিমন কলেজে পড়াশোনা করেন।
বর্তমানে তিনি নিউইয়র্ক সিটি ইউনিভার্সিটির বারুখ কলেজে গনিত বিভাগে অধ্যাপনা করছেন এবং সেই সাথে তিনি নিউ ভিশন চার্টার হাই স্কুল ফর অ্যাডভান্সড ম্যাথ এন্ড সাইন্সে পদার্থ বিজ্ঞানের একজন শিক্ষক।
সুবর্ণের মা শাহেদা বারী ও ব্রঙ্কস কমিউনিটি কলেজ থেকে একাউন্টিং- এ ডিগ্রি নিয়েছেন। তিনিও চট্টগ্রামের সন্তান।এছাড়াও সুবর্ণের একটি বড় ভাই আছে।সে ও খুব ভালো ছাত্র।
ছোট বেলা থেকেই সুবর্ণ আইজাক বারী একটু আলাদা। এক বছর পূর্ণ হবার আগেই তার মুখে কথা ফোটে। বাড়িতে শিক্ষার ভালো পরিবেশ থাকায় ছোট থেকেই অনেক কিছু শিখতে শুরু করে সুবর্ণ।
২০১৩ সালে সুবর্ণের বয়স যখন মাত্র এক বছর তখন তার খুব শরীর খারাপ করে ফলে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। পিতা রাশেদুল বারী, সুবর্ণকে বললেন, “আই লাভ ইউ মোর দেন এনিথিং ইন দা ইউনিভার্স ” উত্তরে সুবর্ণ বলল ,“ইউনিভার্স অর মাল্টিভারস?”এই কথা শুনে রাশেদুল বারী ভিষণ চমকে গিয়েছিলেন।
এরপর মাত্র দেড় বছর বয়সেই রসায়নের পর্যায় সারনী মুখস্ত করে ফেলে সুবর্ণ যা কিনা নবম-দশম শ্রেণির পাঠ্যপুস্তেকের পাঠ্য বিষয় । রাসেদুল বারী তখন আরো চমকে যান। খুশিতে সুবর্ণের এই প্রতিভার একটি ভিডিও করেন এবং সোসাল মিডিয়ায় প্রকাশ করেন।
অনেক প্রশংসা কুরায় এই প্রতিভার জন্য। তখন একদিন প্রফেসর মাহফুজুর রহমান সুবর্ণের পিতা রাশেদুল বারীকে ফোন করে বলেন, “তিনি যেন তার ছেলের নাম পরিবর্তন করে আইজাক রাখেন, কারণ তার ধারণা সুবর্ণ একদিন অনেক বড় বিজ্ঞানী হবে “।
তখন রাশেদুল বারী তার ছেলে সুবর্ণের নাম পরিবর্তন করে রাখলেন সুবর্ণ আইজাক বারী এবং বড় ছেলে রিফাতের নাম পরিবর্তন করে রাখেন রিফাত অ্যালবার্ট বারী। এরপর থেকে রাশেদুল বারী সুবর্ণকে গনিত, জ্যামিতি,পদার্থ বিজ্ঞান ও রসায়নের বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা দিতে থাকেন।
এরপর চার বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রের এনবিসি চ্যানেল সারা বিশ্ব থেকে সবচেয়ে মেধাবী হিসেবে স্বীকৃত প্রায় ২.২ বিলিয়ন শিশুর মধ্যে থেকে ৩০ হাজার শিশুকে তালিকাভুক্ত করে এবং বিভিন্নভাবে তাদের সঙ্গে কথা বলে, সাক্ষাৎকার নিয়ে, এমনকি লিখিত পরীক্ষা নেয় এবং সেই ৩০ হাজার মেধাবী শিশু থেকে মাত্র ২০ জনকে বাছাই করে। সেই ২০ জনের একজন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত “সুবর্ণ আইজাক বারী”।
এই বাছাই প্রক্রিয়ায় এনবিসি, সুবর্ণের ২৩ টি সাক্ষাৎকার নেয়। এর মধ্যে কতগুলো সাক্ষাৎকার হয় মৌখিক, কতগুলো সাক্ষাৎকার হয় লিখিত এবং কিছু সাক্ষাৎকার হয় ফোনালাপে। সুবর্ণ আইজাক বারী সবগুলো সাক্ষাৎকার ও পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়। এই প্রতিযোগীতায় জেতার জন্য সুবর্ণকে ৫০ হাজার ডলার দেওয়ার কথা জানান এনবিসি।
২০১৪ সালের ২১ মার্চ সিটি কলেজ অফ নিউইয়র্ক এর প্রেসিডেন্ট ডক্টর লিসা কৈকো সুবর্ণ আইজাক বারী -কে আমন্ত্রণ জানান সুবর্ণের অংক,পদার্থবিদ্যা এবং রসায়নের মেধা যাচাই করার জন্য। সুবর্ণকে পিএইচডি স্তরের গনিত, পদার্থবিদ্যা ও রসায়নের সমস্যা গুলো অনায়াসে সমাধান করতে দেখে সুবর্ণর প্রতিভায় তিনি মুগ্ধ হন, এবং তিনি সুবর্ণকে “আমাদের সময়ের আইনস্টাইন” নামে অভিহিত করেন।
২০১৫ সালের ১২ জুন লিমন কলেজের ফিজিক্সের চেয়ারম্যান ডক্টর ড্যানিয়েল কাবাট সুবর্ণর প্রতিভা যাচাই করার জন্য তাকে তার কলেজে আমন্ত্রণ জানান। সেখানে সুবর্ণ আইজাক বারী তার লেবু ব্যাটারি বানিয়ে তাকে মুগ্ধ করেন। (এই ব্যাটারি তৈরি করতে সুবর্ণ চারটি লেবু, চারটি পেরেক, পাঁচটি এলিগেটর ক্লিপ ব্যবহার করে)। এরপর থেকে অনেক বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও গুনীজন সুবর্ণের প্রশংসা করেছেন।
২০১৬ সালের নভেম্বরে মাত্র চার বছর বয়সে সুবর্ণ তার মেধার স্বীকৃতিস্বরূপ আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার কাছ থেকে চিঠি পায়। উল্লেখ্য যে সুবর্ণের আগে বাংলাদেশী হিসেবে এমন স্বীকৃতিস্বরূপ চিঠি একমাত্র ড. ইউনুস পেয়েছিলেন।
এছাড়াও অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর লুইস রিচার্ডসন, নোবেলজয়ী ডক্টর অলিভার হাট, পেনসিলভেনিয়া ইউনিভার্সিটির প্রেসিডেন্ট আমি গুটম্যান, বৃটেনের পার্লামেন্টের বর্তমান স্পিকার স্যার জন সাইমন বারকোর কাছ থেকেও স্বীকৃতিস্বরুপ চিঠি পায় “সুবর্ণ আইজাক বারী”।
২০২০ সালের ৮ ই মার্চ এনবিসির “লিটল বিগ শট” অনুষ্ঠানের প্রাইম টাইমে আমন্ত্রণ জানানো হয় সুবর্ণকে। এই অনুষ্ঠানে বিশ্বের সকল মেধাবী বা বিশেষ প্রতিভাবান বাচ্চাদের আমন্ত্রণ করা হয়। এই অনুষ্ঠানে একজন বাঙালী শিশুকে দেখে অনেকেই আশ্চর্য হয়ে যায়। সেখানে, পিএইচডি পর্যায়ের গণিত, পদার্থবিজ্ঞান এবং রসায়ন এর বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে তার কাছে জানতে চাওয়া হলে সুবর্ণ আইজাক বারী অনায়াসে তার উত্তর দেয়।
২০১৮ সালে সুবর্ণর বয়স যখন মাত্র ৬ বছর তখন সে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাকে বিজ্ঞানী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।এই হিসেবে সুবর্ণ বিশ্বের সবচেয়ে ছোট বিজ্ঞানী এর স্বীকৃতি পায়।
নোবেল বিজয়ী কৈলাস সত্যার্থী দিল্লিতে সুবর্ণ আইজাক বারী -কে বিজ্ঞানী হিসেবে “গ্লোবাল চাইল্ড প্রোডিজি অ্যাওয়ার্ড” দেন এবং ভারতের রুইয়া কলেজ অফ মুম্বাই বিশ্ববিদ্যালয় সুবর্ণকে ভিজিটিং অধ্যাপক পদার্থবিজ্ঞানী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে। সুবর্ণ যে আর ১০টি সাধারণ শিশুর চেয়ে আলাদা এবং তাদের থেকে অনেক বেশি জানে এটাতে কোনো সন্দেহ নেই। তাই তো সে মাত্র ১০ বছর বয়সেই হাভার্ডে ভর্তি হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। এজন্য উচ্চ মাধ্যমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে যে এসএটি পরীক্ষা দিতে হয়, সে পরীক্ষা দেওয়ার অপেক্ষায় আছে সুবর্ণ।
সুবর্ণের এত খ্যাতি নিসন্দেহে বাঙালী জাতীর জন্য গর্বের বিষয় এবং আমরা সত্যিই গর্বিত যে সুবর্ণ একজন বংশোদ্ভূত বাঙালি।অন্যদিকে সন্তান যদি এমন প্রতিভাধর হয় তাহলে পিতামাতা ও গর্ব বোধ করে। কিন্তু দুঃখের কথা হলো সুবর্নের পিতা রাশেদুল বারী একটু বেশিই গর্বিত বোধ করছেন এই বিষয়ে।
তিনি হয়তো গর্বকে অহংকারের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছেন। সুবর্নের এই প্রতিভা এবং খ্যাতি দেখে ৬ বছর বয়স থেকেই বলে চলেছেন যে মাত্র ৬ বছর বয়সেই তার ছেলে নোবেল পাওয়ার যোগ্য। কিন্তু কেন এখনো সুবর্ণকে নোবেল দেওয়া হচ্ছে না এটা নিয়ে সে খুবই ক্ষুব্ধ।
এজন্য রাশেদুল বারী কিছুক্ষণ পরপর তার ফেজবুক, ইউটিউব ও বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সুবর্নের বিভিন্ন ছবি, ভিডিও, আর্টিকেল ও ব্লগ প্রকাশ করে চলেছে।
কোনো ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে যে সুবর্ণ আইজাক বারী ব্লাকবোর্ডে অংক করছে, কোনোটায় দেখা যাচ্ছে সে জানালার কাঁচে অংক করছে কখনো বা আবার বাবার সঙ্গে ল্যাবে কাজ করছে, একটা ছবিতে দেখা গেলে যে ঈদের দিনে ও তিনি ছেলেকে দিয়ে অংক করাচ্ছেন ।
এছাড়াও বাড়তি প্রচারণার জন্য তিনি, কোটা সংস্কার আন্দোলন ও নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মত বিষয়ে টেনে এনেছেন ছোট্ট সুবর্ণকে।
মূলত তার নিজের বক্তব্যই তার সাত বছরের ছেলের মুখ দিয়ে বলিয়েছেন। হয়তো তার ধারণা সুবর্ণের জন্মের একমাত্র উদ্দেশ্য হলো নোবেল জয় করা। নোবেল পাওয়া যেন বাধ্যতামুলক। ছবি বা ভিডিওগুলো দেখে যে কারো মনে হবে, যে বয়সে একটি শিশুর বন্ধুদের সাথে খেলাধুলা করার কথা, বাইরে ঘুরতে যাবার কথা সে সময়ে সে কিনা অংক করে কাটাচ্ছে।
অনেকেরই ধারণা রাশেদুল বারী তার ছেলের শৈশবটাকে নষ্ট করে দিচ্ছে। অনেকে আবার মনে করেন এই বদ্ধউন্মাদ পিতার হাত থেকে সুবর্ণ আইজাক বারী -কে বাঁচানো দরকার নাহলে এই নোবেল জয়ের প্রতিযোগিতায় খসে পরবে একটি প্রতিভাবান তারকা।
এখানে আরো বলে রাখা উচিত যে সুবর্ণের পিতা রাশেদুল বারী বাংলাদেশী মিডিয়া, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. ইউনুসের উপরও বেশ ক্ষুব্ধ।
তার বক্তব্য হলো যেখানে বিশ্বের বড় বড় সংবাদ মাধ্যমগুলো সুবর্ণের জয়জয়কার করছে সেখানে বাংলাদেশী মিডিয়া কেনো সুবর্ণকে নিয়ে কোনো মাতামাতি করছে না।
সে চায় বাংলাদেশী মিডিয়া সুবর্ণর সুখ্যাতি করুক। অন্যদিকে যেখানে বিভিন্ন দেশের প্রধানমন্ত্রী ও বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গ সুবর্ণের সাথে দেখা করার জন্য ব্যস্ত হয়ে আছেন সেখানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একবারও সুবর্ণের সাথে দেখা করার জন্য বলেননি শুধুমাত্র দুজন সচিব পাঠিয়ে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন।
তাই সে এখন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যদি এখন নিজে থেকেও সুবর্ণের সাথে দেখা করতে চায় তাহলে সে রাজী হবে না। অপরদিকে ২০১৬ সালে ড. ইউনুস যখন শান্তিতে নোবেল পুরস্কারে জন্য মনোনীত হয়েছিলেন, তখন রাসেদুল বারী ড. ইউনুসকে নিয়ে ১০ টির ও বেশি বই ও গান রচনা করেছিলেন।
তার ধারণা এসকল প্রচারণা তার নোবেল জয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তাই তিনি চায় ড. ইউনুস ও সুবর্ণ আইজাক বারী -কে নিয়ে লেখালেখি করুক। কিন্তু তিনি যেহেতু এমনটি করছেন না তাই রাশেদুল বারী ড. ইউনুসের উপরও ক্ষুব্ধ।
অবশেষে একটি কথাই বলতে পারি সুবর্ণ আইজাক বারী নিঃসন্দেহে একজন মেধাবী এবং বিষ্ময়কর বালক। সে পুরো বাঙালি জাতির গৌরব। সুবর্ণ আইজাক বারী যদি ভবিষ্যতে নোবেল জেতে তাহলে আমরা সবাই খুশি হবো। কিন্তু শুধু মাত্র নোবেল জয় তার জীবনের লক্ষ হতে পারে না। আর সোসাল মিডিয়ায় রাসেদুল বারীর অতিরঞ্জিত বক্তব্য সুবর্ণের নোবেল জয়ের পক্ষে জনমত গড়তে পারবে না বরং হয়তো সকলের বিরক্তির বিষয় করে তুলবে।
ছবিঃ সংগৃহীত
মন্তব্য লিখুন